বর্ধমান: পুজো এলেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন বছর সত্তরের বৃদ্ধা শোভা গুপ্তা। বর্ধমান স্টেশনের পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে সিঁড়ির নীচে ছোট্ট দোকান চালান তিনি৷ কিন্তু দুর্গাপুজো এলেই মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর।
কারণ, আট বছর আগে মহালয়ার ঠিক দু’দিন আগে ছেলেকে হারিয়েছিলেন৷ তাই পুজোয় বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দি রাখেন তিনি৷ সমস্ত আনন্দ থেকে দূরে থাকেন শোভা দেবী। তাঁরই জীবনের গল্প দিন কয়েক আগে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়৷ মৌসুমি চ্যাটার্জি নামে এক ভদ্র মহিলার শোভা দেবীর লড়াইয়ে কথা নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেন৷ সেই পোস্ট এ কদিনে ২০০০ শেয়ার হয়েছে৷ লাইক ইমোজি দিয়েছেন প্রায় চার হাজার জন৷ মতামত জানিয়েছেন সাড়ে সাতশো জনের বেশি মানুষ৷
মৌসুমি চ্যাটার্জির ফেসবুক পোস্ট।
মৌসুমি চ্যাটার্জি ফেসবুকে যতটুকু লেখেন তার থেকেই বেশি বেদনাদায়ক শোভা দেবীর জীবন৷ কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি৷ সাতাত্তর বছর বয়সেও লড়াই চালিয়েছে যাচ্ছেন৷ সিক্সে পড়া নানতিকে নিয়ে কোনও রকম দিন চলে যাচ্ছে৷ দু’বেলা দু’মুঠো জুটছে কোনও রকমে৷ কিন্তু,শখ-আহ্লাদ কিছুই নেই৷ নাতনির সাধারণ চাহিদাও মেটাতে পারেন না তিনি৷
একাই ক্রেতা সামলাচ্ছেন শোভা দেবী। ছবি সংগৃহীত।
শোভাদেবীরা বর্ধমান শহরের লোকো কলোনি এলাকায় ভাড়া থাকতেন। তিনি জানান, ২০০৭ সালে তাঁর জীবনে প্রথম বিপর্যয় নেমে আসে। স্বামীকে হারান। তাঁরই কাঁধে তখন সংসারের জোয়াল চেপে বসে। বাধ্য হয়ে প্রতিবন্ধী বড় ছেলেকে নিয়ে দোকান করেন স্টেশনে। কিন্তু, সেটাও ঈশ্বরের সহ্য হল না। দোকানেই হৃদরোগে বড় ছেলে মারা যায়। বাঁচাতে পারলেন না- আক্ষেপ শোভার৷
ক্রেতার অপেক্ষায় শোভা দেবী। ছবি সংগৃহীত।
তারপর লড়াই আরও কঠিন হল৷ ছেলের দোকানেই রুটি ঘুগনি, চপ, মুড়ি, কচুরি বিক্রি শুরু করেন। ফের বিপর্যয়৷ করোনা মহামারী। লকডাউন৷ রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। পরে একটু একটু করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়৷ ফের প্লাটফর্মে সিঁড়ির নীচে দোকানে ফিরেছেন শোভাদেবী। রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে স্টেশনে হকার উচ্ছেদ হয়েছে৷ কিন্তু, শোভা দেবীর ৬ ফুট বাই ৪ ফুটের দোকানে কেউ থাবা বসায়নি। তাঁর দোকানে ১০ টাকায় তিনটি রুটি ও ঘুগনি মেলে। ডিম সিদ্ধ ও কচুরিও পাওয়া যায়। সে কথাও ফেসবুকে তুলে ধরেন মৌসুমি চ্যাটার্জি৷
আরও দেখুন-জুতো দিয়ে পুজো মণ্ডপ, ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগ বিজেপির, পাল্টা কটাক্ষ ফিরহাদের
শোভা দেবী জানান, অনেকেই সকালে বাড়ির কাজ সেরে স্টেশনে চলে আসেন। সস্তায় রুটি খান হকার থেকে সাধারণ মানুষ। বিক্রিবাটা দ্রুত হলে ১১টা, না হলে বাড়ি ফিরতে বেলা তিনটে বাজে৷ তিনি বলেন, ‘মহালয়ার দু’দিন আগে ছেলেটা চলে গেল। এত কষ্ট সত্ত্বেও কারও কাছে হাত পাতিনি। খেটে খাই। বাকি জীবনটা এভাবেই কাটিয়ে দিতে চাই।’ চোখের সামনে স্বামী, বড় ছেলেকে চলে যেতে দেখেছেন শোভাদেবী। তবুও লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েননি। বাস্তবের মাটিতে তিনিই আসল দুর্গা৷ নারী শক্তির জ্বলন্ত উদাহরণ।