শিকার দেখেছেন? এমনিতে আর দেখার সুযোগই বা কোথায়? আগেকার দিনে রাজারাজড়ারা কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে শিকারে যেত, সঙ্গে লোকলস্কর, সঙ্গীসাথি, ইয়ারদোস্ত, নর্তকী, বাবুর্চি। শিকার কম ফুর্তি বেশি। তারপর একরাতে শোনা যেত রাজা বাঘ মেরেছেন, পরদিন সকালে সামনে বাঘ, পেছনে বন্দুক হাতে রাজাসাহেব। রাতে চোস্ত শিকারি কালে খাঁ মেরেছে বাঘ, এক বল্লমের ঘায়ে বাঘ মাটিতে, সক্কালবেলায় এই বাঘের সামনে রাজাসাহেব। বাঘের গায়ে বল্লমের আঘাত, ওঁর কাঁধে বন্দুক। রাজাবাবুর জয়জয়কার। কালে খাঁ বাড়ি ফিরেছে ১০০ টাকা নিয়ে। এখন তেমন শিকার তো দেখা যায় না, ওই অ্যানিম্যাল প্লানেটে সিংহ বা চিতা শিকার করছে হরিণ, নেকড়ে শিকার করছে হরিণের বাচ্চা, এসব দেখা যায়। সোজাসাপ্টা বিষয়, আগে শিকারকে দেখা, একটু দলছুটকে নজরে রাখা, তারপর একটা ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। আদিম মানুষ বন্যজন্তু শিকার করত, চারিধার থেকে ঘিরে, বেশ একটা পরিকল্পনা থাকত, তারপর তাকে মারা, পোড়ানো, খাওয়া। নিত্যদিন এই জীবজগতে শিকার চলছে, একজন অন্যজনকে খায়, ব্যাং পোকাকে, সাপ ব্যাংকে, হরিণকে চিতা, কিন্তু দুনিয়াজোড়া এই বিরাট শিকারের ছবিতে এক্কেবারে আলাদা হল মাকড়সা। পোকার যাতায়াতের পথ, হাওয়ার দিক, খুঁটি বাঁধার মতো জায়গা, এতকিছু বিচার করে এ জাল বাঁধে, তারপর চুপ করে বসে থাকে শিকার ধরার জন্য। কী অপূর্ব সেই জাল, কী অদ্ভুত দক্ষতায় তৈরি সে জাল তা দেখার মতো। ওরা বাকি জীবগোষ্ঠীর থেকে আলাদা। সহজে দৃশ্যমান জীবজন্তুর মধ্যে এমন পরিকল্পনা দেখা যায় না। আজ হঠাৎ কেন এই মাকড়সার গল্প? বলছি বলছি। তার আগে গণতন্ত্র নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। দুনিয়াজোড়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় নির্বাচন, নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের পছন্দের এক রাজনৈতিক দল, বা দলের প্রতিনিধিকে মানুষ বেছে নেন। এক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারাই দেশের নীতি নির্ধারণ করে, কোথায়, কোন খাতে কত টাকা কীভাবে খরচ হবে, কোন দিকে এগোবে দেশ, দেশের মানুষ কীভাবে আরেকটু বেটার লাইফ, ভাল জীবনের স্বাদ পায়, তার ব্যবস্থা ইত্যাদি করে। বাই দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। আবার এই নির্বাচনের সময় দাদাগিরি হয়, বুথ জ্যাম হয়, জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা চলে। ট্রাম্প বা বলসোনারোর মতো কেউ কেউ তো হেরেও হার স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু দেখেছি এসবে কাজ হয় না, মানুষ ইন্দিরা গান্ধীকে হারিয়ে দেয়, সিপিএম, কংগ্রেস, সমাজবাদী দল, ডিএমকে, এডিএমকে-কে হারিয়ে দেয়। তৃণমূল থেকে অকালি দল থেকে বিজেপি সবাই হেরেছে, অতীত ইতিহাস তাই বলে। নরসিমহা রাও হেরেছেন, অটল বিহারী বাজপেয়ীও হেরেছেন। কিন্তু ২০১৬-১৭ থেকে নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহ মিলে এক নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি করেছেন, যার তুলনা একমাত্র ওই মাকড়সার জালের সঙ্গেই করা যায়। মানে একধারে আরএসএস যারা সমাজ আর ধর্মকে নিয়ে এক ককটেল তৈরি করেছে, অন্যদিকে বিজেপি এক রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে। আর দুইয়ের মিশ্রণে জন্ম নিয়েছে এক ব্যবস্থা যার কাছে গণতন্ত্র অসহায়, মাকড়সার জালে পড়ার পরে যতটা অসহায় থাকে কীটপতঙ্গ। একটা প্রশ্ন তো উঠতেই পারে, তাঁরা এটা কেন করছেন? উদ্দেশ্য কি দেশের লোকজনের গণতন্ত্র কেড়ে, মানুষের অধিকার কেড়ে তাদের দাস আনিয়ে রাখা? না তাও