হিমাচল প্রদেশে কৃপাল পারমারের কথা আগেই বলেছি। কৃপাল পারমার হিমাচল প্রদেশে বিজেপির রাজ্য সহসভাপতি, রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন, টিকিট পাননি কেবল তা নয়, তাঁর ভাষায় জে পি নাড্ডা তাঁকে ১৫ বছর ধরে জলিল করছে, অপমান করছে, হেনস্থা করছে, তাই তিনি এবার বাগী, বাগী নির্দল প্রার্থী। এদিকে হিমাচল প্রদেশে এটাই প্রথম নয়, এমনিতেই বিদ্রোহ চারিদিকে, থামাতে মাঠে নেমে পড়লেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রধানমন্ত্রী অনেক পরে, তারও আগে তিনি আর এস এস প্রচারক, বিজেপি নেতা, যাবতীয় রীতি রেওয়াজকে কলা দেখিয়ে তিনি এক প্রার্থীকে নিজে ফোন করে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করতে বললেন। এবং ক্ষোভ কোন পর্যায়ে গেছে ভাবুন, সেই হিমাচল প্রদেশের এক নেতা প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ তো রাখলেনই না, উলটে পুরো কনভারসেশন রেকর্ড করে বাজারে ছেড়ে দিলেন। পরদিন মোদিজির সেই ‘মেরে কৃপাল’কে দল থেকে বহিষ্কার করা হল। এরপরেই বহিষ্কার করা হল কিন্নরের প্রাক্তন এমএলএ তেজবন্ত নেগিকে। তিনিও টিকিট পাননি, নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। নালাগড়ের এমএলএ কে এল ঠাকুরও টিকিট পাননি, ইনিও দাঁড়িয়ে পড়েছেন, না জিততে নয়, সাফ জানিয়েছেন বিজেপির অফিসিয়াল ক্যান্ডিডেটকে জিততে দেব না। মনোহর ধীমান হিমাচল প্রদেশের ইন্দোরা বিধানসভা থেকে ২০১২ নির্বাচনে বিজেপির হয়ে জিতেছিলেন। পরেরবারে টিকিট পাননি, সেবার রীতা দেবী মাত্র ১০৯৫ ভোটে কংগ্রেসকে হারিয়ে জিতেছিলেন এই আসন, এবারে জয় শ্রীরাম শ্লোগান দিয়ে সেই আসনে মনোহর ধীমান দাঁড়িয়ে পড়ায় বিজেপির অফিসিয়াল প্রার্থী বিপদে পড়েছেন শুধু নয়, বহু এলাকায় প্রচারেও যেতে পারছেন না, যদিও তাঁর মাথায় জে পি নাড্ডার হাত আছে বলে শোনা যায়। আন্নি আসনের গতবারের বিজয়ী কিশোরী লালও টিকিট না পেয়ে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন, তাঁর সঙ্গে স্থানীয় বিজেপি নেতারাও আছেন। কিশোরী লাল, মনোহর ধীমান, কে এল ঠাকুরকেও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের সিমলার এমএলএ, গত মন্ত্রিসভার আইন মন্ত্রী জয়রাম ঠাকুর সিমলাতে প্রচার চলাকালীন জানতে পারলেন তাঁকে সিমলা নয় কাসৌটির টিকিট দেওয়া হয়েছে, ওদিকে কাসৌটির গতবারের বিজেপি প্রার্থী বিজয় জ্যোতি টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। ছোট্ট রাজ্য হিমাচল প্রদেশে একে আপেল চাষিরা আপেলের দাম পাচ্ছে না বলে ক্ষুব্ধ, জিনিসপত্রের দাম নিয়ে মানুষ নাজেহাল, সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি আর অগ্নিবীর স্কিম নিয়ে ক্ষুব্ধ যুবকেরা। তার ওপরে অন্তত ৩০টা আসন। বলতেই পারেন নির্বাচনের আগে ওসব একটু হয়। তাহলে বলি, বিষয়টা কয়েকজন বিদ্রোহী প্রার্থীর নয়, বিজেপি দলের সভাপতি জে পি নাড্ডা উঠে এসেছেন হিমাচল প্রদেশ থেকে, তাঁর হোম টাউন হিমাচল প্রদেশের বিলাসপুরে, সেখানেই চারটে আসনের দুটো আসনে লড়ছে বিদ্রোহীরা। অসন্তোষ এতটাই যে প্রধানমন্ত্রীকে মাঠে নামতে হচ্ছে, রাজ্যে বিজেপির তিন তিনটে গ্রুপকে