স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও দেশের নাগরিক কারা, কারা নয়, তা নিয়ে সংশয়, দোলাচল তৈরি করেছে মোদি সরকার, বলা ভাল আরএসএস–বিজেপি। অমিত শাহ থেকে কাঁথির টাচ মি নট খোকাবাবু মাঝেমধ্যেই বলছেন সিএএ হবেই। এই বাংলায় সেই কোন কাল থেকে রয়েছেন মতুয়ারা, তাঁরা এখানেই স্কুলে পড়াশুনো করছেন, বিভিন্ন দফতরে চাকরি করছেন, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধে পাচ্ছেন, ভোট দিচ্ছেন, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে, নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁদের ধর্মাচরণে কোনও বাধা নেই। বলা হচ্ছে, তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্যই সিএএ লাগু করা হবে, হবেই। মানে? মতুয়ারা বিদেশি? তাঁরা নাগরিক নন? তাঁদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, পাসপোর্ট, সরকারি চাকরি সব মিথ্যে? দিলু ঘোষ বা টাচ মি নট খোকাবাবু তাঁদের নাগরিকত্ব দেবেন? হ্যাঁ এটাই আপাতত বিশুদ্ধ ১০০% ধোঁকাবাজি, যা আরএসএস-বিজেপি চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯-এ প্রায় আলোচনা ছাড়াই এই বিল পাস করানোর পরে তিন তিনটে বছর কেটে গেল, আইন এখনও কার্যকর করা হয়নি, কার্যকর করতে গেলে যে রুল অফ প্রসিডিওর তৈরি করতে হয়, তা এখনও তৈরি করা হয়নি। টাচ মি নট খোকাবাবু, দিলীপ ঘোষ বা অমিত শাহ বা দেশের প্রধান সেবক একটা কথাও বলছেন না। উলটে দেখা গেল গুজরাটের আনন্দ আর মেহসানা জেলায় ঠিক নির্বাচনের আগে কয়েকজন হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং ক্রিস্টান শরণার্থীকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কোন আইনে? ১৯৫৫-এর নাগরিকত্ব আইনের ৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী সার্টিফিকেট অফ ন্যাচারালাইজেশন দেওয়া হবে। তার মানে ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইন দিয়েই শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া যায়। তাহলে এই সিএএ ২০১৯ কেন আনা হল? আসলে ভয় দেখানো হচ্ছে, সিএএ-র নাম করে দেশের সংখ্যালঘুদের চমকানো হচ্ছে। স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে দেশের ২৮/২৯ কোটি মানুষ আতঙ্কিত, ভয়ে আছে, ভয় পাচ্ছে কারণ তাদের অতীত তাদের সামনে এসে হাজির। তাদের কি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হবে? তাদের কি ঘাড় ধরে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হবে? তাদের কাছে যে কাগজ আছে তাই কি যথেষ্ট? নাকি এই কাগজগুলো থাকার পরেও তারা থাকবে তালিকার বাইরে? হিন্দু জনসংখ্যার কাছে কি কোনও অপশন ছিল? আর কোনও জায়গা ছিল যাওয়ার, তাদের তো ভারত ছেড়ে কোথাও যাওয়ার উপায়ই ছিল না। কিন্তু যাদের কাছে ছিল? যারা তার পরেও গেল না, গেল না কারণ তারা জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাস করেনি, বিশ্বাস করেছে যে হিন্দু মুসলমান একসঙ্গেই থাকা যায়, থাকতে হয়। তারা নিজেদের ভিটে ছেড়ে যাওয়ার কথাই ভাবেনি। ভাবেনি কারণ আমরা ভারতবাসীরা বলেছিলাম আমরা অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ গড়ে তুলব, সেকুলার স্টেট। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। আমরা সবাই বলেছিলাম। তারা বিশ্বাস করেছিল। আমরা কি ভুল বলেছিলাম? আমরা কি মিথ্যে বলেছিলাম?