নয়। বিজেপি–আরএসএস-এর বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করেন, তাঁরা এটা করছেন দেশের মানুষের উন্নতির জন্য, পুত্র কামনায় কন্যাসন্তানকে বলি দেয় যে মানুষ, সেও বিশ্বাস করে এর ফলেই তার পুত্রসন্তান হবে, খানিকটা সেইরকম বিশ্বাস। গণতান্ত্রিক সমস্ত ধ্যানধারণাকে সরিয়ে রেখেই দেশের উন্নয়ন সম্ভব, এটা আরএসএস–বিজেপির বিশ্বাস। যতদিন তারা পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, ততদিন এই কাজ তারা করেনি, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরেই তারা এই কাজে নেমেছে। এখন সেই ব্যবস্থা এক বিরাট কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, তার ডালপালা নিয়ে এক দুর্ভেদ্য ব্যবস্থা, যা আপাতভাবে সংবিধানকে একপাশে রেখে সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতি নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগিয়ে চলেছে, যার সামনে সত্যিই অসহায় অন্য যে কোনও দল। আসুন সেই বিরাট মাকড়সার জালের গঠন আর বিস্তৃতি নিয়ে আলোচনা করা যাক। ধরুন একটা রাজ্য যেখানে নির্বাচন হবে বছর তিন পরে, সেই রাজ্যের সমস্ত নির্বাচনী তথ্য আছে বিজেপি দপ্তরে, সেখানে সেই রাজ্যের জন্য আলাদা সেল আছে। বিরোধী কোন নেতা কতটা প্রভাবশালী, কোন দুর্নীতির সঙ্গে কতটা যুক্ত, তার ডিটেল হিসেব আছে। কোন জাতের মানুষ কত শতাংশ, স্থানীয় দাবি দাওয়ার হিসেব, সব রাখা আছে। সেখানকার শিল্পপতিদের রাজনৈতিক ইনক্লাইনেশন, ঝুঁকাও, সমর্থন কোনদিকে তার তালিকা আছে। সেখানকার প্রত্যেক সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিকদের কুষ্ঠি-ঠিকুজি রাখা আছে। সংখ্যালঘু মানুষজনের বসবাস কোথায়, কোথায় কমিউনাল টেনশন সহজেই তৈরি করা যায়, তার তালিকা আছে। ওই রাজ্যের নির্বাচনের পর থেকেই এই সব তথ্য জোগাড় করা, তার অ্যানালিসিস করার জন্য ৫০/৬০/৭০ হাজার টাকা মাইনের মানুষজন আছেন। নির্বাচনের বছর তিন আগে শুরু হবে বিরোধী দল ভাঙানো, চলে আসুন সদলবলে নাহলে ইডি যাবে, সিবিআই যাবে, ইনকাম ট্যাক্স যাবে। কাঁথির টাচ মি নট খোকাবাবু চলে গেলেন, সবাই তো যাবেন না, ইডি এল, জেলে এলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ববি হাকিম, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারসহ প্রত্যেকে ইডির জেরার সামনে, যে মাসে সেই ডাক আসে না, সেই মাস নাকি মল মাস। তার মানে প্রথম ঘুঁটি চালা হল। এরপর শিল্পপতি, আরে ভাই ব্যবসাও করবেন আবার বিরোধীদের টাকা দেবেন? তাই হয় নাকি? ইনকাম ট্যাক্স, ইডির হানা প্রতিদিন, ব্যবসার ফাঁকফোকর তো আছেই। দ্বিতীয় ঘুঁটি। তালমিলিয়ে মিডিয়ার প্রচার, এর ব্যাংকে ৪০ কোটি, ওর নাকি ৬ খানা বাড়ি, তার নাকি দুবাইয়ে ফ্ল্যাট। এসব প্রচার আসে, চলে যায়, জবাবদিহি করার কিচ্ছু নেই, সবটাই কোট আনকোট পরিচিত মহল, নাম জানাতে অনিচ্ছুক এক নেতা বা পুলিশ সুত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে দু’ একটা জায়গায় দাঙ্গা, যে দাঙ্গায় খবর হবে বেশি, মানুষ মরবে কম, উত্তেজনা ছড়াবে ভরপুর। ওদিকে পরের পর আসবে ঐতিহাসিক বা দেশপ্রেমিক ছবির নামে মিথ্যে আজগুবি প্রচার, ব্রহ্মাস্ত্র থেকে গুমনামি থেকে সার্জিকাল স্ট্রাইক। নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে পরিকল্পনার বন্যা বইবে। মাস দুই আগে থেকে মন্ত্রীরা যেতে শুরু করবেন, দিন ১৫ আগে প্রধানমন্ত্রী। লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প ঘোষণার পরে তিনি ফেরার দুই কি তিনদিনের মধ্যে নির্বাচনের দিন ঘোষণা। দিন ঘোষণার দিনেই, কি আগের দিনেই নির্বাচনী সমীক্ষা, জিতছে, জিতছে, বিজেপি জিতছে। সাট্টা বাজারের খবর, বিজেপি