স্বাধীনতার পরেই দেশভাগ, দেখেছে কারা? দেখেছে বাংলা, দেখেছে পঞ্জাব। লক্ষ লক্ষ মানুষ নয়, উদ্বাস্তু, শেকড় ছেঁড়া মানুষ এসেছে ওপার থেকে, গেছে এপার থেকে। ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদের সে ব্যথা দেখেছে বাংলা, দেখেছে পঞ্জাব। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পঞ্জাব সামলে উঠেছে, পরিশ্রমী আর দৈহিকভাবে অনেক বেশি সক্ষম পঞ্জাবিরা খুব তাড়াতাড়ি আবার বসতি বানিয়ে ফেলেছে, সবুজ বিপ্লবের ফলে বিত্তবান হয়েছে। যৌথ পারিবারিক কাঠামোকে বজায় রেখে, তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নিয়েই তাদের অগ্রগতি দেখার মতো। একমাত্র পঞ্জাবেই একই নামে তিন ধর্মের মানুষ আছে, মেহের চন্দ হিন্দু, মেহেরুদ্দিন মুসলমান, মেহের সিং শিখ, ফকির চন্দ হিন্দু, ফকিরুদ্দিন মুসলমান, ফকির সিং শিখ। ৪৭-এর পরে একমাত্র পঞ্জাবেই হিন্দু-মুসলিম বা শিখ-মুসলিম দাঙ্গার একটা ঘটনাও ঘটেনি। এরই মধ্যে এসেছে দুঃসময়, ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৩, খালিস্তানি আন্দোলন, হিংসা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, পাক সীমান্তের ওপার থেকে আসা উসকানি, হাজার হাজার তরুণ ছেলের হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়া। ঘর ছাড়া সেই ছেলেদের গান ছোড় আয়ে হম ইয়ে গলিয়া, একে ফর্টি সেভেন, অ্যামবুশ, লক আপ ডেথ এবং শেষ পর্যন্ত অপারেশন ব্লু স্টার, জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালার মৃত্যু, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু।
পঞ্জাব সেই ইতিহাসকে ভুলতে চেয়েছে, বহুদিন সেই ইতিহাসের কথা, আনন্দপুর সাহিব প্রস্তাবের কথা, যে প্রস্তাবে শিখ ভূমির কথা বলা হয়েছিল, খালিস্তানের কথা শোনাও যায়নি বহু দিন। অকালি দলকে বিপদে ফেলতে কংগ্রেস এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের জন্ম দিয়েছিল, সেই ভিন্দ্রালওয়ালার ইতিহাস সবাই জানে, ভুলতে চেয়েছে সবাই। কিন্তু সময়ের পাতাল থেকে সেই ইতিহাস যেন আবার উঠে আসছে, যেন আবার এক উথাল পাথাল সময় দেখবে পঞ্জাব, দেখবে দেশ। আমরা হুইসল-ব্লোয়ার, কেবল জানিয়ে রাখছি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: বিরোধী ঐক্য এক মরীচিকা
এ গল্পের শুরু সেই কৃষক আন্দোলনের দিন থেকে, দীপ সিধু বলে এক পঞ্জাবি অভিনেতা, কাম আইনজীবী কাম সোশ্যাল মিডিয়া আক্টিভিস্টকে আমরা দেখেছিলাম, কৃষক আন্দোলনের দিল্লি চলোর ডাকে যখন হাজার হাজার ট্রাক্টর দিল্লি যাচ্ছে, তখন কিছু ট্রাক্টরকে ঘুরিয়ে দেওয়া হল। রাস্তা না জানা কিছু আন্দোলনকারী ট্রাক্টরে চেপেই পৌঁছে গেলেন লালকেল্লা, আর সেখানেই আমরা দীপ সিধুকে দেখেছিলাম। তিনি তাঁর কিছু সহযোগী নিয়ে লালকেল্লার মাথায় কৃষক আন্দোলনের পতাকা নয়, শিখ ধর্মের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছেন। তুমুল হই হল্লার মধ্যে কৃষক নেতারা জানালেন, এই দীপ সিধু আন্দোলনের কেউ নন, তাঁর সঙ্গে কিছু ছবি পাওয়া গেল সানি দেওলের, অভিনেতা, বিজেপি এমপি। কিছু ছবিতে তিনি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে, আবার এটাও সত্যি যে তিনি তাঁর সোশ্যাল মিডিয়াতে কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করার কথাও বলেছেন। তিনি এক প্ল্যাটফর্মও তৈরি করেছিলেন ওয়ারিস পঞ্জাব দি। বেশ কিছু ফলোয়ার ছিল তাঁর, তিনি রাজনৈতিক কথা বলতেন, শিখ স্বতন্ত্রতার কথাও বলতেন কন্তু খালিস্তান গোছের কোনও কথা তিনি বলেননি। তো সেই তিনি ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ দিল্লি থেকে হরিয়ানায় নিজেই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন, রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটে, তিনি মারা যান। তাঁর অসংখ্য ভিডিওর মধ্যে একটা ছোট্ট ভিডিওতে তিনি অমৃতপাল সিং বলে দুবাইয়ে থাকে, এমন এক যুবকের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন এই ছেলেটি তাঁর সংগঠন ওয়ারিস পঞ্জাব দি-র শুভচিন্তক। ব্যস, পিরিয়ড, বেঁচে থাকা দীপ সিধুর কাছ থেকে অমৃতপাল সিং সম্পর্কে আর কোনও কথাই আমরা শুনিনি। আচ্ছা, এবারে আসুন জানা যাক, এই অমৃত পাল সিং, ইনি কে?
