১৯৩২ সালে জার্মানিতে ভোট হল। অনেকেই মনে করেছিল সেবারে নাৎসি পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, কিন্তু বাস্তবে তা হল না বরং কমিউনিস্টদের শক্তি খানিক বেড়েছিল। কিন্তু নাৎসি দল কিছু শরিক জোগাড় করে সরকার তৈরি করল। ৩০ জানুয়ারি ১৯৩৩ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে শপথ নিলেন। কিন্তু সেদিনও যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা হিটলারের হাতে বা নাৎসিদের হাতে ছিল না। হিটলার আবার নির্বাচনের দাবি করলেন। ঠিক হল, ৫ মার্চ ১৯৩৩ আবার নির্বাচন হবে। ঠিক তার আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় খবর এল, রাইখস্ট্যাগে আগুন লেগেছে। রাইখস্ট্যাগ হল জার্মানির সংসদ ভবন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হলেন চ্যান্সেলর হিটলার, প্রচার সচিব গোয়েবলস। তাঁরা যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হলেন জার্মানির সব থেকে বড় প্রুশিয়া অঞ্চলের পুলিশমন্ত্রী হেরম্যান গোয়েরিং। ১১.৫০ নাগাদ আগুন নিভল, কিন্তু ততক্ষণে সব পুড়ে ছাই। ২০টা পোড়া মৃতদেহ বার হল। হেরম্যান গোয়েরিং বললেন, এসবই কমিউনিস্টদের কাজ, হিটলার জানালেন দেশজুড়ে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে। জারি হল রাইখস্ট্যাগ ফায়ার ডিক্রি, অনিচ্ছা থাকলেও হিন্ডেনবার্গ তাতে সই করলেন। জার্মানির মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হল, হিটলারের হাতে গিয়ে জমা হল সব ক্ষমতা। ৫ মার্চের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতল নাৎসিরা। প্রথমে কমিউনিস্টদের ধরপাকড় শুরু হল, তারপর কার্ল মার্কস ইহুদি, অতএব এটা হল আসলে ইহুদিদের চক্রান্ত, কাজেই ইহুদিদের ধরপাকড় শুরু হল। এরপর যে কোনও সামান্য বিরোধিতার পরে দরজায় কড়া নাড়া, এল গেস্টাপো, এসএস, নাৎসি বাহিনী। যদিও হিটলারের উত্থানের শুরুয়াতেই ছিল এই ঘৃণা ছড়ানো, হেট স্পিচ, কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে, ইহুদিদের বিরুদ্ধে, গণতান্ত্রিক মানুষজনের বিরুদ্ধে, শিক্ষিত মানুষদের বিরুদ্ধে। মাঝেমধ্যেই তিনি বলতেন দেশ আক্রান্ত, আমাকে মারার চেষ্টা চলছে, বিরোধীরা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। শেষমেশ রাইখস্ট্যাগে আগুন এবং জার্মানিতে গণতন্ত্রের পরিসমাপ্তি। এই ক্রোনোলজি চেনা চেনা লাগছে? চলুন তাহলে সেই আলোচনাতে নেমে পড়া যাক।
আরএসএস-হিন্দু মহাসভা, জনসঙ্ঘ, বিজেপি তাদের পথচলার শুরুতেই আছে এই ঘৃণা। সেও লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, একেবারে প্রকাশ্যে। এ দেশ হিন্দুদের, মুসলমানদের দেশ পাকিস্তান, হিন্দুরাষ্ট্র না মানলে দেশ থেকে বিদেয় হন, মুসলমানরা বাবরের সন্তান, এ দেশ যাদের পুণ্যভূমি নয়, তারা এদেশের নাগরিক নয়, এসব কথা হয় তাদের বইয়ে, নয় ভাষণে, নয় লিফলেটে না হলে সোশ্যাল মিডিয়াতে তারা বলেই চলেছে। এবং দেখুন, এই কথাগুলো নিয়ে তারা আলোচনাও করতে চায়, বিতর্কেও রাজি আছে, প্রকাশ্যেই বলে এবং তা নিয়ে পিছু হটার কোনও লক্ষণও নেই। আপনি বলতেই পারেন, এ তো এক ধরনের মতামত, থাকতেই পারে, আলোচনা হতেই পারে, অসুবিধেটা কোথায়? না, কোনও অসুবিধেই নেই। কিন্তু সমস্যা হল এই কথাগুলো কারা বলছেন? শিক্ষিত, পণ্ডিত, সমাজে প্রতিষ্ঠিতরা বলছেন, বলার সময় এঁদের হাতে পিস্তল বা পাইপগান