৪৪ বছরে আমরা শুনিনি, লালকৃষ্ণ আদবানি বলেননি, অটলবিহারী বাজপেয়ী বলেননি, মুরলি মনোহর জোশি বা বিজেপির প্রবীণ নেতাদের কারও মুখেই আমরা শুনিনি, আজ নরেন্দ্র মোদি প্রথম জানালেন, হনুমানজির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই বিজেপি তার পথ চলেছে। এর আগে লালকৃষ্ণ আদবানির মুখে, বিজেপির প্রবীণ নেতাদের মুখে আমরা রামের কথা শুনেছিলাম। আজ হনুমান জুড়ে গেল বিজেপির ইতিহাসে। সেই বিজেপি যা আজ থেকে ঠিক ৪৪ বছর আগে পথ চলা শুরু করেছিল। অবশ্যই মাথায় রাখুন, বিষয়টা এমনও নয় যে কিছুই ছিল না। কিছু মানুষ মিলে বসে ঠিক করলেন যে আজ থেকে আমরা ভারতীয় জনতা পার্টি নামের এক দল করব, এবং দল শুরু হল। না তেমনটা হয়নি। এটা ছিল নবজন্মের মতো একটা ব্যাপার, বা সাপের খোলস ছাড়ার সঙ্গেও তুলনা করাই যায়। ১৯২৫ সালে আমাদের দেশে হিন্দুত্ববাদীরা মিলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তৈরি করেন, তার বেশ কিছু আগে থেকেই ১৯১৫ সালে হিন্দু মহাসভা তৈরি হয়। হিন্দু মহাসভা রোজকার রাজনীতি, সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে থাকে। আরএসএস হয়ে ওঠে সেই রাজনীতির দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। গান্ধী হত্যার পরে হিন্দু মহাসভা ভাঙনের মুখে পড়ে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মহাসভা ছেড়ে জনসঙ্ঘ তৈরি করেন। যা হয়ে ওঠে আরএসএস-এর সংসদীয় গণতান্ত্রিক মুখ। কিন্তু নির্বাচনী সাফল্য তেমনভাবে আসেনি, যদিও আরএসএস এবং জনসঙ্ঘের প্রচার, তাদের বক্তব্য, তাদের আরও বিভিন্ন শাখা সংগঠন ছড়িয়ে পড়ছিল দেশজুড়ে। জরুরি অবস্থার সময়ে আরএসএস এবং জনসঙ্ঘের দোদুল্যমানতা ছিল দেখার মতো। এক অংশ ইন্দিরা গান্ধীর জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করছিল, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চাইছিল, তাদের মধ্যে বাজপেয়ী ছিলেন, নানাজি দেশমুখ ছিলেন। অন্য অংশ এমার্জেন্সির বিরোধিতায় মুখর ছিল।
কিন্তু এসবের মধ্যেই ১৯৭৭ তাদের কাছে এক নতুন সম্ভাবনা এনে দাঁড় করাল। লোক দল, কংগ্রেস অর্গানাইজেশন, ভারতীয় ক্রান্তি দল, সোশ্যালিস্ট পার্টি, স্বতন্ত্র পার্টি, প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টি, জনসঙ্ঘ ইত্যাদি মিলে জনতা দল তৈরি হল। কিন্তু শুরু থেকেই জনসঙ্ঘ নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন স্বয়ং জয়প্রকাশ নারায়ণ, সোশ্যালিস্ট গ্রুপের লোকজনেরা জনসঙ্ঘের হিন্দুত্বের এজেন্ডা নিয়ে সরব হতে থাকল। জামসেদপুর, আলিগড়ের দাঙ্গায় আরএসএস–জনসঙ্ঘিদের হাত আছে বলে অভিযোগ উঠল। কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেল ডুয়েল মেম্বারশিপের কথা। জনসঙ্ঘের সদস্যরা জনতা দলের সদস্যতার সঙ্গে আরএসএস-এর সদস্যও ছিলেন। সোশ্যালিস্ট ব্লকের তরফে দাবি উঠল এক দল এক সদস্যতার কথা। জয়প্রকাশ বললেন আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হল, ওঁরা জনতা দলে নিঃশর্তে যোগ দিয়েছিলেন, অন্য কোথাও সদস্যতা বজায় রাখবেন এমন কথা ছিল না। কিন্তু ততদিনে আদবানি-বাজপেয়ী বুঝে গেছেন এই সরকার আর টিকবে না, আর তাঁরা ইতিমধ্যেই ভারতীয় রাজনীতির সেন্টার স্টেজে এসে গেছেন তাই তাঁরা জানিয়ে দিলেন, তাঁদের পক্ষে আরএসএস-এর সদস্যপদ ছাড়া সম্ভব নয়। এরপর ভাঙনের প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হল। ৪ এপ্রিল জনতা দলের