ইনি পাঞ্জাবের তরণতারণ এলাকার বাসিন্দা, বয়স যখন ২৩-২৪ তিনি চলে যান তাঁর কাকার কাছে দুবাইতে। সেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকতেন, কৃষক আন্দোলনের সময়ে আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, নেতাদের গালিগালাজ করেছেন, বলেছেন এরা সব বিকিয়ে যাওয়া নেতা। আর বলেছেন খালিস্তানের কথা, আনন্দপুর সাহিব প্রস্তাবের কথা, যে প্রস্তাবে প্রথম শিখ স্বাধীনতার কথা বলা হয়। ক্রমাগত বলে গেছেন। সেই তিনি দীপ সিধু মারা যাওয়ার চার মাস পর হঠাৎ পঞ্জাবে চলে এলেন। এসেই বললেন শহীদ ভিন্দ্রেলওয়ালার গ্রামে যাব, ১৫-১৮ গাড়ির কনভয় নিয়ে সেখানে গেলেন, শিখ রেওয়াজ মেনে অমৃত ছকনা, অমৃত জল পান করলেন, জানালেন তিনিই ওয়ারিস পঞ্জাব দি-র আসল উত্তরাধিকারি। ওয়ারিস পঞ্জাব দি-র সদস্যদের বিরাট অংশ তাঁকে অ্যাকসেপ্ট করল, তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে যা বলছেন তা হল, আমাদের খালিস্তান চাই, আরএসএস–বিজেপি হিন্দু রাষ্ট্র চায়, চাইতেই পারে, আমাদের কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু আমাদের খালিস্তান চাই। আমাদের আন্দোলন যদি গায়ের জোরে ভেঙে দেবার কথা বলেন অমিত শাহ, তাহলে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর পরিণতির কথাও মনে রাখুন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: কাকচরিত্র
তিনি তাঁর সমর্থকদের বলছেন এলাকায় ক্রিস্টানরা ধর্মান্তঃকরণের জন্য আসছে নজর রাখুন, স্থানীয় বিজেপি নেতারা এই কথায় বেজায় খুশি। মোহালিতে মোর্চা চলছে, সেখানে মধ্যে ছবি অমৃতপাল সিংয়ের, পাশে ভিন্দ্রানওয়ালা। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকারী বিয়ন্ত সিং, সতবন্ত সিংয়েরও ছবি রাখা আছে। এই ক’দিন আগে অপহরণের অভিযোগে পুলিশ এই অমৃতপাল সিংয়ের এক সহযোগীকে গ্রেফতার করেছিল, ভারত পাকিস্তানের সীমানা ঘেঁষে সেই আজনালা থানা ঘেরাও করল অমৃতপাল সিংয়ের সমর্থকরা। তারপরের ছবি দেখুন, (ছবি) পুলিশ সরে গেল, ব্যারিকেড ভেঙে মাথায় গুরুগ্রন্থসাহিব নিয়ে মারমুখী শিখ নিহাংরা ঘিরে ফেলল থানা। অভিযুক্তকে ছেড়ে শুধু দেওয়া হল তাই নয়, এসপি জানালেন, ওনারা ওই ছেলেটি যে নির্দোষ তার প্রমাণ এনে দেখানোর পরেই ছেলেটিকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। এই এসপির এখনও চাকরি যায়নি।
অমৃতপাল সিং সমর্থকদের সামনেই পুলিশকে বলেছেন, দিল্লিতে তো জানিয়েছিলেন যে আমার কোনও ক্ষমতাই নেই, এখন কত ক্ষমতা আছে দেখে নিন। মানে দিল্লি সরকারকে পঞ্জাব পুলিশ কী রিপোর্ট পাঠিয়েছে, তা ওনার জানা। পঞ্জাবের আপ সরকারের মুখে কথা নেই, কথায় কথায় ছড়া কাটা ভগবন্ত মান এই নিয়ে চুপ। ওদিকে সারা দেশ জুড়ে ভিজিলেন্স নিয়ে তাণ্ডব করে বেড়ানো মোদি-শাহ সরকারের ভূমিকাটা একবার দেখুন। এই অমৃতপাল সিং আজ প্রথম এই খালিস্তানের কথা বলছে না। কেবল বিরোধী খবর করেছে বলে সাংবাদিক অঙ্গদ সিংকে দেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, বহু