গুজরাত নির্বাচনের দিন ঘোষণা হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে হয়নি, কিন্তু গণনা হবে ৮ ডিসেম্বর এটা বলা হয়েছিল। হিমাচল ভোটের আগেই গুজরাত ভোটের ঘোষণা হল, নির্বাচন আচার সংহিতা এড়াতেই দিন ঘোষণার আগের দিনেই ওপিনিয়িন পোল দেখানো হয়ে গেল। বাছাই করা সেই সব মিডিয়া জানল কী করে যে গুজরাতের দিন ঘোষণা তারপরের দিনেই হবে? ম্যাজিক নম্বর ১। বিজেপি প্রবলভাবে এগিয়ে, ভোটের পার্সেন্টেজ সামান্য কমছে কিন্তু এগিয়ে বিজেপি, ১৩০/৩৫/৪০ আসন পেতে পারে। খেয়াল করুন তার আগেই অমিত শাহ বলেছেন ১৫০ আসন পাব ১৮২টায়। এখনও রেকর্ড কংগ্রেসের মাধব সিং সোলাঙ্কির সরকার, ১৪৯ পেয়েছিল। হিমাচল প্রদেশের ভোট শেষ, ভোট শেষ হয়ে গেলেই প্রথামতো এগজিট পোল দেখানোর কথা। তার আগেই নির্বাচন কমিশনের ফতোয়া এল, এগজিট পোল দেখানো যাবে না, গুজরাত নির্বাচন প্রভাবিত হতে পারে। গুজরাতের ওপিনিয়ন পোলে বিজেপির ক্লিন সুইপ হিমাচল প্রদেশে নির্বাচনে কোনও প্রভাবই ফেলবে না, কিন্তু হিমাচল প্রদেশের এগজিট পোল গুজরাত নির্বাচনে এত প্রভাব ফেলবে যে তাকে ফতোয়া দিয়ে বন্ধ করতে হল। কাহে ভাই? ইয়ে না ইনসাফি কিঁউ? ডাল মে কুছ তো কালা হ্যায়। কোথাও তো একটা ফাটা বাঁশে লেজ আটকেছে, না হলে এরকম ফতোয়া কেন?
একটু মাথা ঠান্ডা করে ভাবলেই দুটো জিনিস পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১) হিমাচলে বিজেপির অবস্থা বেশ খারাপ। ২) গুজরাতেও বিজেপি বাস্তব অবস্থাটা বুঝে উঠতে পারছে না। গুজরাত কি বিজেপির এক্কেবারে দুর্গ? মোদি–শাহের দুর্গ? অমিত শাহের গুজরাতের বাড়ি কোথায়? গান্ধীনগর মানসা বিধানসভায়। তো বিজেপির চাণক্যের এই আসনের ফলাফল কী? ২০১২তে, মানে অমিত শাহ তখন গুজরাতের হোম মিনিস্টার, সে বছর বিজেপির প্রার্থী ডি ডি প্যাটেল ওই মাসানা আসনে কংগ্রেস প্রার্থী অমিতভাই চৌধুরির কাছে হেরেছিলেন। ২০১৭তে কী হল? আগেরবারের কংগ্রেসের জেতা ক্যান্ডিডেট অমিতভাই চৌধুরিকে দল ভাঙিয়ে এনে বিজেপির টিকিট দিয়েছিলেন অমিত শাহ। কী হল? অমিতভাই চৌধুরি ওই আসনে কংগ্রেস প্রার্থী সুরেশকুমার প্যাটেলের কাছে হেরেছিলেন। নিজের জন্মস্থানের আসন বাঁচাতে পারেননি অমিত শাহ। মাসানা থেকে ৫১ কিলোমিটার দূরে উনঝা বিধানসভা, তো এখানে আবির্ভূত হয়েছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদিজি। ২০১৭তে কংগ্রেস প্রার্থী আশা বেন প্যাটেল এই আসনে ৫৪ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জিতেছিলেন, হারিয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থীকে। এ লজ্জা রাখব কোথায়? তো বিজেপির চাণক্য ওই আশা বেন প্যাটেলকে দল ভাঙিয়ে এনে ২০১৯-এর বাই ইলেকশনে জিতিয়ে আনলেন। এই হচ্ছে মিডিয়ার তৈরি করা বিজেপির গুজরাত দুর্গ। গতবার কান ঘেঁষে বেরিয়েছিল বিজেপি। গণনার সময় তো এক এক সময়ে মনে হয়েছে বিজেপি হেরেই যাবে, শেষমেশ ৯৯টা আসন নিয়ে জিতেছে বিজেপি। অবশ্য মাসদুয়েকের মধ্যেই দল ভাঙিয়ে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়েছে। তো এবারের নির্বাচনে ১৮২ আসনের বিধানসভায় প্রথমে ১৬০, পরে আরও কিছু আসনের প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিজেপি। না, কয়েকটা আসনে এখনও চিন্তাভাবনা চলছে, ওদিকে আপ এবং কংগ্রেস কিন্তু সবক’টা আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে, দুর্গের ফাটল পরিষ্কার, কতটা চওড়া সেটা বোঝা যাবে আরও কিছুদিন পরে। এই আসনগুলোর মধ্যে ৪০ জন সিটিং এমএলএ-কে টিকিট দেওয়া হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রুপানি, ডেপুটি চিফ মিনিস্টার নীতিন প্যাটেল, শিক্ষা মন্ত্রী ভূপিন্দর সিং চুরাসমা, হোম মিনিস্টার প্রদীপ সিং জাদেজা, শ্রম ও কর্মসংস্থান দপ্তরের মন্ত্রী ব্রিজেশ মেরজা টিকিট পাননি। এই ব্রিজেশ মেরজা আবার কংগ্রেস ছেড়ে এসে বিজেপিতে যোগ দিয়ে মোরবি থেকে এমএলএ হয়েছিলেন। ঠিক রাজ্যসভা ভোটের আগে বেশ কিছু কংগ্রেসি এমএলএ-কে দল থেকে ভাঙিয়ে রাজ্যসভার একটা আসন সুনিশ্চিত করেছিলেন বিজেপির চাণক্য অমিত শাহ। এই ব্রিজেশ মেরজাও তাদের একজন, কিন্তু তার বদলে এবার ২০১৭তে তিনি যাঁকে হারিয়েছিলেন সেই পুরনো আরএসএস কর্মী কান্তিলাল অমৃতিয়াকে টিকিট দেওয়া হয়েছে, ব্রিজেশ মেরজা নির্দল হিসেবে দাঁড়ানোর কথা ভাবছেন। স্বাভাবিক। মধু শ্রীবাস্তব বরোদরা থেকে টিকিট পাননি, নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। হর্ষদ মাসায়া, গুজরাত বিজেপির আদিবাসী মুখ, তিনিও টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়েছেন, গুজরাতে প্রায় ১৪-১৫ শতাংশ আদিবাসী ভোট আছে। কর্জন আসনে ২০১৭তে কংগ্রেসের টিকিটে জেতা অক্ষয় প্যাটেলকে টিকিট দেওয়ায়, গতবারের বিজেপি প্রার্থী সতীশ প্যাটেল নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সৌরাষ্ট্রের বিজেপির পরিচিত মুখ অরবিন্দ লাদানি টিকিট না পেয়ে প্রথমে অফিস ভাঙচুর করেছেন, পরে বিজেপি ছেড়ে নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। ওদিকে ক্রিকেটার রবীন্দ্র জাদেজার স্ত্রী রিবাবা জাদেজাকে টিকিট দেওয়া হয়েছে জামনগর নর্থ আসন থেকে। সেখানের সিটিং এমএলএ ধর্মেন্দ্র সিং জাদেজা, লোকে যাকে চেনে হাকোবা বলে, তিনি টিকিট পাননি, তিনি বসে গেছেন কিন্তু তাঁর বোন নৈনা জাদেজা, রিবাবা জাদেজার ননদ কংগ্রেস প্রার্থী দীপেন্দ্র সিং জাদেজার সমর্থনে নেমে পড়েছেন, দাদার দলবল পেছনে আছে। এই রিবাবা জাদেজার রাজনীতি শুরু কর্ণি সেনা থেকে যারা ক’দিন আগেই গান্ধী হত্যাকারীর গলায় মালা দিয়ে গান্ধী প্রয়াণ দিবসে উল্লাসে মেতে উঠেছিল। এই বিদ্রোহের আবহে অমিত শাহ গুজরাতেই আছেন, নরমে গরমে কতটা সামলানো যায় তা বোঝার চেষ্টা করছেন। ক্যান্ডিডেট সিলেকশন থেকে ৫টা জিনিস পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ১) বিজেপি মনে করে সরকারের বিরুদ্ধে কোনও অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি থাকে না, থাকে মন্ত্রী বা এমএলএদের বিরুদ্ধে, কাজেই বোতল পালটে একই তরল দিলে মানুষ তা ঢকঢক করেই খেয়ে নেবে, কাজেই মন্ত্রীদের টিকিট বাতিল। বেশ কিছু এমএলএও টিকিট পেল না। এটা বিজেপির প্রায় সব রাজ্যেই স্ট্রাটেজি, পিকেও এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। এমন কি মুখ্যমন্ত্রী বদল করে, মুখ্যমন্ত্রীকেও টিকিট না দিয়ে অ্যান্টি ইনকমব্যান্সির সঙ্গে লড়া যায় বলে বিজেপির ধারণা। কিন্তু এর ফলে জন্ম নেওয়া বিদ্রোহকে কীভাবে বিজেপি সামলাবে, সেটাই দেখার। ২) শহরের আসনে অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি বেশি কাজ করে, মিডিয়ার প্রচার ইত্যাদিই তার কারণ, গুজরাতে আবার এই শহরের আসনগুলোতে আপ-এর জবরদস্ত প্রচার আছে, কাজেই শহরে অনেক টিকিট কাটা গেছে, আমেদাবাদ, রাজ্য রাজধানীর ১৬টা আসনের ৩টে বাদ দিয়ে প্রত্যেক আসনে প্রার্থী বদল করা হয়েছে। রাজকোটের ৪টে আসনের ৪টেতেই প্রার্থী বদলে দেওয়া হয়েছে। ৩) রাজ্যের কোথাও কোনও আলাদা পাওয়ার সেন্টার তৈরি করতে দেওয়া যাবে না, সবটাই চলবে দিল্লি থেকে। কাজেই কিছু পুতুলকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসাও, এর জন্য এমএলএ-র প্রত্যেক টিকিটের দায়িত্ব ওই দিল্লির নেতাদের কাছে। যখন খুশি মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলা যাবে। বিপ্লব দেব থেকে ইয়েদুরিয়াপ্পা থেকে বিজয় রুপানির গল্প এটাই। ব্যতিক্রম ওই আদিত্যনাথ যোগী, কিন্তু সেটা ব্যতিক্রমই। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে যে হাইকমান্ড রাজনীতি চালু করেছিল কংগ্রেস, ঠিক তার জেরক্স কপি আজকে বিজেপির মোদি–শাহ নেতৃত্ব। কেবল মুখ্যমন্ত্রী নয়, মন্ত্রিসভা থেকে প্রকল্প সবটাই দিল্লি থেকে হবে, রাজ্যে রাবার স্ট্যাম্প সরকার থাকবে, আপাতত এটাই বিজেপির পলিসি। ৪) নির্বাচন আদর্শ দেখানোর জায়গা নয়। গোয়াতে, নাগাল্যান্ডে, মিজোরামে বিফ খাওয়া নিয়ে একটা কথাও বলা যাবে না। তামিলনাডুতে এক ভাষা নিয়ে নো বাওয়াল, বাংলায় রাজ্যভাগের কথা বলাই যাবে, মহারাষ্ট্রে নয়, এইরকম আর কী। আর দল ভাঙানো, সে তো মোদি–শাহের মূল মন্ত্র, না হলে এমন সরেস টাচ মি নট খোকাবাবু মিলবে কী করে? নির্বাচন জেতার জন্য যা যা করতে হবে করো, নির্বাচন শেষ হলে আবার আদর্শ ইত্যাদির কথা বলা যাবে। ৫) প্রতিটি রাজ্যে সিলেক্টেড লিডার উঠে আসুক, তাদের হঠাৎ তুলে এনে বসানো হবে, প্রয়োজনে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে। বাসবরাজ বোম্মাইকে কাল মুখমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দিলে একজনও বিরোধিতা করবেন না, ঠিক যেমন বিজয় রুপানি, নীতিন প্যাটেলকে কেবল পদত্যাগ করতে বলা হয়নি, তাদের এবার টিকিটও দেওয়া হয়নি, এঁরা ৬৬-৬৭ বছরের রাজনৈতিক নেতা, একজনও এঁদের সমর্থনে একটা কথাও বলেননি। ৩৫ শতাংশ সিটিং এমএলএকে টিকিট না দিয়ে, কংগ্রেস থেকে ১৯ জন প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে বিজেপির চাণক্য গুজরাতের লড়াই জেতার আশা করছেন, কিন্তু সে জেতার পথ কেকওয়াক তো নয়ই, কষ্টেসৃষ্টে জিততে পারলেও বড় জেতা হবে। কিন্তু রাজ্যের নাম গুজরাত, মোদি–শাহ ছাড়াও ৫ জন মন্ত্রী আছেন গুজরাত থেকে, এঁরা নামবেন, বাকিরাও যাবেন, টাকা উড়বে খোলামকুচির মতো, গুজরাত নির্বাচন বলে দেবে অমিত শাহ চাণক্য? নাকি এক হাফ প্যান্টুল কনস্টেবল।