জাতীয় পরিষদ এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল এবং তা জনতা দলের প্রত্যেক সদস্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া হল। তাতে বলা হল, জনতা দলের কোনও সদস্য অন্য কোনও সংগঠনের সদস্য হতে পারবে না। এইখানে এক পুরনো ইতিহাসের কথা বলে রাখি, সুভাষ বসুর নেতৃত্বে কংগ্রেস দল এরকমই এক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ১৯৩৯-এ সুভাষ বসু জানিয়েছিলেন হিন্দু মহাসভা বা মুসলিম লিগের সদস্যদের কংগ্রেসের সদস্যপদ দেওয়া হবে না। এর ঠিক পরেই ১৯৪০-এর ৪ মে সুভাষ বসু এক লেখাতে বলছেন এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো কী ধরনের রাজনীতি করে এবং তা কেন দেশের পক্ষে বিপজ্জনক। তো জনতা দলও জানিয়ে দিল সেই কথাই ৪ এপ্রিলে। ৫ এবং ৬ তারিখে জনতা দলের মধ্যে যারা জনসঙ্ঘের পুরনো সদস্য ছিলেন তাঁরা এক বৈঠকে বসলেন, ৬ তারিখে ঠিক হল নতুন দলের নাম। সভাপতি হলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী, ততদিনে তিনি বিদেশমন্ত্রী হিসেবে যথেষ্ট পরিচিত। সাধারণ সম্পাদক হলেন লালকৃষ্ণ আদবানি, যিনি মোরারজি মন্ত্রিসভায় তথ্য ও জনসংযোগ মন্ত্রী ছিলেন। দলের বিভিন্ন পদে এলেন নানাজি দেশমুখ, মুরলী মনোহর জোশি, কে আর মালকানি, জে পি মাথুর, সুন্দরলাল পাটওয়া, জনা কৃষ্ণমূর্তি, কুশাভাউ ঠাকরে, ভৈরো সিং শেখাওয়ত, শান্তা কুমার প্রমুখ জনসঙ্ঘের নেতারা, যাঁরা আদতে আরএসএস-এর সদস্য ছিলেন। এঁদের সঙ্গেই দলে যোগ দিয়েছিলেন জেঠমালানি, শান্তিভূষণ বা সিকন্দর বখতের মতো নেতারা যাঁদের আরএসএস-এর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | দেশ বিকাশের পথে এগিয়ে চলেছে, তবুও রাস্তায় কেন মোদি বাহিনী?
দিল্লির কোটলা মাঠে এক কর্মিসভা ডাকা হয়েছিল, সেখানেই সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হল, বাজপেয়ী নতুন দলের নাম, উদ্দেশ্য ইত্যাদি জানালেন। তখনও তাঁরা গান্ধীর সমাজতন্ত্র, স্বরাজ, ইত্যাদির কথা বলছেন। সেখানেই জানানো হল ডিসেম্বরে প্লেনারি অধিবেশনে দলের কর্মসূচি ইত্যাদির কথা জানানো হবে। কথা মতোই ১৯৮০ ২৮-৩০ ডিসেম্বর নতুন দল বিজেপির অধিবেশন বসল, জানানো হল ইতিমধ্যেই দলের সদস্যসংখ্যা ২৫ লক্ষ ছুঁয়েছে। সেদিন ও তাঁদের কর্মসূচিতে ৩৭০ ধারার বিলোপ, ইউনিফর্ম সিভিল কোড, দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে তাঁদের নিজস্ব ধারণা, এক শক্তিশালী কেন্দ্র এবং জাতীয়তাবাদের কথার সঙ্গেই রাম মন্দিরের কথাও বলা ছিল। এই ১৯৮০ থেকেই বিজেপির যাত্রা শুরু। এরপর কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা বোঝেন যে একা চললে দেশের ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়। সেদিন ৬ এপ্রিলের জনসভায় অটলবিহারী বাজপেয়ী সাফ জানিয়েছিলেন, কংগ্রেস হল শত্রু, কংগ্রেসকে হঠাতেই হবে এবং তার জন্য যা যা করার সব করা হবে। এরপরে তাদের কাছে আবার সুযোগ এল ১৯৮৯, ভি পি সিং কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এলেন বোফর্স ইস্যু সামনে রেখে, এবং আনকন্ডিশনাল সমর্থন এল বিজেপির কাছ থেকে, সেই জোটকে সমর্থন করলেন বামপন্থীরা। সেই বামপন্থীরা যাঁরা ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলতেন, যাঁরা ভালো করেই জানতেন বিজেপি আরএসএস-এর সম্পর্ক বা তাদের কর্মসূচির কথা। এবার আরও বেশি দায়িত্ব নিয়ে তাঁরা মন্ত্রিসভায়, এবং আবার সময় বুঝে সরকার