কলকাতা: শব্দটা হল ‘নবজোয়ার’। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Abhishek Banerjee) এই জনসংযোগ কর্মসূচি (Nobojoyar campaign) শেষ হল শুক্রবার। আর শেষ হতে না হতেই যে প্রশ্নটা উত্থাপিত হচ্ছে, যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সফরের ইমপ্যাক্ট কী? জনজোয়ারের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ‘নবজোয়ার’। তার কারণ ‘নবজোয়ার’ শব্দটার মধ্যে রয়েছে ‘নব’। ‘নব’ মানে New বৈষ্ণব পদাবলীতে আছে – ‘নিতুই নব নিতুই নব, নব রে নব নিতুই নব’।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু করেছিলেন যে স্লোগানটা দিয়ে সেটা হচ্ছে, তৃণমূল কংগ্রেস ১০ বছর ক্ষমতাসীন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে অনেক কাজ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এখন ১০বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে একটা নেতিবাচক কিছুর প্রভাব রাজনীতিতে আসতেই পারে। সেটা Law of nature. এবং সেই Fault line repair করার কাজটা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় করবেন। একটা নতুন তৃণমূল কংগ্রেস পুরনো তৃণমূল কংগ্রেস থেকে আরও উন্নততর পথে এগিয়ে যাবে।
আমার বাবা পূর্বরেলের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তখন রেললাইনের উপর দিয়ে ট্রলি যেত। এবং সেই ট্রলির উপরে ছাতা থাকত। এবং ছাতার নিচে রেলের ইন্সপেক্টর, ইঞ্জিনিয়াররা বসে থাকতেন। সেই ট্রলিটাকে রেলের কর্মীরা ঠেলে দিত। এবং সেটা লাইনের উপর দিয়ে গড় গড় করে গড়িয়ে যেত। রেলের ট্র্যাক অর্থাৎ রেলের লাইন পরীক্ষা করতে করতে যেত। মাঝে মাঝে সেই ট্রলিগুলো থামত। বাবারা নামতেন। নেমে ওখানে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। যেখানে যেখানে রেলের ট্র্যাকের মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং কিছু সমস্যা। সেগুলি সমাধান করা হত। এটা একটা ম্যানুয়াল সিস্টেম। এখন এই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রেল ব্যবস্থাতে এই প্রথা চলে গেছে। এখন তো অনেক বেশী অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এসে গেছে। এখন তো আমার আলোচনা করছি Artificial Intelligence নিয়ে। সেই কৃত্রিম বুদ্ধি দিয়ে কতকিছুই না ঘটছে। এমনকি রাজনীতির ক্ষেত্রেও সাংঘাতিক ভাবে Artificial Intelligence আসছে। আধুনিক প্রযুক্তি আসছে। আগে গোটা পৃথিবীতেই জনসভাই ছিল সবথেকে বড় জনসংযোগের রাজনৈতিক কর্মসূচি। তারপর একটা সময় টেলিভিশন এলো। ইন্টারনেট এলো। কম্পিউটার এলো। এখন তো হাতে হাতে মোবাইল। জনসভায় রোদ্দুরের মধ্যে চাষী চাষের মাঠ ছেড়ে জনসভা দেখতে না গিয়ে চাষের মাঠে চাষ করতে করতে মোবাইলেই লাইভ দেখতে পারে রাজনৈতিক নেতাদের কর্মসূচি। এতদসত্ত্বেও ভারতের মতো এতবড় দেশে ১৩৫ কোটি মানুষের দেশ। এখানে কিন্তু এখনও ম্যানুয়াল জনসংযোগের প্রাসঙ্গিকতা আছে। তবে শুধু ভারত কেন গোটা পৃথিবীতেই তা এখনও হারিয়ে যায়নি। ওই অনেকটা Broadsheet খবরের কাগজ থেকে ট্যাবলয়েট। ট্যাবলয়েট থেকে ডিজিটাল। কিন্তু ডিজিটাল হলেও প্রিন্ট কাগজ যেরকম তার সার্কুলেশন কমে যেতে পারে। কিন্তু কৌলিন্য এখনও কমেনি। এবং এইভাবেই থেকে যায় নতুন নতুন ফর্মে পুরনো প্রথা। সেইরকম যতই আধুনিক প্রযুক্তি আসুক এই যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় গাড়িতে করে যাচ্ছেন। তিনি কোনও রথ তৈরি করেননি। যেরকম আডবানির রথ তৈরি হয়েছিল। এমনকি বরকত গণিখান চৌধুরীকেও আমি দেখেছি অলউইন নিশানে। যেটা আমি কভার করেছিলাম ওনার পেছনে পেছনে গাড়ির কনভয়তে থেকে। সেখানে গোটা পশ্চিমবঙ্গে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অলউইন নিশানের মধ্যে শোয়ার ব্যবস্থা। থাকার ব্যবস্থা। প্যান্ট্রি। নানারকমের ছিল। আজকাল তো মেকআপরুম পর্যন্ত রয়েছে। এইসব প্রযুক্তিগত উপাদান থাকলেও আসলে কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের আইবল কনট্যাক্ট। এবং জনসভায় দাঁড়িয়ে কথা বলা।
আরও পড়ুন: পঞ্চায়েত নির্বাচনের আকস্মিক ঘোষণা বিরোধীদের বিপাকে ফেলল?
