বিজেপি, কংগ্রেস, আপ। তিনটে আলাদা দল, তিনটে আলাদা ফর্মুলা। আজ এই তিন ফর্মুলা নিয়েই আলোচনা। ২০২৪-এর আগে পর্যন্ত এই তিন দলের ফর্মুলা বদলাবে না। আর এই ফর্মুলাকে কাজে লাগিয়েই ২০২৪-এর মাঠে নামতে চাইছে তিন দল। অবশ্যই সেই মাঠে আরও অনেক প্লেয়ার থাকবে, লড়াইয়ের কায়দা বদলাবে, পার্টনার বদলে যাবে। সবার অলক্ষ্যে পাস এসে যাবে, অন্য কেউ বল পাঠিয়ে দেবে বার পোস্টের মাঝখানে। কিন্তু আপাতত প্র্যাকটিস ম্যাচ, এই ম্যাচগুলোতে এক নির্দিষ্ট ফর্মুলা মেনেই কাজ করবে এই তিন রাজনৈতিক দল। দিল্লির সরকারে আছে বিজেপি, ২০১৪ থেকে খুব পরিষ্কার যে তারা প্রশাসন, প্রত্যেকটা এজেন্সিকে কাজে লাগাবে। ইডি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স ইত্যাদি এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতির ছাপ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। না আমি একবারও এটা বলছি না যে দুর্নীতির সব অভিযোগ মিথ্যে, না তা নয়। দুর্নীতি আছে, সব দলেই আছে, সব সরকারেই আছে, কিন্তু মোদি–শাহ সরকারের এজেন্সিগুলো কেবল বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিরোধী সরকার, বিরোধী রাজনৈতিক দলকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করছে এমন ব্যবসায়ীদের দিকেই নজর রেখেছে। আগামিকালই যদি কেষ্ট মোড়ল তাঁর আনুগত্য পালটে ফেলেন, তাহলেই তাঁর বিরুদ্ধের সব অভিযোগ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে, অসমের হিমন্ত বিশ্বশর্মা কিম্বা আমাদের কাঁথির টাচ মি নট খোকাবাবু সারদা, নারদার অন্যতম অভিযুক্ত, ভিজিলেন্স এজেন্সির একটারও ঘাড়ে কটা মাথা যে তাঁদের দফতরে ডেকে পাঠিয়ে জেরা করবে? গ্রেফতার তো দূর অস্ত। এটা বিজেপির ফর্মুলা নম্বর এক, তারা মনোযোগ দিয়ে এই কাজ করছে। আর আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রশাসনিক কাঠামো এমনই যে দুর্নীতি খুঁজতে বেশি সময় লাগেও না। এই ফর্মুলা কেবল দুর্নীতি ধরা নয়, সেই দুর্নীতির ব্যাপক প্রচার করা, একটা পার্সেপসন তৈরি করা। তার জন্য বিভিন্ন পদে বসানো তাদের স্নেহধন্য মানুষ আছে, তাদের কেউ বিচারপতি হতে পারে, পুলিশকর্তা হতে পারে, সাহিত্যিক, কবি হতেই পারে। তাঁরা এই পার্সেপশন তৈরি করতে সাহায্য করবে। তাদের মধ্যে কেউ রোগী দেখতে দেখতেই বলে দেবেন এ এক ভয়ঙ্কর অরাজকতা চলছে, কেউ কাঠগড়ায় আসামিকে দাঁড় করিয়ে বলে দেবেন, তুমি তো আসল চোর নও, আসল চোরকেও জেলে পাঠাব, কোনও এক প্রাক্তন পুলিশ অফিসার হাজতে মৃত্যু নিয়ে এমন সরব হবেন যা দেখে আপনার মনে হবে এই প্রথম এমন ঘটনা হল। এইসব পদ্ধতিতে এক পার্সেপশন তৈরি হবে, আম আদমির মগজ ধোলাই যাকে বলে। বিজেপির ফর্মুলা নম্বর দুই হল এক জঙ্গি জাতীয়তাবাদ। আমরাই দেশপ্রেমী, ৫৬ ইঞ্চি কা সিনা, ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে। হঠাৎ প্রচার বিশ্বের ২০টা উন্নত দেশ এবং অঞ্চলের মানুষ নাকি মোদিজির হাতেই দিয়েছেন নেতৃত্ব, জি টোয়েন্টির আয়োজক হওয়ার সুবাদে এই প্রচার সর্বত্র। তিন নম্বর ফর্মুলা হল হিন্দুত্ব। এর আগে এমনকী অটলবিহারীর সরকারেও প্রধানমন্ত্রী ইফতারের আয়োজন করতেন, কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী বা অকংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রীদের কেউ বাদ দেননি। মোদিজি দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে, সরকারে, মন্ত্রিত্বে, বিভিন্ন কমিটির মাথায়, সামরিক বাহিনীর মাথায়, রাষ্ট্রপতি পদে বসেছেন মুসলমান ধর্মের মানুষ, বসাটাই স্বাভাবিক, তাঁরা দেশের ১৮ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধি। মোদিজি আসার পরে? ভ্যানিশ। তাঁর মন্ত্রিসভায় নাম কে ওয়াস্তে একজন ছিলেন, সেই মুখতার আব্বাস নকভি, বাদ পড়েছেন। কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন সংখ্যালঘু আমলাও নেই। সচেতনভাবেই বাদ দেওয়া হয়েছে। মাথায় চওড়া চন্দনের টিকা নিয়ে জনসভায় অনায়াসে হাজির হন, ঠাট্টা করেন সেকুলার শব্দটাকে নিয়ে, এটাই মোদিজি। জওহরলাল নেহেরু মনেপ্রাণে সমাজতান্ত্রিক ছিলেন, সরকার চালাতে এসে সেই সমাজতন্ত্র শিকেয় তুলে রেখেছেন, উদার গণতন্ত্রের কথা বলে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন ইন্দিরা গান্ধী, আজীবন কমিউনিস্ট পার্টিতে থেকেও সরকারে বসে কমিউনিস্ট আদর্শের বিপরীতে গেছেন ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, চতুরানন মিশ্র, জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাষ্ট্রের কল্যাণকর ভূমিকার কথা বলেই কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচে দিয়েছেন, বেচে দেওয়ার শুরুয়াত তো ওই সময়েই। আমরা বুঝেছি, সরকার অতি বিষম বস্তু, সরকারে বসলে আদর্শের সঙ্গে এমন লুকোচুরিই স্বাভাবিক, অটল সরকার একবারের জন্যও রাম মন্দির, ৩৭০ ধারা নিয়ে কথা বলেননি। মোদি সরকার আলাদা, নরেন্দ্র মোদি ব্যতিক্রম, যে কথা তিনি আরএসএস প্রচারক হিসেবে বলেছেন, সেই কথাই তিনি আজও বলে চলেছেন, অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন, এটাই বিজেপির ফর্মুলা নম্বর তিন। হিন্দুত্বের কথা এত জোরে তারা বলছে যে তার বিরোধিতা করা দূরস্থান, বিরোধীরাও মন্দিরে ঢুকে নিজেদের হিন্দু বলে ঘোষণা করছে, ম্যায় হু জনেয়ু ধারী ব্রাহ্মণ, আমি পৈতে পরা ব্রাহ্মণ, কিছুদিন আগেই রাহুল গান্ধী বলেছেন, হাততালি প্রাপ্য নরেন্দ্র মোদির। ফর্মুলা চার মোদিজি নিজেই। কবে, আর কোন প্রধানমন্ত্রীর মুখোশ দেখেছেন বাজারে? জনসভার সামনের রো-তে অসংখ্য মোদি, দেখেছেন ইন্দিরা বা জওহরলাল বা রাজীব গান্ধীর সময়ে? এটাই অত্যন্ত সযত্নে