এতদিন পর সেই কথাগুলো, সেই পুরনো দলিল দস্তাবেজ আমাদের ঘেঁটে দেখতে হচ্ছে। লজ্জা। এতদিন পর সেই প্রশ্ন আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। লজ্জা। এতদিন পর আমাদের দেশের ২৮/২৯ কোটি মানুষ আমার সহনাগরিক কি না সেই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। লজ্জা। তবুও আর এক বার শেষবারের মতো এই বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়ে যাক। শেষবারের মতো ওই বর্বর লোকগুলোর মুখের ওপর পুরনো সত্যিটা আবার বলে দেওয়া যাক।
মনে আছে জামাইতুল উলেমা এ হিন্দ, যারা দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করেছিল, যারা কায়েদে আজম জিন্নাহ র বিরোধিতা করেছিল। তাঁরা বলেছিলেন যে ভারত ভাগ করা যাবে না, বলেছিলেন আমরা একসঙ্গেই থাকব। এখন আজ, ৭২ বছর পর সেই সংগঠনের ভেতর থেকে প্রশ্ন উঠছে, আমরা একসঙ্গে থাকতে পারব তো, আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হবে না তো? মৌলানা মহমুদ আদনি এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, প্রাণ যায় যাক এবার তো রাস্তাতেই নামতে হবে, প্রাণ গেলেও এ লড়াইয়ের শেষ দেখে ছাড়ব। কখন মানুষ প্রাণ দেওয়ার কথা বলে? শেষ ভরসাটাও চলে গেলে? দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে? কী এমন হল যে তাদের ভরসা চলে যাচ্ছে? তাদের পিঠ ঠেকে যাচ্ছে দেওয়ালে? কেন আমার দেশের সহনাগরিক মুসলমানরা এরকম ভয় পাচ্ছেন? রাজনীতি তাঁদের বিরুদ্ধে? প্রশাসন? বিচার বিভাগ? তাহলে কি আমাদের অজান্তেই ঘটে গেছে কোনও নিঃশব্দ বিপ্লব। সংবিধান কি তাহলে আর ধর্ম নিরপেক্ষ নয়? সরকার কি আর ধর্মনিরপেক্ষ নয়? জামাতুল উলেমার সমর্থকরা বিক্ষোভ প্রদর্শনে নামলে তাদের বলা হচ্ছে আপনারা হিন্দু-বিরোধী, দেশ-বিরোধী। রাস্তায় না নামলে ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে আমরা বিপন্ন। কোথায় যাবে তারা? আমার দেশের ২০% মানুষ বিপন্ন স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে? মুসলমানদের পোশাক নিয়ে ইঙ্গিত করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, পুলিশ অফিসার হুমকি দিচ্ছে রাস্তায় নামলে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেব। আমরা কোন দিকে দেখব? কাশ্মীর জ্বলছে এক ইস্যুতে, অসম তার ভাষা সংস্কৃতির আন্দোলনে। এদিকে পাঞ্জাব, বাংলার মানুষ চিন্তিত কী হবে এনআরসিতে? কী হবে এনপিআর-এ? কারণ তাদের ক্ষত তো সবথেকে বেশি। ক’জন গুজরাতিকে তার মাতৃভূমি ছাড়তে হয়েছে? সব থেকে বিপন্ন বাংলা, এখানেই সব থেকে বেশি বিষ ছড়াচ্ছে। আন্দামানে সেলুলার জেলে চলে যান, কালাপানির সাজা কারা পেয়েছিল, কারা শহীদ হয়েছিল? তালিকা দেখুন। সে তালিকার ৭০ শতাংশ বাঙালি, হ্যাঁ ৭০%, সেই বাঙালির দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলছে কারা? যারা স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন গান্ধীর হত্যাকারীদের সঙ্গে, তারা আজ ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করছে।