তো ছেড়েই দিন ছুরি তলোয়ারও থাকছে না। তাহলে? তাহলে চলে যান এরপরের স্তরে। নিরক্ষরতার অন্ধকারে ডুবে থাকা বিশাল কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষজন, বেকারত্ব আর মূল্যবৃদ্ধির চাপে নুয়ে পড়া হতাশ মানুষজন। তাদের কাছে যান, শুনুন এই আপাত নিরামিষ কথাগুলো কীভাবে সেখানে পৌঁছেছে। তাদের সরাসরি ধারণা, তারা প্রতিদিন ভেবেই চলেছে, বলেই চলেছে, মুসলমানরা জনসংখ্যায় নাকি এতটা বেড়েছে যে আর ক’দিন পরে তারাই হিন্দুদের (ব্রাকেটে আমাদের) মাথায় চড়ে বসবে। সেদিন আমাদের মা বোনেদের ইজ্জত থাকবে না, তারা আমাদের ভগবান গোমাতাকে কাটে আর খায়, তাদের আসল দেশ পাকিস্তান, তারা এখানে আছে কেন? প্রত্যেক মুসলমান টেররিস্ট, হিন্দুদের বাঁচতে হলে অস্ত্র ধরতে হবে, দেশের সব সম্পদ থাকা সত্ত্বেও দেশ গরিব ওই মুসলমানদের জন্য ইত্যাদি ইত্যাদি। কারা বলছে এসব কথা? তাদের নাম কাজল হিন্দুস্তানি হতে পারে, নূপুর শর্মা হতে পারে, পাঞ্চজন্য হতে পারে আবার শ্রীকান্ত নিরালা ওরফে মুস্তাক আলি, বিকাশ কুমার ওরফে রাশিদ খান, পুনীত মেরহল্লি, সঞ্জয় জাঠ হতে পারে কিংবা এই বাংলার সুমিত সাউ হতেই পারে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | কর্নাটকে উড়ছে টাকা, ওড়াচ্ছেন মোদিজি
ধরুন কর্নাটকের মুস্তাক আলি, তার সোশ্যাল মিডিয়াতে উগরে দিচ্ছিল বিষ হিন্দুদের বিরুদ্ধে, বিজেপি এমএলএদের বিরুদ্ধে। তার বক্তব্যের স্ক্রিনশট ভাইরাল হচ্ছিল রাজ্যজুড়ে, দেখেছ? এই সংখ্যালঘুদের হয়ে সেকুলারেরা গলা ফাটায়। তো শেষমেষ ঝুলি থেকে বিড়াল বের হল। দেখা গেল, এই মুস্তাক আলি আসলে শ্রীকান্ত নিরেলে, এক আদত হিন্দুসন্তান, মুসলমানদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির জন্য এই কাজ করছিল। ধরুন রশিদ খান, ইনিও সেই সোশ্যাল মিডিয়াতে, এক ছোট্ট ইন্টারভিউতে বললেন, শ্রদ্ধাকে তার বন্ধু ৩৫ টুকরো করেছে, মুড খারাপ হলে ওই রকম নষ্ট চরিত্রের একজন হিন্দু মহিলাকে ৩৬ টুকরোও করে ফেলতেই পারি। ভিডিও ভাইরাল হল। শ্রদ্ধার বয়ফ্রেন্ড যার বিরুদ্ধে শ্রদ্ধাকে খুন করার অভিযোগ সেও মুসলমান, এই রশিদ খানও মুসলমান। মুসলমানরা হিন্দু মেয়েকে টুকরো টুকরো করার কথা বলছে। পরে দেখা গেল, এই রশিদ খানের আসল নাম বিকাশ কুমার, এর নামে চুরি, মারধর, অস্ত্র রাখার অভিযোগ আছে। কিন্তু ততদিনে সে ভিডিও ভাইরাল, এ তথ্য চাপা পড়ে গেছে। ধরুন পাঞ্চজন্য। ইনি কে বা এঁরা কারা জানা নেই, তবে এই পাঞ্চজন্যের টুইট ফলো করেন দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদিজি, স্মৃতি ইরানি। তাহলে অন্তত এটা পরিষ্কার যে এই পাঞ্চজন্য খুব হেলাফেলা করার কেউ নয়। তো এই পাঞ্চজন্যের টুইটে লেখা হল, মুরাদাবাদে এক মুসলমান যুবক, এক হিন্দু মহিলাকে বিয়ে করে এক নির্জন খেতে নিয়ে গিয়ে নিজের বন্ধু সমেত গণধর্ষণ করে। ঘটনায় পুলিশ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। এ টুইট আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। দু’দিন পরে জানা যায়, মুরাদাবাদে অমন কিছুই ঘটেনি, কেউ গ্রেফতারও হয়নি, কোনও ধর্ষণের অভিযোগও নেই। তাতে কী? ওই টুইট দুদিনেই হাজার দশেক যুবককে এই ঘটনার বদলা নেওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছে। পাঞ্চজন্য টুইট মুছেছে, সত্যিটা বেরিয়ে এসেছে কিন্তু ক্ষতি আটকানো যায়নি। এর ফল কোথায় ফলবে?
