খবরে প্রকাশ বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নাকি টার্গেট বেঁধে দিয়েছে। ৩৫, ৩৫টা আসন জিততে হবে এই বাংলায়। গতবারে বিজেপি জিতেছিল ১৮টা আসন, তার মধ্যে একটা অফিসিয়ালিই নেই, আসানসোল এখন তৃণমূলের হাতে, মানে সাকুল্যে সতেরোটা যাদের ঝোলায়। তাদের জিততে হবে আরও ১৮টা আসন, এটাই টার্গেট। ক্রিকেটের জেতার স্কোর যখন ৮ বলে ৩০ রান হয়, তখন খেলোয়াড়দের খেলার কোনও ইচ্ছেই থাকে না, ৮টা বল শেষ করে প্যাভিলিয়নে ফিরে যাওয়াটাই লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই টার্গেট সেট করে দেওয়া শেষমেশ বিজেপিকে ওইরকম স্টোইক না করে দেয়, উদাসী, বিবাগী না করে দেয়। যাঁদের জন্য এই টার্গেট ফিক্স করা হল, তাঁদের আলোচনায় পরে আসব, যাঁরা এই টার্গেট ফিক্স করলেন সেই আহাম্মকদের কথাটা আগে বলে নিই। আচ্ছা, কোনও বিজেপি নেতা সিরিয়াসলি এরকম ভাবতেও পারেন, যে ২০২৪-এ এই বাংলায় বিজেপি ৩৫টা আসন পাবে, অন্যদিকে তৃণমূল ৭টা? আপনি বলতেই পারেন যে এটা হল এক ধরনের ভোকাল টনিক। আরে ভাই ভোকাল টনিক দেওয়ার হলে বলত, পঞ্চায়েতের ফলাফলে অনেক জল আছে, আমরা এবার বাংলা থেকে আরও পাঁচটা আসন বেশি নিয়ে আসার চেষ্টা চালাব। কিন্তু আঠেরোটা আসন বেশি নিয়ে আসতে হবে, এটা একটা টার্গেট হল? এবং কোন সময় বলা হচ্ছে? সদ্য হয়ে যাওয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের সবক’টা জেলা পরিষদ হারানোর পরে, ইন ফ্যাক্ট গোটা জেলাতে একটা জেলা পরিষদও হাতে রাখতে পারেনি বিজেপি। সেই দল, যারা নিজেদের ১৮টা আসন বাঁচাতে পারলে ধন্য হয়, তাদের মাস্টারমশাইয়েরা টার্গেট বেঁধে দিলেন ৩৫। এটাই বিষয় আজকে, বিজেপি লোকসভায় বাংলায় ৩৫টা আসন পাবে?
ক’দিন আগেই জেলা পরিষদের ফলাফলে আমরা দেখেছি উত্তরবঙ্গ থেকে বিজেপি কার্যত মুছেই গেছে। আলিপুরদুয়ারে বিজেপি ২০২১-এও ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, সেখানে এবারে ৩৮.৭০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। কোচবিহারে ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, এবার পেয়েছে ৩২ শতাংশ ভোট। জলপাইগুড়িতে ৪৫ শতাংশ ভোট ছিল বিজেপির, এবার ৩৬ শতাংশ। উত্তর দিনাজপুরে ৩৫ শতাংশ ভোট ছিল ২০২১-এ, এবার জেলা পরিষদে ২৩.৮০ শতাংশ ভোট। দক্ষিণ দিনাজপুরে ৪১ শতাংশের জায়গায় এবারে বিজেপি ৩০.৮০ শতাংশ। কোন জাদুবলে বিজেপি এবার এইসব আসনগুলো জিতবে? আর উত্তরবঙ্গেই যদি হারে, তাহলে দক্ষিণবঙ্গে বিজেপির কী হইবে? এদিকে বিজেপির তিনখানি ঘোড়া, তাঁরা আবার তিনমুখো, তাদেরকে নিয়ে গিয়ে দিল্লিতে চানা, আপেল খাওয়ানোর পরেও তাঁরা এ রাজ্যে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই নিজেদেরকে লাগাম দিতে পারেন না। প্রত্যেকের আবার নিজস্ব অনুগামী আছে, যা গত লোকসভার নির্বাচনে আমরা দেখিনি।
আরও পড়ুন: Aajke | সত্য খোঁজার নামে বিজেপির সীমাহীন ভণ্ডামি
