মানস চক্রবর্তী: শনিবারের আইএসএল (ISL) ডার্বির সম্পর্কে কিছু বলার আগে এবারের প্রেক্ষিতটা একটু দেখে নেওয়া যাক। এই প্রথম ডার্বি হচ্ছে লিগের শেষ ম্যাচ। সাধারণত ডার্বি হয় লিগের মাঝামাঝি। কিন্তু লিগের দুই দলেরই শেষ ম্যাচ ডার্বি এর আগে খখনও হয়নি। ডার্বির ফলের উপর লিগের ফল নির্ভর করত অনেকটাই। এবার তেমন কিছু হওয়ার ব্যাপার নেই। এটিকে মোহনবাগান এখন লিগে আছে চার নম্বরে। ১৯ ম্যাচে তাদের পয়েন্ট ৩১। শনিবার জিতলে তারা চার নম্বরেই থেকে যাবে। তাতে লিগের পর যে প্লে অফ হবে তাতে তারা নিজেদের মাঠে খেলতে পারবে। হেরে গেলে খেলতে হবে বাইরের মাঠে। ইস্ট বেঙ্গলের এ সবের কোনও সমস্যা নেই। জিতলে তারা উঠে আসবে নয় নম্বরে। হারলে থেকে যাবে দশ নম্বরেই। ১৯ ম্যাচে ১৯ পয়েন্ট হয়েছে তাদের।
আই এস এল খেলার পর থেকে এটিকে মোহনবাগানের কাছে টানা সাত বার হেরেছে ইস্ট বেঙ্গল। ব্যাপারটা তাদের ফুটবল ইতিহাসে একটা বড় কলঙ্কের দাগ। শনিবার হারলে সংখ্যাটা আট নম্বর হবে। দু দলের শক্তির যা তারতম্য তাতে জেতার ব্যাপারে মোহনবাগানকেই এগিয়ে রাখতে হবে। তাদের টিম শুধু সেটই না, যথেষ্ট ব্যালান্সড। শুধু একটা খুঁত থাকছে এই ম্যাচে। ডিফেন্সের স্তম্ভ ব্রেন্ডন হামিলকে পাওয়া যাবে না কার্ড সমস্যায়। তাঁর জায়গায় খেলবেন স্লাভকো, যাঁর আই এস এল-এ খেলার অভিজ্ঞতা আছে। বাকি তিন বিদেশি হিসেবে থাকবেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে কার্ল ম্যাকহিউ, মাঝ মাঠে গেমমেকার হূগো বুমো এবং সামনে সিঙ্গল স্ট্রাইকার দিমিত্রি পেত্রাতোস। মোহণবাগান এই লিগে জেনুইন স্ট্রাইকারের অভাবে অনেক ভুগেছে। শেষ ম্যাচে জোড়া গোল করে দলকে জিতিয়েছেন কার্ল ম্যাকহিউ। কিন্তু প্রতিদিন তিনি গোল করবেন আর টিম জিতবে এ রকম না ভাবাই ভাল। তবে গোয়া থেকে শেষ দিকে আসা গ্লেন মার্টিন্স এবং কার্ল ম্যাকহিউ মিলে বাগানের ডিফেন্সিভ ব্লকিং বেশ ভাল জায়গায় নিয়ে গেছেন।
তবে ফুটবল তো গোলের খেলা। বাগানের তিন অ্যাটাকিং মিডিও মনবীর সিং, হুগো বুমো এবং আশিক কুরুনিয়ন ইদানিং বেশ গুছিয়ে খেলছেন। মাঝে তিন জনই ছিলেন অবিন্যস্ত। বাগান গোল পাবে কিনা তা নির্ভর করবে এই তিন জনের ভাল খেলার উপর। কারণ দিমিত্রি নিজে গোল করার লোক নন। তাঁকে দিয়ে গোল করাতে হয়। তবে সেট পিসে তিনি বেশ ভাল। কর্নার বা ফ্রি কিকগুলো ভাল নিতে পারেন। এটা তাঁর দলের পক্ষে একটা বড় সুবিধে। ডিফেন্সে ব্রেন্ডন হামিল না থাকলেও আশিস রাই, প্রীতম কোটাল কিংবা শুভাশিস বসুরা বেশ নিরাপদ। গোলে বিশাল কাইথ এই টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা। শুধু ভয় থাকছে স্লাভকোকে নিয়ে। কারণ তিনি একটু মন্থর। এই শ্লথগতি