দেশের সংখ্যালঘু মানুষজন আজ যে সংশয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে, যে বিপন্নতা বোধ তাঁদের ভেতরে কাজ করছে, আসুন তাঁদের দিকে চোখ ফেরাই। আম্বেদকর সংবিধান সভার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, রাজেন্দ্র প্রসাদ সেই বিবরণী লিখছিলেন, প্যাটেল, নেহরু, শ্যামাপ্রসাদ, আবুল কালাম আজাদরা ছিলেন, সদস্য ২৯৯ জন ছিলেন। ২৮৪ জন এই খসড়ায় সই করেছিলেন তার মধ্যে ৩০ জন মুসলমান, মহম্মদ ইসমাইল সাদিব, কে টি এন আহমদ ইব্রাহিম, মেহেবুব আলি বেগ, মাদ্রাজ থেকে বোম্বে থেকে আবদুল কাদের মহম্মদ শেখ, আফতাব আহমদ খান ছিলেন, বাংলা থেকে জশুদ্দিন আহমদ, নজরুদ্দিন আহমদ, আব্দুল আলিম গজনভি, রাদিভ এহসান, আবদুল হামিদ এই ৫ জন ছিলেন। সংযুক্ত প্রান্ত মানে ইউপি এমপি মিলিয়ে যে অঞ্চল সেখান থেকে বেগম এজাজ রসুল, হায়দার হুসেন, হজরত মোহানি, মহ ইসমাইল খান, রফি আহমদ কিদোয়াই, মহ হাফিজুর রহমানের মতো স্কলাররাও ছিলেন। সংবিধান কেবল হিন্দুরা লেখেননি। বিহার থেকে ইমাম হোসেন, সৈয়দ জাফর ইসলাম, লুৎফুর রহমান মহ তাহেব, তাজমুল হোসেন, অসম থেকে আবদুর রউফের মতো প্রাজ্ঞ মানুষ ছিলেন, জম্মু-কাশ্মীর থেকে শেখ আবদুল্লাও ছিলেন। এই দেশের সংবিধান বানানোর ইতিহাসে এঁরাও ছিলেন। একসঙ্গে দেখেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রর স্বপ্ন। তাঁরা সমস্বরে বারবার বলেছিলেন যে দেশ তার সংবিধানকে নিয়ে চলবে, ধর্ম নিয়ে নয়। কিন্তু আজ সেই দেশ ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইনও এনে ফেলেছে।
কারা রাস্তায়? কারা সংশয়ে? কাদের জামা কাপড় দেখে প্রধানমন্ত্রী চিনে ফেলছেন? মুসলমানরা। হ্যাঁ এতদিন মুসলমানদের বিক্ষোভের অংশ হিসেবেই দেখা যেত। এবার ছবিটা বদলে গেছে, তাঁরাই বর্শামুখ, তাঁরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের হাতে জাতীয় পতাকা, তাঁরাই সংবিধান পড়ছেন, তাঁরাই চিৎকার করে বলেছেন, প্রয়োজনে আবারও বলবেন ‘সভি কা খুন শামিল হ্যায় ইস মিট্টি মে, কিসিকা বাপকা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যায়।’ সব্বার রক্তে রাঙা এই দেশের মাটি, কারও বাপের সম্পত্তি নয়। মেইন স্ট্রিম মুভমেন্ট-এ এই প্রথম তাঁরা একদম সামনের সারিতে।
ঠিক এই সময়েই রাজনীতির কারবারিরা আবার সরাসরি সক্রিয়, আরও বড় মেরুকরণের দিকে তারা, ছাঁকনিতে ছেঁকে নিয়ে ডিটেনশন সেন্টারে ফেলে রাখা কিংবা বাইরে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। আরএসএস-এর সংঘচালক তো বলেই দিয়েছেন ১৩০ কোটিই হিন্দু। তারা হিন্দু আচরণ নিয়েই থাকবে। অন্তত দু’ জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বলেই দিয়েছেন হিন্দুদের তো আর রাষ্ট্র নেই তাই… তাই কি? সংবিধানের শপথ নিয়ে সংবিধানকেই শেষ করার খেলা?