গড়ে তোলা মোদি ম্যাজিক। জনসভায় ভাষণ দেননি নেহেরু? দিয়েছেন, অসম্ভব ভাল বলতেন। নেতাজি ছাড়া তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না, প্যাটেলও নয়। কিন্তু শুনেছেন নাকি, নেহেরু নেহেরু নেহেরু বলে সমবেত চিৎকার? ইন্দিরা ইন্দিরা ইন্দিরা বা রাজীব রাজীব রাজীব বলে চিৎকার? মোদিজি মিত্রোঁওওও বলে থেমে যান, উনি জানেন এবার মাঠ জুড়ে শুরু হবে মোদি ম্যাজিক, মোদি, মোদি, মোদি। দিনে ৬টা অনুষ্ঠান থাকলে ৬টা আলাদা জামাকাপড়ে দেখা যাবে মোদিজিকে, যা আগের কোনও রাষ্ট্রপ্রধানকে দেখা যায়নি। আমাদের আগের কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের একান্তভাবে নিজের ব্যবহারের জন্য প্লেন ছিল না, মোদিজির আছে, গত ৭ বছরে ৬৯ বার বিদেশে গেছেন তিনি। একটা প্রেস মিট করেননি। তাঁকে দেখা যায়নি তাঁর সহধর্মিনীর সঙ্গে, যদিও তিনি চাপে পড়ে অনেক পরেই জানিয়েছেন যে তিনি বিবাহিত। মাকে প্রণাম করতে যান আমেদাবাদে, অদুরেই থাকেন যশোদাবেন মোদি, না সেখানে কোনওদিন যাননি। এক অনন্য চরিত্র আঁকা হয়েছে, বোঝানো হয়েছে, পার্সেপশন তৈরি হয়েছে কর্মবীরের, চাওয়ালার, চৌকিদারের, ৫৬ ইঞ্চ কা সিনার। এটাই ফর্মুলা নম্বর চার। এই চার ফর্মুলার ওপর ভর করে মোদিজি, মোদি-শাহ, আরএসএস–বিজেপির নির্বাচন স্ট্রাটেজি তৈরি হয়।
এতদিন তাই হয়ে এসেছে। কিন্তু এই চার ফর্মুলার কার্যকারিতা কি কমছে? দিল্লি আর হিমাচলের হার কী বলে? আপনি বলবেন গুজরাতের ওই স্পেক্টাকুলার ভিক্টরির পরেও কি এই কথা বলা যায়? আরও বেশি করে বলা যায়। একই ফর্মুলা যদি এক জায়গায় দারুণ কাজ করে, অন্য দু’ জায়গায় মুখ থুবড়ে পড়ে, তাহলে সেই ফর্মুলায় গন্ডগোল আছে বইকী। ফর্মুলা নম্বর ১, এজেন্সি পাঠিয়ে বিরোধীদের দুর্নীতির খবর ছড়িয়ে দাও। এই ফর্মুলা কোথাও কোথাও বুমেরাং হয়ে ফিরছে, রাজ্যে বিরোধী দলের সরকার ছোট হলেও তাদের পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি নেতাদের বিপদে ফেলছে। এটা হওয়ারই কথা, তোমরাও করছ, আমরাও করব। বিজেপির এই ফর্মুলা নম্বর ওয়ান-এ প্রথম প্রথম দারুণ কাজ হয়েছে, কিন্তু এখন এই ফর্মুলা তেমন কাজ করছে না। রাহুল, সোনিয়াকে ইডি ডাকল, কিন্তু সেই পার্সেপশন তৈরি হল না, উলটে রাহুল সোনিয়া এক ধরনের ক্লিন চিট পেলেন বলেই পাবলিক মনে করছে। মহারাষ্ট্রতে কাজ করছে কি? জানা নেই। তেলঙ্গানাতে কাজ করছে না, উপনির্বাচনের ফলাফল তাই বলছে, উলটে টিআরএস-এর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। আসলে ভয় দেখানোর অসুবিধে হল, একটা সময়ে ভয় ভেঙে যায়, ফর্মুলা ১ তার কার্যকরিতা একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে বলব না, কিন্তু হারাচ্ছে। ফর্মুলা ২, জঙ্গি জাতীয়তাবাদ। চীন ক্রমশঃ ঘাড়ের ওপর এসে বসছে, এবং তা নিয়ে মোদিজির