উল্লসিত ক্যাডারদের সামনে দাঁড়িয়ে বিধায়ক, জেলার নেতা, নিদেনপক্ষে ব্লকের নেতা। অবশ্যই এঁরা প্রত্যেকেই তৃণমূলের। সামনে একজনের হাসব না কাঁদব গোছের মুখের কংগ্রেস, সিপিএম, আরএসপি জয়ী প্রার্থী। যিনি এই বাজারে শাসকদলের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতেছেন, মানুষের ভোটে জিতেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূল ছিল, যাঁরা রাজ্যে শাসকদল। বিরুদ্ধে বিজেপি ছিল যাঁরা দিল্লিতে ক্ষমতায়, বিরুদ্ধে মিডিয়া ছিল, পুলিশ ছিল, প্রশাসন ছিল কিন্তু তিনি জিতেছিলেন। আজ তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন যজ্ঞে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য, ঘাসফুল চিহ্ন দেওয়া তেরঙা পতাকা হাতে নিচ্ছেন। এবং এই শুভক্ষণে, মানে এই উন্নয়ন যজ্ঞে ঝাঁপ দেওয়ার আগে ভেবেই পাচ্ছেন না তিনি হাসবেন না কাঁদবেন। কারও মাথায় ভাসছে থানার মেজবাবুর জেলে যাওয়ার হুমকি, কারও চোখে মুখে দৃশ্যতই তিন রাত ঘুমোতে না পারার ছাপ। এই ছবি এখন কাগজের পাতায়, টিভির স্ক্রিনে। অপহরণের নাটক চলছে, নানান নাটকের পর জানাও যাচ্ছে শাসকদলের চাপে বিক্রি হওয়ার বা না হওয়ার নানান কাহিনি। এবং আদালতে সেসব অভিযোগ জমছে। তার মানে কি তৃণমূল এ রাজ্যে যথেষ্ট আসন পায়নি? যথেষ্ট জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি বা পঞ্চায়েত দখলে রাখতে পারেনি? না তাও তো নয়? ৭৫ শতাংশ পঞ্চায়েত, ৮৮ শতাংশ পঞ্চায়েত সমিতি এবং ১০০ শতাংশ জেলা পরিষদ তৃণমূলের দখলে? তাহলে? ওই যে, এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি। যেটুকু আছে, যে সমস্ত পঞ্চায়েতে পাল্লা সমানে সমানে বা একটু কম, সেগুলোও চাই শাসকদলের, তাই এখন বাংলায় নতুন করে উন্নয়ন যজ্ঞে ঝাঁপ দেওয়ার কাজ চলছে। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, কংগ্রেস আর বাম জনপ্রতিনিধিরা যোগ দিচ্ছেন তৃণমূলে?
মাত্র ক’দিন আগে তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড, যুবরাজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলের জনজোয়ারের সূচনা করেছিলেন। বয়স কম, ঝকঝকে চেহারা, ওবেসিটি ছাড়া নেতা মেলা ভার, সেদিক থেকেও ছিপছিপে জিম করা শরীর, বাংলা ইংরিজি হিন্দি বলেন ভালো। বলছেন দুর্নীতির সঙ্গে থাকলে দল ছাড়ুন, বলছেন প্রোমোটার আর ওই রকম ব্যবসায় থাকলে জনপ্রতিনিধি হওয়া যাবে না। বলছেন কুকথা বলা চলবে না। বলছেন কাজের মানুষেরাই টিকিট পাবেন। বলছেন যে বিরোধীদের ভোটে দাঁড়াতে দিতে হবে, তাদের বাধা দেওয়া চলবে না। বলছেন বটে, হচ্ছেটা কী? রাজ্যজুড়ে খবর আসছে, যে ক’টা জায়গায় তৃণমূল এবং বিরোধীরা প্রায় সমানে সমানে, সেখানে বিরোধীদের উপর চাপ তৈরি হচ্ছে। মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, নদিয়া, পুরুলিয়া থেকে খবর আসছে এই ঘটনার, আদালতেও হাজির হয়েছে, এই বিপুল জয়ের পরেও মুখ পুড়ছে কার? তৃণমূলের। এতে কতটা লাভ তৃণমূলের?
