গতকাল আলোচনা করেছি বিজেপির চারটে ফর্মুলা নিয়ে। আজ আপ, আম আদমি পার্টির ফর্মুলা নিয়ে কথা। শুরুর আপ আর আজকের আপকে গুলিয়ে ফেলবেন না। এক দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন থেকে উঠে আসা আম আদমি পার্টি কিন্তু স্রেফ দুর্নীতি বিরোধিতার জন্য তৈরি হয়নি। সেটা ছিল বটে সামনের বিষয়, কিন্তু তার সঙ্গেও ছিল ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকা ধর্ম নিরপেক্ষতা, ছিল ওয়েলফেয়ার স্টেট-এর কথা, ছিল জঙ্গি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কথাবার্তা। স্রেফ উন্নয়ন আর দুর্নীতির বিরোধিতার জন্য আম আদমি পার্টি তৈরি হয়নি। ছিলেন যোগেন্দ্র যাদব, আশুতোষ, প্রশান্ত ভূষণ। ইন্ডিয়া এগেইন্সট করাপশন আন্দোলনে বিজেপি নেতারা, রামদেব, স্বাধ্বী ঋতাম্ভরা ইত্যাদিরা ছিলেন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, প্রশান্ত ভূষণ, আশুতোষ, যোগেন্দ্র যাদব ইত্যাদিরাও ছিলেন। বিজেপির উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসকে সরানো, তারা এই আন্দোলনের সমর্থনে নেমেছিল, বামেরা কংগ্রেস সরকারের থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছিল বটে, কিন্তু এই আন্দোলনে তারা ছিল না। তাই আন্দোলনের এক অংশ বাম, উদারবাদী রাজনীতির ধারায় ছিল, অন্য অংশ বিজেপির সঙ্গে। ২০১৪তে নরেন্দ্র মোদির প্রচার দেখুন, না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা, কালা ধন ওয়াপস লানা হ্যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। মূলত দুর্নীতি-মুক্ত ভারত তৈরির স্লোগান, পরে যা কংগ্রেস-মুক্ত ভারতে বদলে যায়। আম আদমি পার্টি কিন্তু বিজেপির বিরোধিতাই করছিল, তারা ২০১৩তে দিল্লি বিধানসভায় ৭০ এর মধ্যে ২৮টা আসন পায়। না, বিজেপির সঙ্গে নয়, কংগ্রেসের সঙ্গেই মিলে সরকার তৈরি করে। ২০১৪তে পালা বদল, কিন্তু আপ দিল্লিতে একটা লোকসভা আসনও পেল না। আবার ২০১৫তে সবাইকে চমকে দিয়ে ৭০ এ ৬৭টা আসন পায়, বিজেপি ৩টে। কংগ্রেস ধুয়ে মুছে সাফ। ঠিক এই সময় থেকে আপ নিজেকে পাল্টাতে শুরু করে, দলের মধ্যে লেফট টু সেন্টার যে সমস্ত নেতারা ছিলেন, প্রশান্ত ভূষণ, যোগেন্দ্র যাদব, আশুতোষ ইত্যাদিরা বেরিয়ে আসেন, আপের একচ্ছত্র নেতা হয়ে ওঠেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। সেই তখন থেকে আপ নিজেকে কোনওরকম রাজনৈতিক আদর্শ ইত্যাদি থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল গুড গভর্নেন্স, দুর্নীতি মুক্ত সরকার, উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, বস্তি উন্নয়ন ইত্যাদির মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। বিজেপির রাম মন্দিরে অরবিন্দ কেজরিওয়াল সস্ত্রীক হাজির হলেন, ফ্রি-তে তীর্থযাত্রা করানোর ব্যবস্থা করলেন, ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার সমর্থন করলেন। প্রচারের মধ্যে, নির্বাচনের দিন, ফল ঘোষণার দিন হনুমান মন্দিরে গেলেন, হনুমান চালিসা মুখস্থ বলে চমকে দিলেন, এখন তো কারেন্সি নোটে, টাকায় গান্ধীর বদলে লক্ষ্মী গণেশের ছবি দেবার কথাও বলছেন। গুজরাতে গিয়ে বিলকিস বানোর গণ ধর্ষণকারীদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে একটা শব্দও খরচ করেননি কেজরিওয়াল। এ এক নতুন আপ, এ আপ কেজরিওয়ালের। ২০১৫ থেকে এক নতুন আপ তৈরি হয়েছে, যে বিজেপির বিকল্প হয়ে উঠতে চায়। সেই জন্যই সে কেবল সফট হিন্দুত্ব নয়, আপ হয়ে উঠতে চায় নরম বিজেপি। তার ফর্মুলা নম্বর ১ হল, কংগ্রেসের বিরোধিতা। আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল ভাল করেই জানেন বিজেপি হার্ড টার্গেট। বিজেপির সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ের আগে সে কংগ্রেসের সঙ্গে লড়ে তার জমি পেতে চায়। পেয়েওছে। দিল্লিতে কংগ্রেসকে হারিয়েছে, দিল্লি দখলের পর বিজেপির হাত থেকে মিউনিসিপ্যালিটি কেড়ে নিল। কংগ্রেস থাকলে এটা সম্ভব হত না। একইভাবে পাঞ্জাবে সোজাসুজি লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গে, বিজেপি সেখানে কোনও ফ্যাক্টরই নয়। গুজরাতের ফর্মুলাও একই, কংগ্রেসের ভোট কেটে ১২ শতাংশ এর বেশি ভোট পেয়েছে আপ, কারণ বিজেপি তার আগের ৪৬ শতাংশের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে। বিজেপিও খানিকটা কংগ্রেসের ভোট কেটেছে, আপ বেশি কেটেছে, তার পাওয়া ১২ শতাংশ ভোটের ৯০ শতাংশই কংগ্রেসের ভোট। আপ-এর ফর্মুলা নম্বর ১ হচ্ছে আপাতত কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে ওঠা, জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের বদলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। ফর্মুলা নম্বর দুই, দিল্লি শিক্ষা, বিদ্যুৎ, বস্তি উন্নয়নকে এক মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়ে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা। ফর্মুলা নম্বর তিন, সেকুলারিজম ইত্যাদি নিয়ে মাথা না ঘামানো, হিন্দুত্ব প্রশ্নে দ্বিধাহীনভাবেই হিন্দু কার্ড খেলতে থাকা, এই ফর্মুলা অনুযায়ীই তারা বিজেপিকে হিন্দুত্ব প্রশ্নে একবারও আক্রমণ করতে চায় না। ফর্মুলা নম্বর চার, থার্ড ফ্রন্ট, বিরোধী ঐক্য, মহাজোট ইত্যাদি এড়িয়ে চলা। নির্বাচন হয়ে যাক, যার যত নম্বর সেই হিসেবে খেলা হবে, এটাই তাদের স্ট্রাটেজি। ফর্মুলা নম্বর ৫ হল মোদির বিরুদ্ধে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে তুলে ধরা, মানুষকে মোদীর বিকল্প হিসেবে একজন আরও সৎ, শিক্ষিত কমন ম্যান ইমেজকে দাঁড় করানো। এই ৫টা ফর্মুলা নিয়ে আম আদমি পার্টি জাতীয় রাজনীতিতে। কিন্তু তাদের ফর্মুলাতে বিস্তর গন্ডগোল। সাফল্য এসেছে, কিন্তু সে সাফল্যকে ধরে রাখা এবং কংগ্রেসের জাতীয় বিকল্প হয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। আপাতত তারা কংগ্রেসের কিছু ভোট কাটতে পারে, যেমন গুজরাতে কেটেছে, কিন্তু তার বেশি কিছু সম্ভব নয়, এবং সেই ভোট কাটার পরে তাকে ধরে রাখা আরও অসম্ভব, এরই মধ্যে গুজরাটে নির্বাচিত ৫ বিধায়কের মুখে অন্য স্বর শোনা যাচ্ছে। তারা লক স্টক ব্যারেল বিজেপিতেও চলে যেতে পারে। এবং গুজরাতের পরে আপ এক ভোট কাটুয়া দল, এই পার্সেপশনও তৈরি হচ্ছে। পরের নির্বাচন কর্নাটকে, সেখানে বাজে ফল হলে আপ-এর কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে ওঠার স্বপ্ন মাঠে মারা যাবে। আসুন আপ-এর ফর্মুলা নম্বর দুইয়ের গন্ডগোলগুলোকে দেখে নেওয়া যাক। ভারতবর্ষ এক বিরাট দেশ, জনসংখ্যায় আর কিছুদিনের মধ্যে সবচেয়ে ওপরে থাকবে। আর বৈচিত্র্যে পৃথিবীর যে কোনও দেশকে হার মানাবে। কংগ্রেসের রাজনীতি স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে শুরু, মধ্য থেকে বামে গেছে, ডানে গেছে, কিন্তু তার এক রাজনৈতিক অবস্থান আছে, বিলুপ্ত হতে হতেও যা ফিনিক্স পাখির মতো ফিরে আসে। অন্যদিকে বিজেপির রাজনৈতিক অবস্থান আরএসএস-এর দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি, আরএসএসও যাত্রা শুরু করেছিল সেই ১৯২৫ এ। তারাও বিভিন্ন ওঠানামা পার করে আজ ক্ষমতায়। অন্তত উত্তর ভারতের গোবলয়ে তাদের রাজনৈতিক সামাজিক দখলদারি আছে, অনেকের চেয়ে বেশি আছে। আমাদের