তাঁর বিরুদ্ধে যেতে পারে। বিশেষ করে তাঁকে সামলাতে হবে ক্লেটন সিলভা এবং জাক জার্ভিসকে। দুই ফরোয়ার্ড বেশ ভাল। ক্লেটন তো এক ডজন গোল করে লিগের টপ স্কোরার। জাক জার্ভিস অনেক দেরিতে মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছেন। সাড়ে ছয় ফুটের এই স্ট্রাইকার ব্যাক ভলিতে একটি দুর্দান্ত গোলও করেছেন। তাই ইস্ট বেঙ্গল অ্যাটাককে বেশ সমীহ করতে হবে মোহনবাগানকে।
তবে এই দুজন নন, লাল হলুদের অ্যাটাকের সেরা অস্ত্র হল তাদের লেফট হাফ নাওরম মহেশ সিং। শুধু গোল করাই নয়, মহেশ গোল করানোতেও দুর্দান্ত। আই এস এল-এর লিগ-শিল্ড চ্যাম্পিয়ন মুম্বই সিটি এফ সি-র বিরুদ্ধে তাঁর গোলে ম্যাচ জিতেছে ইস্ট বেঙ্গল। লিগের এক নম্বর দলের বিরুদ্ধে দশ নম্বরের জয় নিশ্চিতভাবে দলের ফুটবলারদের মনোবল অনেক বাড়িয়ে দেবে। তবে ডার্বিতে এ সবের কোনও গুরুত্ব নেই। ম্যাচে যে ভাল খেলবে, ভুল কম করবে, গোলের সুযোগ কাজে লাগাবে সেই জিতবে। ইস্ট বেঙ্গলের মাঝ মাঠের বাকি তিনি সৈনিক অ্যালেক্স লিমা, মোবাশির রহমান এবং ভি পি সুহের যে খুব আহামরি বলা যাবে না। কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো। তাদের পিছনে ব্যাক ফোর অর্থাৎ সার্থক গোলুই, চিংগেনসুনা লাল, কিরিয়াকু এবং জেরি মন্দ নন। বিশেষ করে সেন্টার ব্যাক লাল এবং লেফট ব্যাক জেরির মধ্যে ধারাবাহিকতা বেশি। তাঁরা খুব খারাপ খেলেন না। চাপ নিতে পারেন। বাকি দুজনের সম্পর্কে সে সব বলা যাবে না। গোলে কমলজিৎ সিং কখনও ভাল, কখনও মন্দ।
এ তো গেল দু দলের ফুটবলারদের বিশ্লেষণ। এর বাইরেও থাকে দুই কোচের স্ট্র্যাটেজি। বলতে বাধ্য হচ্ছি, এত বড় লিগে দু জনের মধ্যেই কোনও ক্রিয়েটিভ মুভ দেখতে পাওয়া যায়নি। কোনও বিশেষ মুভ বা একটা প্লেয়ারকে দিয়ে বিশেষ কিছু করার চেষ্টা দেখা যায়নি। নিজের টিম গোল করলে জুয়ান ফেরান্দো তাঁর টি শার্টটা তুলে আনন্দ করেন। স্টিভন কনস্ট্যানটাইন থাকেন উচ্ছ্বাসহীন। এটা আমরা দেখেছি। কিন্তু নতুনত্ব কিছু চোখে পড়েনি। এবারের ডার্বি ঘিরে নতুনত্ব হল ভি আই পি এবং ভিভিআইপি টিকিটের সংখ্যা পছন্দ হওয়ায় মোহনবাগান কর্তারা মাঠে যাবেন না। তবে সাধারণ দর্শক এবং সমর্থকরা মাঠে যাবেন। তারাই তো আসল। পঞ্চাশ-ষাটজন অফিসিয়াল গেলেন কি না গেলেন তাতে কী যায় আসে?
তবে সব মিলিয়ে মোহনবাগানই শনিবারের ডার্বিতে ফেভারিট। তবে বড় ম্যাচ তো। তাই সল্ট লেক স্টেডিয়ামে তারা জিতবেই বলতে পারছি না। ডার্বিতে ফেভারিট টিম যে কতবার হেরেছে। আর ইস্ট বেঙ্গল তো হারতে হারতে হারান হয়ে গেছে। একবার না হয়, জিতেন হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করুক। তবেই না বজায় থাকবে ডার্বির মাহাত্ম্য।