কলকাতা: পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের (Calcutta High Court )। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ এই নির্দেশ দিয়েছে। রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় বাহিনী বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু আদালত রাজ্যের আপত্তি খারিজ করে জানিয়ে দিল, ভোট হবে কেন্দ্রীয় বাহিনী (Central Force) দিয়ে। এই নির্দেশের ফলে জোর ধাক্কা খেল রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন।
প্রধান বিচারপতি টি এস শিভগননমের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানাতে হবে। যে সমস্ত পুলিশকর্মী ভোটের ডিউটিতে থাকবেন তাদের প্রত্যেকের গলায় আই কার্ড ঝুলিয়ে রাখতে হবে। আদালতের মন্তব্য, আরও অপেক্ষা করলে ক্ষয়খতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
বিরোধীরা আদালতের এই নির্দেশকে স্বাগত জানিয়েছে। বিরোধী সব দলই পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়ে আসছিল অনেক আগে থেকে। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া শান্তিপূর্ণ ও অবাধ পঞ্চায়েত ভোট সম্ভব নয়। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম রাতে বলেন, আদালতের এই নির্দেশ রাজ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের গালে বড় থাপ্পড়। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, আদালত বিরোধীদের দাবিকে সংগত কারণে মান্যতা দিয়েছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য আদালতের উপর আমাদের আস্থা ছিল। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল আসলে রাজ্য সরকার এবং নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনী ঠোকানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাছে।
শাসকদলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, বিরোধীরা পরিকল্পিত ভাবে দুএকটা ঘটনা ঘটিয়ে আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। ভালোই। কেন্দ্রীয় বাহিনী আসবে, ঘুরবে, বেড়াবে, ঘুমাবে। আর সাধারণ মানুষ তৃণমূল মানুষ তৃণমূলকে ভোট দেবেন। কুণাল আরও বলেন, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করায়। রাজ্য নির্বাচন কমিশন রাজ্য বাহিনী দিয়ে ভোট করে এটা বিরোধীদের জেনে রাথা ভালো।
এর আগে তৃণমূল জমানাতে ২০১৩ সালে মীরা পাণ্ডে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার থাকাকালীন বাহিনীর প্রশ্নে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে তখন পঞ্চায়েত ভোট করাতে চেয়েছিলেন। রাজ্য সরকার তাতে আপত্তি জানায়। কমিশন ও সরকারের বিরোধের জল গড়ায় হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। শেষে সুপ্রিম কোর্টেরপ নির্দেশে ওই বছর কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোট করানো হয়েছিল। অতীতে বাম জমানতেও পঞ্চায়েত ভোটে অনেকবার ব্যাপক হানাহানি হয়েছে। ২০০৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটেরর আগে পরে অন্তত্য ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছিল, ২০০৮সালের ভোটে মৃত্যু হয় ৩০ জনের। ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে তৃণমূল জমানায় পঞ্চায়েত ভোটে যথাক্রমে ৩৯ আবং ৩০ মৃত্যু হয়। এবার মনোনয়ন পর্ব শুরুর দিনে মুর্শিদাবাদে এক কংগ্রেস কর্মী খুন হন। আর বৃহস্পতিবার মনোনয়ন পেশ করার শেষ দিনে ভাঙড়ে মৃত্যু হয়েছে দু জনের। সিপিএমের দাবি, চোপড়াতেও তৃণমূলের হামলায় দুই কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। গুলিতে জখম হয়েছেন বাম কংগ্রেসের আরও কয়েকজন। যদিও মৃত্যুর কথা মানতে চায়নি প্রশাসন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের দাবি, চোপড়ার ঘটনার সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই। আর ভাঙড়ের অশান্তির দায় মুখ্যমন্ত্রী চাপিয়ে দেন আইএসএফের ঘাড়ে।
আরও পড়ুন: Cyclone Biparjoy | সাইক্লোন বিপর্যয়ের আছড়ে পড়া শুরু
আইনি মহলের মতে, মনোনয়ন পর্বে গত সাতদিন ধরে জেলায় জেলায় যে হিংসার ঘটনা ঘটেছে, তাই আদালতকে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। এদিন পঞ্চায়েত মামলা শুনানি চলাকালীন চোপড়ার ঘটনা নিয়ে প্রধান বিচারপতি রাজ্য সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের আইনজীবীকে ভর্ৎসনা করে বলেন, চোপড়ায় এসব কী হচ্ছে। বুধবারই পঞ্চায়েত মামলার রায়ে বলা হয়েছিল, স্পর্শকাতর জেলাগুলিতে কমিশনের কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা উচিত। রায়ে লেখা হয়, নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে কয়েকটি জেলাকে স্পর্শকাতর হিসেবে ঘোষণা করেছে। রাজ্য সরকার এই অংশের পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়ে এদিন আদালতের দ্বারস্থ হয়। কমিশনের তরফে আদালতে জানানো হয়, তারা এখনও পরিস্থিতির মূলায়ন করে উঠতে পারেনি। বস্তুত, গতকাল রাত পর্যন্ত কমিশন রাজ্যের স্পর্শকাতর বুথ হতে পারে চিহ্নিত করতে পারেনি।
এদিন শুনানির প্রথম প্রবে প্রধান বিচারপতি বলেন, তাহলে গোটা রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছি, সেটা ভালো হবে তো? গতকালও কোথাও কোথাও অশান্তি হয়েছে। আজও হচ্ছে এতে কমিশনের উপর মানুষের আস্থা ধাক্কা খাবে। তিনি আরও বলেন, আমরা ফেলে রাখার জন্য নির্দেশ দিইনি, নির্দেশ দিয়েছি তা বাস্তবায়নের জন্য। আমাদের রায় পছন্দ না হলে উচ্চ আদালতে জেতে পারেন। কিন্তু আপনারা যদি আদালতের নির্দেশ কার্যকর না করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেন তাহলে, আমরা চুপ করে বসে থাকব না। এরকম হলে আমি সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেব।
রাজ্যের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় অশান্তির দায় বিরোধী দলগুলির উপর চাপিয়ে দেন। তিনি বলেন, রাজ্যজুড়ে বিরোধীরা অশান্তির সৃষ্টি করছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, পুলিশ পদক্ষেপ করছে না কেন? দীর্ঘ শুনানি শেষে সন্ধ্যায় আদালত রাজ্যে সর্বত্র কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেয়।