ভেঙে বেরিয়ে গেলেন, ইস্যু রামমন্দির। প্রত্যেকবার বিজেপি সরকারে এসেছে সরকার ভেঙেছে, কিন্তু নিজেদের শক্তি বাড়িয়েছে। কিন্তু তারপরেও তারা একক ক্ষমতায় সরকার তৈরি করার মত জনসমর্থন পায়নি, কাজেই নিজেদের এজেন্ডা আপাতত সরিয়ে রাখে অটল বিহারীর সরকার। খেয়াল করে দেখুন, তখন তাঁরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা, দেশের উন্নয়ন বিকাশের কথা বলছেন, এবং বহু শরিক নিয়ে অটল মন্ত্রিসভা চলেছে, এমনকী আগমার্কা সোশালিস্ট জর্জ ফার্নান্ডেজও ছিলেন সেই মন্ত্রিসভায়। সেই সময়েও একবারও বিজেপি রাম মন্দিরের কথা বলেনি, বলেনি ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার কথা, বলেনি ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা যদিও তাদের কর্মসূচিতে এসবই ছিল।
এরপর ২০১৪, সেখানেও ইস্যু দুর্নীতি, বিকাশ, নরেন্দ্র মোদি একটা জনসভাতেও রামমন্দিরের কথাও বলেননি, ৩৭০ ধারার কথাও বলেননি। তখনও অনেক শরিক দল। আজ ৪৪তম বার্ষিকীর ভাষণ দিতে এলেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি। এখন শরিক দল বলতে কিছু হাফ প্যান্টুল। শিব সেনা, অকালি দল, জেডিইউ কবেই ছেড়ে চলে গেছে। অবশ্য এখন বিজেপির তাদের সমর্থন দরকার নেই, এখন তারাই ৩০৩। এই হল খুব সংক্ষেপে বিজেপির উত্থানের কাহানি। মজার কথা হল যে দল নীতির কথা বলে, যে দল স্বচ্ছতার কথা বলে তাদের উত্থানের সর্বত্র আছে বিশ্বাসঘাতকতা আর অস্বচ্ছতা। যে শরিকদের তারা সঙ্গে নিয়েছে, তাদেরকে তারা ঠকিয়েছে বার বার, তাদের ওপর ভর দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা বাড়িয়েছে, তারপর তাকে ছেড়ে ক্ষমতার অলিন্দে আরও একটু এগিয়ে গেছে। কেবল তাই নয়, এই উত্থানের মধ্যে বহু মানুষ এসেছেন যাঁরা আরএসএস নন, তাঁদের সাহায্য কাজে লেগেছে, এখন তাঁরা কোথায়? এই যে রাম জেঠমালানি বা শান্তিভূষণ, এঁরা পরবর্তী সময়ে তীব্র বিজেপি বিরোধিতায় নেমেছেন। জর্জ ফার্নান্ডেজের মতো নেতা বিস্মরণে চলে গেছেন, এমনকী এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদককেও আজ অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। তিনি মার্গদর্শক মণ্ডলীতে আছেন বটে, কিন্তু তাঁর কাছে মার্গদর্শনের জন্য কেউ যায় না। এবং সেই ১৯৮০ থেকে বিজেপির পথচলা যাঁরা দেখেছেন, যেসব রাজনৈতিক নেতারা সেই পথ চলার সাক্ষী। যে সব সাংবাদিকরা প্রতিদিন মন দিয়ে দেখেছেন এই অগ্রগতি, তাঁরা একমত যে বিজেপির এই আগ্রাসী চেহারা ১৯৮০তে তো বাদই দিলাম, অটলবিহারীর শাসনকালেও দেখা যায়নি। এই হিন্দুত্বের তাণ্ডব, এই পুলিশি রাষ্ট্র তৈরি করে ফেলার প্রচেষ্টা, এই সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রায় একদলীয় শাসনের দিকে এগিয়ে চলা, এইভাবে বিরোধী দল বা বিরোধী স্বরকে থামিয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র পূর্বাভাস সাধারণ মানুষের কাছে ছিল না। আজও দেশের বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারেনি বিজেপি কিন্তু তাদের স্থির লক্ষ্য এক মেজরেটেরিয়ান ডেমোক্রেসি, সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্র দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। এই পরিকল্পনার সূত্রপাত ১৯৮০ নয় ১৯২৫-এ, আরএসএস-এর জন্মলগ্ন থেকে যে পরিকল্পনা তৈরি ছিল আজ কেবল তার রুপায়ণ দেখতে পাচ্ছি আমরা। আজ ৪৪ বছর পরে মানুষের এই বোধোদয় কি আদৌ কোনও কাজে দেবে?