সাংবাদিককে দেশের বাইরে যাবার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না, কিন্তু এই অমৃত পাল সিং ছাড়া গরুর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। যা ডকুমেন্টস আছে তাতে ওই দুবাই থেকে ফেরার সময়েই সরকার তাকে আটকাতে পারত, ভিন্দ্রালওয়ালা, সতবন্ত, বিয়ন্ত সিংয়ের মতো মানুষদের ছবি সাজিয়ে উসকানি দেবার জন্য গ্রেফতার করতে পারত। সরাসরি অমিত শাহকে হুমকি দেবার অভিযোগে জেলে পুরতে পারত, যেমনটা আরও শয়ে শয়ে লোককে বিনা প্রমাণেই গ্রেফতার করে জেলে রাখা হয়েছে তেমনই জেলে পচিয়ে মারতে পারত। কিন্তু না, মোদি-শাহ সরকার একটা কথাও বলছে না, কেন? তাহলে কি এটা গট আপ খেলা? পঞ্জাবে কংগ্রেস গেছে, আপের সরকার অত্যন্ত দুর্বল, এই সুযোগে একজনকে খাড়া করে রাজ্যে আইন শৃঙ্খলার সমস্যা তৈরি করে, জল ঘুলিয়ে ফায়দা তোলার চেষ্টা চলছে?
আর এই অমৃতপাল সিংয়ের পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছে কে? ইডি জানে না? অমিত শাহ জানে না? নাকি সব জেনেবুঝে ন্যাকামো করছে? একটা ছেলে, ৩০ বছরের এক যুবক, কোনও রাজনৈতিক ভিত্তি নেই। ২০২২ এর জুলাই মাসে দেশে এসেছে, সে আজ পঞ্জাবে হিরো, থানা ঘেরাও করে কয়েদি বার করে নিয়ে আসছে, সরকার কিছু করা তো দূরস্থান, বলছে ঠিকই আছে, সব চঙ্গা হ্যায়। ভিন্দ্রানওয়ালার সঙ্গে তফাতটা কোথায়? সেদিন জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালার ট্যালেন্ট হান্ট করেছিলেন জৈল সিং, দিল্লিতে বসে রিমোট কন্ট্রোলে চালাচ্ছিলেন পঞ্জাবের রাজনীতি। এনাকেও দিল্লি থেকেই রিমোট কন্ট্রোলে চালানো হচ্ছে, অন্তত তেমন মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। ভিন্দ্রানওয়ালার উত্থান এক বৈশাখীর দিনে হিংসার ঘটনা দিয়ে। না, অমৃতপাল সিংয়ের এই ট্রাক রেকর্ড এখনও নেই, কারণ তাঁকে আটকানোই হচ্ছে না। আজনালার ঘটনায় আটকানো হলেই রক্ত ঝরত, এক আধ জন নয়, বহু প্রাণ যেত। এবং যেটা বিরাট অমিল তা হল ভিন্দ্রানওয়ালা ঠারেঠোরে খালিস্তানের কথা বলতেন, নিজে দাবি করতেন না। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে মুচকি হেসে বলতেন, আমি তো খালিস্তান চাইছি না, কিন্তু বিবি দিলে নিয়ে নেব। বিবি মানে ইন্দিরা গান্ধী। পঞ্জাবিতে বিবি মানে মহিলা। কিন্তু আজ এই অমৃতপাল সিং প্রতিদিন নিয়ম করে খালিস্তানের কথা বলছেন, রোজ। আর পঞ্জাবে আমাদের বন্ধুদের চোখে ভেসে উঠছে সেই কালো অন্ধকার দিনগুলোর কথা, হাজারো লাশের কথা, হিন্দু-শিখ বিরোধিতার কথা। সবথেকে বড় কথা বললেন একজন কৃষক নেতা, তাঁর মতে দেশজোড়া কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি পঞ্জাব, সেখানে এই ধরনের এলিমেন্টকে সামনে রেখে সমস্যাগুলোকে গুলিয়ে দেবার চেষ্টার একটা অঙ্গ হল এই অমৃতপাল সিং। জানি না সত্যি কোনটা মিথ্যে কোনটা কিন্তু ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৩-এর পঞ্জাবের ঘটনা মাথায় রাখলে এই হঠাৎ উদয় হওয়া অমৃতপাল সিং আগামিদিনে বড় সমস্যা হয়ে উঠতেই পারে।