দু’ দশক আগে এক সাধারণ রাজ্য সরকারি কর্মী নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর নারায়ণী সেনা বলে এক ব্যাপার আছে। অবশ্য এমনি গেলে লুঙ্গি আর ফতুয়াতেই ওঁকে দেখা যায়, তিনি নগেন্দ্র রায়, তিনিই অনন্ত মহারাজ। তিনি এই বাংলা থেকে বিজেপির নির্বাচিত রাজ্যসভা সদস্য। শপথ নিলেন গতকাল এবং শপথের পরেই জানালেন, বাংলা থেকে আলাদা গ্রেটার কোচবিহার তাঁর অনেকদিনের দাবি, তিনি গ্রেটার কোচবিহার চান। মানে আবার বাংলা ভাগ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি জেলার খানিকটা, আলিপুরদুয়ারের খানিকটা সব মিলিয়ে এক গ্রেটার কোচবিহার তিনি চান। এমন নয় যে তিনি বহুকাল আগে কিছু বলতেন, সে তো তৃণমূলের দোলা সেন বা পূর্ণেন্দু বসুও একসময় অস্ত্র হাতে রাষ্ট্র দখল করার কথা বলেছেন, পরে সে পথ থেকে সরে আপাতত তৃণমূল। না, তেমন নয়, উনি শপথ নিলেন রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে, বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের জানালেন উনি গ্রেটার কোচবিহার চান, বাংলাকে ভাগ করতে চান। সেই নতুন অংশের তিনি রাজা আর তাঁর শাসন ব্যবস্থায় থাকবে তাঁর নারায়ণী সেনা। ধূপগুড়িতে নির্বাচন হবে, সেখানে উনি যাবেন, এই বাংলাভাগের বিষ ছড়াবেন, দক্ষিণে কাঁথির খোকাবাবু বলবেন অখণ্ড বাংলার কথা, তারপর এই বিষ জমে একদিন জাতিদাঙ্গা হবে, ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই হবে, কিন্তু সেদিন চুপ করে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। সেটাই বিষয় আজকে, বিজেপি নতুন করে বাংলাকে দু’ টুকরো করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
কে এই নগেন্দ্র রায়? তিনি কীভাবে রাজা হলেন? ভারতবর্ষে কোচবিহার অন্তর্ভুক্তি দিবসে সে কী আয়োজন, হাজার দশ বারো মানুষ, তাদের মধ্যে কিছু লোকজন সাদা ধুতি জামা গোঁজা, হাতে লাঠি, মহারাজ সিংহাসনে বসে, পাশে অস্ত্র হাতে প্রহরী। মানুষজন আসছেন, তাঁদের হাতে রাজার জন্য নজরানা। হ্যাঁ, এসব হয়, এই একবিংশ শতাব্দীতে এক পাগল বলে তাঁর নারায়ণী সেনা আছে এবং সে বাংলাকে টুকরো করতে চায়। যাকে জেলে পোরা উচিত সে আজকে রাজ্যসভার সদস্য। যে যায় তার হাতে একটা দুটো বই ধরান, তাতে নাকি গ্রেটার কোচবিহারের ইতিহাস রয়েছে, নারায়ণী সেনার জন ইতিহাস আছে। মাত্র ক’দিন আগে তৃণমূলের কিছু অত্যুৎসাহীরা ওঁকে মমতার পাবলিক র্যালিতে এনে হাজির করেছিল, মমতার নির্দেশেই তাঁকে একটা কথাও বলতে দেওয়া হয়নি। তিনি মঞ্চ থেকে নেমে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে “আমাদের কোচবিহারকে রিফর্মেশন করতে চাই। আপনারাই বলুন কোচবিহার কোথায় আর ওয়েস্ট বেঙ্গল কোথায়? কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে নয়। কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের বাইরে। কোচবিহার আলাদা। আমার কাছে প্রমাণ আছে। সরকারকে করতে হবে। ভারত সরকার করতে চাইছে।”