সামাল দিতে। এরকমটা কি শুধু হিমাচল প্রদেশে? না, দেশ জুড়ে এই অসন্তোষ, রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতার দুটো তিনটে চারটে কেন্দ্র তৈরি হয়ে গেছে, একেই বলে বৃদ্ধির সমস্যা, প্রবলেম অফ গ্রোথ। আসুন সেই খবরের দিকে চোখ ফেরানো যাক। পার্টি উইথ আ ডিফারেন্স এখন আর পাঁচটা দলের মতোই, দলীয় কোন্দল থেকে গ্রুপবাজি কিছুতেই কম যায় না আজকের বিজেপি। চলুন মরুরাজ্যে যাওয়া যাক। রাজস্থানে কংগ্রেসের দুটো গোষ্ঠী, শচীন পাইলট, অশোক গেহলট, চূড়ান্ত লড়াই। অন্য কোনও রাজ্য হলে এই সরকার ভাঙা অমিত শাহের বাঁয়ে হাত কা খেল ছিল, কিন্তু রাজস্থানে নতুন সরকারে মুখ্যমন্ত্রী হবেন কে? ধরে নেওয়া যাক মধ্যপ্রদেশ স্টাইলে অশোক গেহলট বা শচীন পাইলটকে মোদিজির মন্ত্রিসভায় জায়গা দেওয়া হল, তাহলেও রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার বিজেপির অন্তত চার জন নেতা। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া, রাজ্য সভাপতি সতীশ পুনিয়া, রাজ্যবর্ধন সিং রাঠোড়, এবং আপাতত স্পিকার হলে কী হবে ওম বিড়লার মন পড়ে আছে জয়পুরে। এঁদের বিরোধ এতটাই যে সভায় একজন থাকলে অন্যজন আসেন না, মুখ দেখাদেখিও নেই। অমিত শাহ গেছেন, মোদি গেছেন কিন্তু বিবাদ মেটেনি, কদিন আগে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া একলাই পদযাত্রা সেরে ফেললেন। অবশ্য এই বসুন্ধরা রাজেকে নিয়ে আপত্তি আছে স্বয়ং মোদি–শাহের। চলুন কর্নাটকে, কদিন পরেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, আগের মুখ্যমন্ত্রী লিঙ্গায়েত গোষ্ঠীর নেতা ইয়েদুরিয়াপ্পাকে সরিয়ে আরেকজন লিঙ্গায়েত নেতা বাসবরাজ বোম্মা কে গদিতে বসানো হল বটে কিন্তু ইয়েদুরিয়াপ্পার সমর্থকরা ফুঁসছেন, সময়মতো জবাবও দেবেন। তাদের ঠান্ডা করতে কর্নাটকের বাইরে কেউ চেনে না, এক বর্ণ হিন্দি না বলতে পারা, সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ আছে এমন একজনকে বিজেপির পার্লামেন্টরি বোর্ডে ঢুকিয়ে দেওয়া হল, তাতে ইয়েদুরিয়াপ্পা বা তাঁর সমর্থকেরা খুব খুশি হয়েছেন, তাও নয়। কদিন আগে নির্বাচনী ভেঁপু বাজানোর জন্য অমিত শাহের যাওয়ার কথা ছিল, তিনি গেলেন না, পাঠালেন সাধারণ সম্পাদক অরুণ সিংকে, তাঁর মিটিংয়ে বাসবরাজ বোম্মাই হাজিরও থাকলেন না, যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও দুপুরের পর বাড়ি ফিরে গেলেন। রাজ্যের অন্যতম নেতা বাসনাগৌড়া ইয়ান্তল বিদ্রোহীদের মুখ, তিনি ইয়েদুরিয়াপ্পা-বোম্মাই এর পদযাত্রা নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে বলেছেন এই দুজন পদযাত্রায় বের হলে রাজ্যে বিজেপি হারবে। মহারাষ্ট্রে দেবেন্দ্র ফড়নবিশ মুখ্যমন্ত্রিত্ব না পেয়ে রীতিমতো ক্ষুব্ধ, তিনি উপমুখ্যমন্ত্রী হবেন না বলেই জানিয়েছিলেন। অমিত শাহ, জে পি নাড্ডা ফোন করার পরেও সিদ্ধান্ত বদলাননি, শেষে নরেন্দ্র মোদির ফোনে নিমরাজি হয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন বটে, কিন্তু পদে পদে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। আরেক উল্লেখযোগ্য প্রবীণ নেতা নীতিন গডকরি তো এই সেদিন মনমোহনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন, সে কি এমনি এমনি? মধ্যপ্রদেশে মামাজি শিবরাজ চৌহান জানেন দিন ফুরিয়েছে, কিন্তু আটকাতেই হবে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে, সিন্ধিয়া জানেন এমপিতে শেষ বাধা এই মামাজি, দুজনে লড়ে যাচ্ছেন। এই সেদিন সিন্ধিয়া ঘনিষ্ঠ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রদ্যুম্ন সিং তোমর সিন্ধিয়ার গোয়ালিয়রেই খালি পায়ে হাঁটলেন। অভিযোগ রাস্তা সারাই হচ্ছে না কেন, রাজ্য সরকার জবাব দাও, রাজ্য সরকার বিজেপির। রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামীণ উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী মহেন্দ্র সিং সিসোদিয়া সেদিন সাংবাদিকদের ডেকে বলেছেন, রাজ্য সরকার অটোক্র্যাট, স্বৈরাচারী, তিনিও সিন্ধিয়া ঘনিষ্ঠ। লড়াই জারি হ্যায়। উত্তরপ্রদেশে কোনও বিরোধিতা নেই, বিরোধিতা করলে কী হবে তা সবাই জানে, এখানে সমস্যা যোগী আদিত্যনাথ স্বয়ং। মোদিজি পর্যন্ত ঠিক আছে, তারপর কারও কথা শোনার প্রয়োজন তিনি অন্তত মনেই করেন না। অমিত শাহ মোদি ছাড়াই লখনউতে বিজয়োৎসব পালন করা হিম্মত তেনারই আছে, গোকুলে বাড়তে থাকা এই যোগী পরবর্তীতে বিজেপির শরদর্দ হয়ে উঠতে পারে। আসুন বাংলায়, কে যে কার দিকে, কে কার বিরুদ্ধে তা বোঝা ভারী মুশকিল, রূপা গাঙ্গুলি আর বের হচ্ছেন না, লকেট চ্যাটার্জি দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন, সরাসরি যোগাযোগ মোদি–শাহের সঙ্গে। সুকান্ত মজুমদারকে সবাই এলেবেলে বলেই ডাকে, তিনি রাজ্য সভাপতি, গেলেন গাইঘাটায় ঠাকুর নগরে, বৈঠকে হাজির নেই স্থানীয় সাংসদ বা বিধায়ক, তিনি বৈঠক সেরে একলাই ফিরলেন। একলা জগাই দলু ঘোষ লড়ে যাচ্ছে, সঙ্গে কেউ নেই, বিরোধী দলনেতা নিজের অতীত মুছতেই ব্যস্ত, কিছুতেই আর বিজেপি নেতা হয়ে উঠতে পারছেন না। এখনও নিখাদ এক বিদ্রোহী তৃণমূল নেতাই থেকে গেছেন টাচ মি নট খোকাবাবু। সায়ন্তন চিঠিতে ভেসে উঠছেন মাঝে মাঝে, একমাত্র তাত্ত্বিক নেতা শমীক ভট্টাচার্য শ্যাম রাখি না কূল রাখি ভাবতে ভাবতে পৌঁছে যান টিভি চ্যানেলে, তারপর সুচিন্তিত মতামত দিয়ে ফিরে আসেন নিজগৃহে। এ খানিকটা ২০০৮/২০০৯ কংগ্রেসের মতো, টিভি কংগ্রেস, মুর্শিদাবাদ কংগ্রেস, মালদা কংগ্রেস, হাবুল কংগ্রেস, ঝান্ডা কংগ্রেস আর কেন্দ্রীয় কার্যালয় কংগ্রেস, এখন যেগুলোর কঙ্কাল দেখতে পাই আমরা। বিজেপি এই বাংলায় খানিকটা সেই রোল প্লে করছে। গুজরাতে সবে প্রার্থী তালিকা বেরিয়েছে, অনেকের টিকিট কাটা গেছে, কংগ্রেস থেকে এসেই গুরুত্বপূর্ণ আসনের টিকিট পেয়েছেন হার্দিক প্যাটেল সমেত অনেকে, সে বিদ্রোহ ক্রমশ প্রকাশ্য। যেটা বলতে চাইছি, তা হল আ পার্টি উইথ ডিফারেন্স বলে যে দল অটল আদবানির হাত ধরে রওনা দিয়েছিল, মোদি শাহের বিজেপি সেই বিজেপি নয়। সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ আছে এমন লোকজনও আজ বিজেপির সর্বোচ্চ কমিটিতে ঢুকে গিয়েছে, এইসব স্খলন আটকানোর জন্যই ছিল আর এস এস, তারাও ক্ষমতার মধুভাণ্ডের স্বাদ নিতে ব্যস্ত, দ্বারকার মূষল পর্ব শুরু হয়েছে, মাথায় রাখবেন ক্ষমতার মৈরেয় পান করে মুষলপর্বে যাদব বংশ ধ্বংস হয়েছিল।