এই তো কিছুদিন আগে হরিয়ানায় নাসির আর জুনেইদ বলে দুই যুবককে চুরির অভিযোগে গাড়িতে বাঁধা হল, তারপর জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলা হল। আচ্ছা এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া নেই? আছে বইকী। সেই জুনেইদ বা সেই নাসিরের কোনও কিশোর ভাই বা বন্ধু এই ঘটনা থেকে প্ররোচিত হয়ে কিছু একটা করবে, তা কি খুব অস্বাভাবিক? এবং তারও প্রতিক্রিয়ায় আরও বড় দাঙ্গা হবে, সেটাও আমরা জানি। পুনীত কেরহল্লী, কর্নাটকের মানুষ, মাথায় লাল টিকে, ছবি আছে বড় বড় বিজেপি নেতাদের, সঙ্গে পিটিয়ে খুন করল ইদ্রিশ পাশাকে, সে নাকি বেআইনিভাবে পশু কাটত, মাংস বিক্রি করত। কোথা থেকে পুনীত এমন কাজ করার প্রেরণা পেল? কে শেখাল? অযোধ্যাতে মসজিদে নিষিদ্ধ মাংস ছড়িয়ে দেওয়ার, পবিত্র পুস্তক ছিঁড়ে ফেলে রাখার ষড়যন্ত্র করছিল কিছু মানুষ, মহেশ মিশ্রা, প্রত্যুষ কুমার, নীতীশ কুমার, দীপক গৌর, ব্রিজেশ পান্ডে, শত্রুঘ্ন আর বিমল পান্ডে এই অভিযোগে এখন জেলে। কে জোগালো তাদের এই বুদ্ধি? একদিন সকালে উঠে কিছু মানুষ দাঙ্গা করতে নেমে পড়ল? তা তো হয় না। আসলে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে বহু বছর জুড়ে এই আরএসএস-বিজেপি। আজ সেই গাছে ফল ধরছে। সঞ্জয় জাঠের খবর এই সেদিনকার, আগ্রায় এই সঞ্জয় জাঠের নেতৃত্বে ব্রিজেশ ভাদোরিয়া, জীতেন্দ্র কুশওয়াহা, সৌরভ শর্মা আর শানুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা গরু হত্যা করে তা মন্দিরের প্রাঙ্গণে রেখে দিয়ে দাঙ্গা বাঁধানোর প্ল্যান করছিল। পুলিশ জানতে পেরে তাদের গ্রেফতার করে। আচ্ছা তাহলে এটাও তো বলবেন যে পুলিশ তো কাজ করছে। প্রথমত, পুলিশ সবক্ষেত্রে খবর পায় না, পাওয়া সম্ভবও নয়। দ্বিতীয় কথা হল, হ্যাঁ, পুলিশের মধ্যেও তো কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছেন, কাজেই তাঁরা তো সঠিক পদক্ষেপ নেবেন।
কিন্তু পুলিশের অন্য ছবিও আছে, গাজিয়াবাদের এক পুলিশকর্তা গরু পাচারে অভিযুক্ত সাত জনকে গ্রেফতার করে, সাতজনেরই হাঁটুর ঠিক তলায় গুলি লাগা অবস্থায় তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সাতজনেরই গুলি লেগেছে, সাতজনেরই হাঁটুর তলায় গুলি লেগেছে, সাত জনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, এই সমাপতনে কিছুটা আশ্চর্য হয়েই আদালত তদন্তের নির্দেশ দিতে বেরিয়ে আসে, তাদের গ্রেফতার করার পরে হাঁটুর তলায় গুলি করা হয়। এদের একজনের বয়স ১৬, বাকিরা ১৮ কি ১৯। কতটা নৃশংস হলে এই কাজ করা যায়? একজন ১৬ বছরের কিশোরকে গ্রেফতার করে পায়ে গুলি করে দিল পুলিশ? এ কোন জাহান্নমের দিকে চলেছি আমরা? হিন্দু জাগরণ সংঘ মহাসম্মেলন ডেকে হাতে অস্ত্র নিতে বলছে, বিজেপি এমপি নাথুরাম গডসেকে দেশপ্রেমিক বলছেন, যজ্ঞেশ্বর বাবা টিভি সাক্ষাৎকারে হিন্দুরাষ্ট্রের কথা বলছেন। এসবই এক পরিকল্পিত প্রচার, পেছনের চক্রান্ত খুব পরিষ্কার, এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি ধ্বংসের পথে হাঁটব, নাকি এই চক্রান্তকারীদের চক্রান্ত ধ্বংস করার জন্য হাতে হাত মেলাব? সময় নেই, কোনটা করবেন, সিদ্ধান্ত নিন।