আরও পড়ুন: Aajke | সৌরনীলের মৃত্যু, সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ
নাকি লাভ ওই অঞ্চলের নেতাদের যা তাঁরা ছেড়ে দিতে রাজি নন, যাই বলুক নেতায়, ক্ষমতা থাকলে তবে তো মধু, তবে তো নেতা। তাহলে এত বক্তিমের দরকার কী ছিল? সরকার অনেক কাজ করছে, হ্যাঁ করছে। অন্যান্য অনেক রাজ্যের থেকে বেশি করছে। সরকার সংবেদনশীল, হ্যাঁ অন্য অনেক রাজ্যের মতো অসংবেদনশীল সরকার নয়, একথা অনায়াসে বলাই যায়। তাহলে? প্রত্যেকটা পঞ্চায়েত চাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন নাকি? নাকি এগুলো স্থানীয় নেতাদের উদ্যোগ যার উপরে নেতৃত্বের কোনও কন্ট্রোল নেই? এ আবার কেমন গণতন্ত্র, যেখানে বিরোধী বলে কিছুই থাকবে না? কেমন গণতন্ত্র যেখানে এই ক’দিন আগে তৃণমূল দল এবং নেতাদের নামে রাশি রাশি অভিযোগ এনেছেন, চুরির অভিযোগ এনেছেন, কাটমানির অভিযোগ এনেছেন, চাকরি চুরির অভিযোগ এনেছেন, তাঁদেরকেই দলে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যেখানে দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড জানিয়েছিলেন, বিরোধী তো দূরে থাক, দল থেকে বেরিয়ে যাঁরা নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদেরকেও দলে ফেরানো হবে না। তাহলে এটা হচ্ছেটা কী? এভাবে ক’টা পঞ্চায়েত দখলে আসবে? আমার হিসেবে গোটা ৩০-এর বেশি কোনও মতেই নয়। তার জন্য একটা গোটা দল, তার নেতৃত্ব আজ প্রশ্নের মুখে। এবং দলের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে এসব থামানোরও কোনও নির্দেশ নেই যা এই ঘটনাগুলোকে আরও ইন্ধনই দিচ্ছে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল বেরিয়ে যাবার পরে বোর্ড তৈরি হওয়ার আগে এই যে দলবদল, বা বলা ভালো এই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নযজ্ঞে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য দলবদল তা কি গণতন্ত্রের পক্ষে খুব সুস্থ ঘটনা? এইসব দলবদল কি তৃণমূলের ভাবমূর্তিকেই নষ্ট করছে না? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত হল সংখ্যালঘুর অধিকার, তাদের মত প্রকাশের অধিকার, তাদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার, তাদের নির্বাচিত হওয়ার অধিকার। যদি দেশের সংখ্যালঘু মানুষজন মানে বিরোধীরা জনসমষ্ঠির গরিষ্ঠ অংশ মানে শাসকদলের অধীন হয়ে পড়ে, সবটাই যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসকদলের ইচ্ছে অনুযায়ী হয়, তাহলে তা গণতন্ত্র নয়, মেজরেটেরিয়ানিজিম, সংখ্যাগুরুবাদ। সে এক সর্বনেশে ব্যাপার, গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে এক প্রবল স্বৈরতন্ত্র। তা কাম্য নয়। ইন ফ্যাক্ট ঠিক এই সময় বিজেপি সারা দেশ জুড়ে এই সংখ্যাগুরুবাদই চালাচ্ছে। তৃণমূল দলকে সে কথা মাথায় রাখতে হবে, রাজ্যের পরিবর্তনের লড়াই ছিল এক সংখ্যাগুরুবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, সেকথা ভুলে গেলে চলবে না।