আরও পড়ুন: Aajke | এই বাংলায় ২০২৪-এর নির্বাচনে বিজেপি ক্রমশ পিছচ্ছে
বিজেপির দলবদলু শুভেন্দু থেকে যাবতীয় বড় মেজ, সেজ ছোট নেতাদের জিজ্ঞেস করতে হবে, আপনারা কি আবার বাংলাকে টুকরো করতে চান? অনেক কষ্টে পাহাড় শান্ত হয়েছে, সেখানে অশান্তি নেই। কিন্তু গু-গোবর না থাকলে কিছু পোকা বাঁচতে পারে না, অশান্তি না হলে বিজেপি বাড়তে পারে না। পাহাড়ের অশান্তি থেমেছে, এই নতুন স্বঘোষিত রাজাকে দিয়ে নতুন করে উত্তরবঙ্গে আগুন লাগাতে চায় বিজেপি। আর এই আগুনেই সেঁকে নিতে চায় তাদের নির্বাচনের রুটি। কোনও দায় নেই, দায়িত্ব নেই, পরে কী হবে তা নিয়ে ভাবনা নেই। সাধারণ মানুষ মরবে? মরুক, বাড়ি জ্বলবে? জ্বলুক। ওঁদের উত্তরবঙ্গে ক’টা আসন চাই, হিন্দু হৃদয়সম্রাট প্রধানমন্ত্রী হবেন, ব্যস। এই রাজনীতিই আমরা রথযাত্রার সময়ে দেখেছি, একই রাজনীতি আমরা গুজরাতের জঘন্য দাঙ্গার সময় দেখেছি। এই রাজনীতি আমরা উত্তরপ্রদেশে দেখছি, মণিপুরে দেখছি, হরিয়ানায় দেখছি। একই রাজনীতি, ভোটের জন্য, নির্বাচনের একটা আসনের জন্য যা যা দরকার সব করতে পারে বিজেপি, তাদের কাছে নৈতিকতা, অনৈতিকতা কোনও বিষয়ই নয়। পাহাড়ে চেষ্টা করে হেরে গিয়ে এবার উত্তরবঙ্গকে বাংলা থেকে আলাদা করার চক্রান্তে নেমেছে বিজেপি। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, বিজেপির নতুন রাজ্যসভা সদস্য বাংলার থেকে উত্তরবঙ্গের এক বিরাট অংশ ভেঙে নতুন রাজ্য গ্রেটার কোচবিহার গড়তে চান। আপনারা কি চান আবার বাংলাকে টুকরো করা হোক? শুনুন মানুষজন কী বলছে।
আমাদের বাংলাকে টুকরো করার বহু চেষ্টা বহুবার হয়েছে, কার্জন করেছেন পারেননি, কিন্তু স্বাধীনতার বিনিময়ে বাংলা ভাগ হয়েছিল। সে ছিন্নমূলের ইতিহাস আমরা জানি, সে উদ্বাস্তু জীবনের কদর্য ইতিহাস আমাদের জানা আছে। সেই দগদগে ঘা-কে আমরা ভুলতে চাই। কিন্তু আবার নতুন চক্রান্ত শুরু হয়েছে, আবার বাংলাকে টুকরো করার চক্রান্ত, এবার সেই চক্রান্তের নায়কেরা এই বাংলার, তাদের প্রভু মোদি–শাহের পদতলে বাংলার টুকরোকে নজরানা দিতে চায়। আমরা তা হতে দেব না, পাহাড় থেকে সমুদ্র, বাংলার মানুষজন আবার পথে নামুন, আবার নতুন করে রাখিবন্ধন হোক। আমরা আমাদের ঠাকুরবাড়ি থেকেই আবার পথে নামব।
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান॥
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলারবন, বাংলার মাঠ-
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান॥
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা-
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান॥
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন-
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান॥