জিতছে, এসব হেডলাইনের মধ্যেই রাহুল গান্ধীর কাছে মিডিয়া জানতে চাইবে স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেস কেন কোনও কাজ করেনি, জওহরলাল নেহরু কেন কাশ্মীরের অর্ধেক ছেড়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানকে। মজার ব্যাপার, তাই না? তর্ক কী নিয়ে? ধরেই নেওয়া হল নেহরু কাশ্মীরের অর্ধেক ছেড়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানকে, তাই তর্ক হচ্ছে কেন ছেড়ে দিলেন? হাস্যকর আলোচনা কিন্তু তাই চলবে। আছে তো মিডিয়ার নাম করে কিছু পেটোয়া মানুষ। ক’জন খবর রাখেন, একদা কংগ্রেস, পরবর্তীতে বিজেপি সন্ময় ব্যানার্জী, কোন সুদুর কোঙ্কন রেলওয়েজ-এর ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেকটর, প্রতিটা মিটিং যাওয়ার হোটেল ভাড়া, বিমান ভাড়া, খাওয়াদাওয়া ছাড়াও ১৫ হাজার নগদ টাকা, হ্যাঁ প্রতিটা মিটিংয়ে এই বাংলা থেকে মুম্বই তিনি যান, কেন? তিনি রেল বিশেষজ্ঞ? তিনি প্রশাসনিক কাজে পটু? না, নিয়ম করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে গালাগাল করাটাই যোগ্যতার মাপকাঠি? এরপরে ভোট এলে, ভোটের মধ্যেই দু’ হাতে টাকা বিলোনো চলবে। পোস্টার, বিজ্ঞাপন, র্যালিতে কোটি কোটি টাকা খরচ। একই ফর্মুলা রাজ্যে রাজ্যে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রত্যেক অঙ্গ, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে আরএসএস–বিজেপির নির্বাচন যন্ত্র এক বিশাল মাকড়সার জাল, যা বুঝতে বুঝতেই নির্বাচন পার। নির্বাচনে জয় বিজেপির হলে তা মোদি–শাহের জয়, উন্নয়নের জয়, বিকাশের জয়। বিজেপি আরএসএস হারলে মোদিজির ভাষায় রেবড়ি কালচার, মানুষের হাতে কাঁচা টাকা দিয়ে, বিভিন্ন খাতে টাকা দিয়ে জিতে গেল মমতা, জিতে গেল টিআরএস বা ডিএমকে বা জগন রেড্ডির দল। মিডিয়াতে তা নিয়ে আলোচনা চলবে, এই যে কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, রূপশ্রীতে টাকা খরচ, তা না করে শিল্প করলে কেমন হত? সেটাই কি গড়ে দিতে পারত না সোনার বাংলা? পুরো আলোচনা জুড়ে চিৎকার, চিল চিৎকার, উপসংহারে বলা হল আগামিকালের আলোচনা বারবার রাস্তা কেন ভেঙে যায় এ রাজ্যে, তার জন্য কে দায়ী। একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন, রাষ্ট্রের প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া আর বিপুল অর্থবল নিয়ে কীভাবে গণতন্ত্রের গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো করে যাচ্ছে এই আরএসএস–বিজেপি। বুঝতে পারবেন কতবড় আর মজবুত সেই মাকড়সার জাল। কিন্তু সেই জালও কি দুর্ভেদ্য? এই ব্যবস্থাই কি চিরটা কাল থেকে যাবে? না থাকে না, ইতিহাস বলছে থাকে না, সভ্যতার চাকা পেছনে ঘোরাটা সাময়িক, সে চাকা আবার সামনের দিকে ঘুরবেই। কিন্তু আপাতত এটাই অবস্থা, তার নির্লজ্জতম উদাহরণ আমাদের সামনে, হিমাচল প্রদেশে বিজেপি রাজ্য সহসভাপতি, প্রাক্তন বিজেপি রাজ্যসভা সদস্য কৃপাল পারমার টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসেবেই ভোটে দাঁড়িয়েছেন, তাঁকে ফোন করছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, হ্যাঁ নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী, বলছেন, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। ভাবাও যায়, একজন প্রধানমন্ত্রী দেশের গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণাকে এভাবে ভাঙতে পারেন? কতটা ডেসপারেট হয়ে উঠলে এই কাজ করা সম্ভব? কিন্তু আরও বড় প্রশ্ন হল, ওই যে অত্ত বড় এক নির্বাচনী ব্যবস্থা, এক জায়েন্ট কর্পোরেট হাতিয়ার, সেখানে কি চিড় ধরেছে? মাকড়সার জাল কি ছিঁড়ছে? মাকড়সা এত বিচলিত কেন?