দেশের আরেক রাজনৈতিক ধারা হল সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্টদের, তাদেরও এক নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান আছে। কাজেই এক শক্তপোক্ত রাজনৈতিক সামাজিক দর্শন ছাড়া হঠাৎ কোনও দল ফ্রি বিদ্যুৎ, শিক্ষা, ফ্রিতে বাসের টিকিট আর কলের জলের কথা বলে বাকিদের সরিয়ে নিজেদের জায়গা করে নেবে, তা সম্ভব নয়। এক পালটা শক্তিশালী রাজনৈতিক সামাজিক অবস্থান দরকার, যা আম আদমি পার্টির নেই। গোটা দেশের মানুষ রোটি কাপড়া মকান বিজলি সড়ক পানি চায় বটে, কিন্তু সেই চাহিদার সঙ্গে এক সামাজিক রাজনৈতিক দর্শনও জরুরি, যা আম আদমি পার্টির নেই। ফর্মুলা নম্বর তিন, নরম বিজেপি হয়ে ওঠা, হিন্দুত্বের প্রশ্নে বিজেপিকে আক্রমণ না করা। এই ফর্মুলা আসলে বিজেপির বি টিম হয়ে ওঠার ফর্মুলা, কিন্তু এ টিম যখন গোলের পর গোল দিয়ে যাচ্ছে, তাদের হিন্দুত্বের স্লোগান যখন অত চড়া তখন কেবল টাকায় গণেশ লক্ষ্মী বসানোর কথা বলে লাভ হবে? গুজরাত দেখিয়ে দিল লাভ হবে না, হেমন্ত শ্যামল সতীনাথের বদলে হেমন্তকণ্ঠী, শ্যামলকণ্ঠী বা সতীনাথকণ্ঠীদের চাহিদা বেশি হতে পারে না। যারা বিজেপির উগ্র হিন্দুয়ানায় মজবেন, তাদের কাছে কেজরিওয়ালের নরম হিন্দুত্ব কোনও কাজে দেবে না। উলটে দিল্লিতে মুসলমান ভোট সরে গেছে আম আদমি পার্টির থেকে, এটাই হবে, আমও যাবে, ছালাও যাবে। থার্ড ফ্রন্ট, বিরোধী ঐক্য, মহাজোট ইত্যাদিকে এড়িয়ে একলা চলার চার নম্বর ফর্মুলা সারা দেশে আপকে একঘরে ফেলে দেবে, সংসদে বিরোধী বোঝাপড়ার দরকার আছে, বিজেপির আক্রমণের মুখে বিরোধী জোটেরও দরকার আছে, এবং এই ফর্মুলা যে কাজে দেবে না, সেটা ওনারা ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন। গুজরাত রেজাল্ট বার হবার পরের দিনেই আপ নেতা সঞ্জয় সিং কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের ডাকা বৈঠকে হাজির হলেন। দেশের বিজেপি বিরোধী নেতারা জানেন, বলা ভাল বুঝতে পেরেছেন আনুষ্ঠানিক মহাজোট হোক না হোক, একটা বোঝাপড়া থাকা জরুরি। আপ পাঞ্জাবের সাফল্যে এই কথা ভুলেছিল, গুজরাতের ব্যর্থতা সম্ভবত তাদের একলা চলো রে পথ থেকে সরিয়ে আনবে। ৫ নম্বর ফর্মুলা হল মোদির বিরুদ্ধে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে প্রজেক্ট করা। দিল্লি একটা আধা রাজ্য, পাঞ্জাব সেই অর্থে মাঝারি রাজ্য, এর ওপর ভর করে একটা জাতীয় নেতার মুখ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বরং আরও অনেকের সঙ্গে থেকে দেশের অন্যতম বিরোধী নেতা হওয়াটা সম্ভব, সেটা যত তাড়াতাড়ি কেজরিওয়াল বুঝতে পারবেন, ততই মঙ্গল। কারণ আপ দেশের রাজনীতিতে এক নতুন হাওয়া এনেছিল, ফ্রেশ, শিক্ষিত, মানুষের কাজ করতে চায়, দুর্নীতির থেকে দূরে থাকা দল, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা দল হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতাও গড়ে উঠছিল। এখন তা অন্য পাঁচটা রিজিওনাল দলের মতো এক নেতা সর্বস্ব, ক্ষমতা দখলে আপস করে চলা দল হয়ে উঠেছে। তার কোনও ফর্মুলাই আর কাজে দিচ্ছে না। আগামী ২০২৪-এর আগে আপ কর্নাটকে দারুণ কিছু না করে দেখালে, তাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা বাদই দিলাম, দলের অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি হবে। আর রাজনৈতিক সমীক্ষকরা ভালো করেই জানেন কর্নাটকে আপ কিছুই করে উঠতে পারবে না। আগামিকাল কংগ্রেস, গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টির ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা করব সঙ্গে থাকবেন।