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। দুই-ধারে সমবেত মানুষ। তাঁকে দেখে শুধু হাতনাড়া নয়, থেমে যাওয়া। কথা বলা। এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেটা করেছেন সেটাই কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অনুসরণ করছেন। অনুকরণ করছেন। কিন্তু ভালো জিনিস অনুকরণ করাও ভালো। এবং যেখানে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন, সেই রাজনৈতিক উত্তরাধিকারটা কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় করছেন। এটা তার জীবনে প্রথম রাজনৈতিক জনসংযোগ কর্মসূচি। এবং সেখানে কিন্তু তিনি সফল। এই কমিউনিকেশনটা কিন্তু কমিউনিকেশন এরার হয়নি। এই কমিউনিকেশনটা কিন্তু সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থন, আশীর্বাদ নিয়ে অভিষেক এগিয়েছেন। এই প্রচন্ড গরমের মধ্যে। এই প্রচন্ড আদ্র ঘেমো পরিস্থিতিতে এত মানুষ যেখানে কাতারে কাতারে এসেছে। সেখানে নিন্দুকেরা যতই বলুক এই ভীড়ের মধ্যে লোক টেনে আনা হয়েছে। ম্যানুফেকচার করা হয়েছে। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততার উপাদানও কিন্তু যে নেই তা নয়। বিভিন্ন জেলা থেকে যে রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে তাতে কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মানুষের সঙ্গে যোগসাধন তৈরী করার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে রাজনৈতিক কর্মসূচি সেটা সফল। এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে একটা নতুন বাতাসের প্রয়োজন ছিল। কেননা অভিষেক যখন শুরু করেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন, যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী পর্যন্ত এবারে মানুষ যাকে চাইছে তাকে দেয়া হবে। তস্করবৃত্তি করে এমন পারসেপশন আছে যাদের সম্পর্কে তারা অন্তত পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না। দলের মধ্যে বিক্ষোভ হয়েছে। সেখানে বেসরকারী সংস্থাকে দিয়ে সার্ভে করানো। আর দলতন্ত্রের মধ্যে সংঘাত বেধেছে। এতদসত্ত্বেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু তার অবস্থান থেকে সরে আসেননি। অনড় থেকেছেন। কেননা নতুন কিছু করতে গেলেই সবসময়ই এরকম বাধা বিপত্তি আসে। সেই বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে এতদিন ধরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে কর্মসূচি চালিয়েছে তার প্রভাব পঞ্চায়েত নির্বাচনে পড়তে বাধ্য। এবং তাতে কিন্তু মানুষের মধ্যে একটা সাড়া পড়েছে। একটা আলোড়ন হয়েছে।
আরও পড়ুন: দুর্নীতি খুব খারাপ কিন্তু ভোটে ইস্যু হয় না কেন?
একথা সত্য যে ভাঙরে ঘটনা ঘটছে। বা যে বোমাবাজির ঘটনা ঘটছে। এবং যেভাবে বিজেপি সেটাকে রাজনৈতিক মূলধন করতে চাইছে। অশান্তি, বিধ্বস্ত ভাঙরে রাজ্যপাল যাচ্ছেন। বিজয়গড় বাজারে লাগাতার দুষ্কৃতীর দাপট মনোনয়ন পর্বে ঘটছে। কাঠালিয়ার বিজয়গড় বাজার পরিদর্শন করতে গেলেন রাজ্যপাল। এই সমস্ত ঘটনায় বিজেপির দীর্ঘ মেয়াদী লাভ হতে পারে। এবং সেখানে তারা সেটাকে প্রচারের হাতিয়ার করতে পারে। পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলের পরও সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলতে পারে। বোমাবাজিটাকে শাসকদলের বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া। কেননা আইনশৃঙ্খলা রাজ্যসরকারের বিষয়। কিন্তু আধাসামরিক বাহিনী পাঠিয়েই হোক, আর কেন্দ্রের হস্তক্ষেপেই হোক, বিজেপির প্রচারেই হোক আসলে কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসই সবথেকে বেশী এগিয়ে আছে একথা নির্দ্বাধায় বলা যায়। এবং সেখানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই দুমাসব্যাপী নবজোয়ার নিশ্চয়ই একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আরও পড়ুন: নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের সাফল্যের রহস্য কী?