একবার শাসক দলের ছবিটা দেখুন, ৩০৩ জন সাংসদ। ৩০৩ জনের একজনও মুসলমান নয়। দেশের সংবিধান সভায় ৩০ জন ছিলেন, দেশের শাসক দলে ১ জন সাংসদ নেই। দেশের বিরাট এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, বিজেপি একজনকে টিকিটই দেয়নি, জেতার প্রশ্নই নেই। মানে ইউপিতে শাসকদলে একজনও এমএলএ নেই যিনি ধর্মে মুসলমান। দেশের শাসকদলের রাজনৈতিক ভাবে মুসলমানদের দরকার নেই। পরিষ্কার, দরকার নেই। কেবলমাত্র গরিষ্ঠ হিন্দুদের নিয়েই তারা দেশ চালাবে। যদিও দেশ চালানোর জন্য যে সংবিধান রচনা হয়েছিল সেই সংবিধান সভায় ৩০ জন মুসলমান ছিলেন। এবার সেই মুসলমান সম্প্রদায় যদি নিজেদের অসুরক্ষিত মনে করে, সংশয়ে ভোগে তাহলে কি সেটা একেবারেই অমুলক? আবুল কালাম আজাদ ১৯৪০-এ কংগ্রেস দলের সভাপতি, তার ভাষণে বার বার পাওয়া যাচ্ছে যে ভারতবর্ষে মুসলমানদের অস্ত্বিত্ব কেবল সংখ্যালঘু হিসেবে থাকতেই পারে না, তারা দেশের মূল স্রোতের অভিন্ন অঙ্গ, তিনি বলছেন যে সমুদায় হিসেবে মুসলমানরা এখানেই সুরক্ষিত, জিন্নাহর সঙ্গে নয়।
এই বাংলাতেও এক প্রোমোটার গর্বের সঙ্গে জানাচ্ছে যে এই কমপ্লেক্স-এ কোনও মুসলমান নেই, তিনি মুসলমানকে ফ্ল্যাট বিক্রি করেন না। এই বাংলায় মুসলমান অধ্যাপক কলকাতার মতো শহরে ভাড়া বাড়ি পান না। কী হয়ে গেল আমাদের? ৪৭ থেকে আমরা এগিয়েছিলাম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান নিয়ে, এগিয়েছিলাম আরও উন্নত দিন আনার জন্য, কোথায় কোন বাঁকে ভুল পথে নেমে পড়লাম আমরা। বিজেপি সরকার তো একটা বিল পাস করিয়েছে, তারা তো তাঁদের ঘোষণা মতোই এগোচ্ছে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার দিকে। কিন্তু আমরা? বৃহত্তর সমাজ, উদার তার্কিক ভারতীয়? Argumentative Indians? কোথায়? রবি ঠাকুর আমাদেরই রাজ্যে রাস্তায় নেমে রাখি পরালেন, সম্প্রীতির কথা বললেন, বিদ্যাসাগর ধর্মের ওপরে জ্ঞান, শিক্ষাকে স্থান দিলেন, রামমোহন এই মাটিতে দাঁড়িয়েই হিন্দুধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়লেন, এই ভারতেই বিবেকানন্দ বললেন, “I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all religions as true. I am proud to belong to a nation which has sheltered the persecuted and the refugees of all religions and all nations of the earth.” সেখানে আমার দেশের ১৮/২০ কোটি মানুষ নিজেদের অসুরক্ষিত মনে করছেন, সংশয়ে আছেন, যদিও তাঁদের ৩০ জন আমার দেশের সংবিধান তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন।
তাই যতবার টাচ মি নট খোকাবাবু হুঙ্কার দেবে, অমিত শাহ চোখ রাঙাবে ততবার বলব, আজকের লড়াইটা, এই সিএএ, এনআরসির বিরুদ্ধে লড়াইটা, একটা বিলের বিরুদ্ধে, একটা আইনের বিরুদ্ধে নয়, এই লড়াইটা আমাদের সংবিধানকে রক্ষা করার লড়াই। মানুষের মতো করে বাঁচবার লড়াই।