সব মিলিয়ে এখন ভরসা বালুরঘাটের সুকান্ত মজুমদার, মেদিনীপুরের দিলীপ ঘোষ, আর পূর্ব মেদিনীপুরে যদি শুভেন্দু দাঁড়ান, তাহলে এই তিনটে আসন নিয়ে তবু কিছু কথা হবে, অন্য আসনে বিজেপি জিতে ফিরবে? না, অঙ্ক তো তেমন বলছে না। ধরুন, পুরুলিয়া, গত বিধানসভা নির্বাচনে গত লোকসভার চেয়ে ভোট শতাংশ কমেছিল, ৪০.৯০ শতাংশে ঠেকেছিল, এবারে? ২৮.৯০ শতাংশ, মানে ১২ শতাংশ ভোট কমেছে। পুরুলিয়াতে তেমন কোনও অশান্তিও ছিল না, পুরুলিয়া জেতা অসম্ভব। ধরুন ঝাড়গ্রাম, ২০২১-এ ছিল ৩৭.৪০ শতাংশ, এবারে সেটা ২৮ শতাংশে এসে ঠেকেছে। সারা রাজ্যেই অবস্থাটা এইরকমই। কিন্তু টার্গেট ৩৫। পি সি সরকার আগে দাঁড়িয়ে হেরেছিলেন, মধ্যে আবার একটু ভেসে ওঠার চেষ্টা করছিলেন, পঞ্চায়েত ভোটের পরে আবার শান্ত হয়ে গিয়েছেন। তো তাঁর ম্যাজিক দিয়েও বাংলাতে ৩টে আসনও জেতা অসম্ভব যাদের, তাদের বলা হচ্ছে ৩৫টা আসন জিতে ফিরতে হবে। এরকম চাপ দেবেন না নাড্ডাজি, নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যাবে। আরেকটা জিনিসও তো পরিষ্কার। রামে গিয়েছিল যে বাম ভোট, সেই ভোট কিছুটা হলেও ফিরছে, অন্তত দক্ষিণবঙ্গে, তা স্পষ্ট। তারাই খেলা বিগড়ে দেবে নিশ্চিত। এবং জোট, টিম ইন্ডিয়া এ রাজ্যে একসঙ্গে নামবে তা হয়তো হবে না, কিন্তু হাইকম্যান্ডের চাপেই কং-তৃণমূল জোট হতেই পারে। সেক্ষেত্রে ওই নদিয়া, বা মতুয়া অধ্যুষিত আসনেরও বারোটা বেজে যাবে। সবমিলিয়ে এক অসম্ভব টার্গেট সেট করে দেওয়া হল বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে। সেটাই আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের দর্শকদের, ২০১৯-এ যারা ১৮টা আসন পেয়েছিল, এখন যাদের হাতে ১৭টা আসন আছে, সেই বিজেপি আগামী লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যের ৪২টা আসনের ৩৫টা আসন পেতে পারে?
এ রাজ্যে বিজেপির সমস্যা হল এ রাজ্যের মানুষের তীব্র হিন্দুত্বের প্রতি অনীহা। জয় শ্রীরাম আর আওরঙ্গজেব কা অওলাদ ইত্যাদি স্লোগানে বাঙালিকে পাশে পাওয়া মুশকিল। গোবলয়ে শুদ্ধ শাকাহারী এলাকায় এসব স্লোগান কাজে দেয়। বাঙালি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত রেস্তরাঁতে গেলে এক নম্বর চয়েজ মোগলাই খানা, দু’ নম্বরে চাইনিজ। আমাদের বাংলার গ্রামে কৃষকরা অনেকেই ভোরের আজান শুনে বিছানা ছেড়ে কাজে নামে। আমাদের বাংলার কবি রবি ঠাকুর, নজরুল। আমাদের মাটিতে কড়া হিন্দুত্বের চাষ সম্ভব নয়। কিন্তু খানিক নরেন্দ্র মোদির কেরামতিতে, খানিক শাসকদলের চাপে বামেদের ভালো একটা ভোট গিয়েছিল বিজেপির দিকে। বিজেপি সেটা পেয়েই ভেবেছিল ব্যস, এবার মুখ্যমন্ত্রিত্ব আটকায় কে, কিন্তু সেই বামেদের ভোট আবার বামেই ফিরছে, আরও কিছু ফিরবে। বিজেপির এ রাজ্য দখলের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে, ২০২৪-এ ৩৫ দূরস্থান, খান দুই তিন পেলেই বিজেপির নিজেদের ভাগ্যবান বলে মনে করা উচিত।