মৌনতা মানুষ দেখছে। বালিতে গিয়ে শি জিনপিংয়ের মুখোমুখি মোদিজি, ভিডিওটা দেখুন, ওই ৫৬ ইঞ্চ কা সিনা বাওয়ালিটা যে আদতে বাওয়ালিই, তা পরিষ্কার। আর যাই হোক, চীন তো পাকিস্তান নয়, কাজেই ওই জঙ্গি জাতীয়তাবাদ মার খাচ্ছে। পাকিস্তানের বর্ডারে হাত দেওয়ার আগেই মোদিজিকে মাথায় রাখতে হচ্ছে চীন লাদাখে বসে রয়েছে। সেটাই সমস্যা। আর জঙ্গি জাতীয়তাবাদ কাজ করলে তা হিমাচলপ্রদেশেই করার কথা, সেখানে প্রত্যেক পরিবারে সৈনিক আছেন, শহীদ আছেন। না সেখানে কাজ করেনি। কাজেই এক্কেবারে মুখোমুখি যুদ্ধ ছাড়া এই আবেগকে আপাতত কাজে লাগানো মুশকিল, আর মুখোমুখি যুদ্ধের চিন্তা আপাতত মাথাতেও আনা সম্ভব নয়। কাজেই ফর্মুলা নম্বর দুই প্রায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। তার প্রধান কারণ বাণিজ্য, সামরিক ক্ষমতা আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকে চীনের উঠে আসা এবং সেই চীনের সঙ্গে আমাদের একাধিক পড়শি দেশ, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল এমনকী ভুটানেরও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠা। এবার ফর্মুলা নম্বর থ্রি, উগ্র হিন্দুত্ব। কার্যকর কিন্তু গোবলয়ের রাজ্যতে। যদিও হিমাচলে তা কাজ করল না, বিহারে কাজ করছে না। দক্ষিণে তো প্রশ্নই নেই, বাংলাতে বুমেরাং হয়েছে, উগ্র হিন্দুত্ব মুসলিম ভোটের মেরুকরণ আরও তীব্র করে তুলেছে। ঝাড়খণ্ড বা ওড়িশাতেও কাজ করেনি। হিসেব করলে অসম, ইউপি ছাড়া এই ফর্মুলা কাজ করেনি। মধ্যপ্রদেশে বিজেপি হেরেছিল, পরে দল ভাঙিয়েই ক্ষমতায় এসেছে। আসলে রাম মন্দির ওঁহি বনে গা স্লোগানটা তো আর কাজ করছে না, রাম মন্দির হয়ে গেছে, ৩৭০ ধারা উঠে গেছে, ইউনিফর্ম সিভিল কোডের মধ্যে বিজেপির চাহিদা ছিল, তিন তালাক বাতিল, তাও হয়ে গেছে কাজেই এই ফর্মুলাও কোথাও যেন তার ধার হারিয়েছে। ইয়েস, মোদি ম্যাজিক কাজ করছে, মোদি ম্যাজিক কাজ না করলে গুজরাতে বিজেপি জিতত না, হিমাচলে বিজেপি গোটা দশ আসন পেত। এখনও জাতীয় রাজনীতিতে মোদিজির কোনও বিকল্প নেই, হয়ে ওঠেনি। যেখানে মোদিজি নিজে লড়ছেন, সেখানে মোদিজি অ্যাডভানটেজ। গুজরাত মোদিজির হোম স্টেট, ওখানে মোদিজি থাকলে অন্য কারও জেতা সম্ভব নয়। গুজরাত দেশের দুই প্রবল প্রতাপশালী মোদি–শাহের রাজ্য, দুই সবথেকে বড়লোক ব্যবসায়ী আম্বানি–আদানির রাজ্য। কিন্তু বাকি রাজ্যে? কার্যকরী তো বটেই, মোদিজির র্যালি, মোদিজির ভাষণ, মোদিজির কাট আউট। কিন্তু তিনি সরাসরি ভোটে না থাকলে মোদি ম্যাজিক বার বার দেখানোর পরে আকর্ষণ হারাচ্ছে। বেশি ব্যবহারের ফল। সব মিলিয়ে বিজেপির চারটে ফর্মুলাই কিন্তু আকর্ষণ হারাচ্ছে, তাদের কার্যকরিতা কমছে। বিজেপিকে এটা নিয়ে আজ কিংবা কাল ভাবতেই হবে। আজ এই পর্যন্তই, কাল আলোচনা কংগ্রেস আর আপ, আর তাদের ফর্মুলা নিয়ে।