ওই আরররররণব গোস্বামী, গুল্লুবাবা, সুসুধীর চওধরি, নবিকা কুমার বা অঞ্জনা ওম মোদি ইত্যাদি কিছু ওই গোদি মিডিয়ার প্রোপাগান্ডিস্ট, প্রচারককে বাদ দিলে সাংবাদিকদের এক মহল তো বলছিল ২০২৪ ওপেন গেম, এনিবডিজ গেম। এখন সেই তারাই বলা শুরু করেছে ২০২৪ মোদি চাপে আছেন, চাকা কি অন্যদিকে ঘুরছে? বিরোধী দল তো ২০১৯ এও বলেছে, এবারেও বলছে, বিজেপি হারবে। এ ছাড়া কী-ই বা বলবেন তাঁরা? বিজেপি জিতবে? তা হয় নাকি? কিন্তু সমীক্ষক এবং বিভিন্ন সমীক্ষা একের পর এক খারাপ খবর আনছে। মহারাষ্ট্রের সকাল পত্রিকার এক সমীক্ষা জানিয়েছে, এই মুহূর্তে ভোট হলে এমভিএ, মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ি বিরাটভাবে জিতে আসবে। তাদের সমীক্ষায় আরও উল্লেখযোগ্য তথ্য হল কংগ্রেস জমি ফিরে পাচ্ছে। এরমধ্যে কর্নাটক বিচ্ছিরিভাবেই হাত থেকে চলে গেছে, হাতের কাছে গেছে। ওদিকে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার মণিপুরে, সে মণিপুর জ্বলছে। এদিকে এই শতাব্দীর সবথেকে বড় রেল দুর্ঘটনার ফলে মোদিজির বন্দে ভারতও প্রশ্নচিহ্নের মুখে। সবমিলিয়ে চাপের মুখে বিজেপি কেবল নয় মোদি সরকার, নরেন্দ্র মোদি–চাণক্য অমিত শাহ। ঠিক সেই সময়, আরএসএস জানিয়ে দিল, চাপ আছে কাকা। হ্যাঁ, আরএসএস-এর মুখপত্র দ্য অর্গানাইজার-এ সম্পাদক প্রফুল্ল কেতকর লিখছেন, কেবল হিন্দুত্ব আর মোদি ক্যারিশমা দিয়েই বৈতরণী পার হওয়া যাবে না। আরও অনেক কথাই লিখেছেন তা নিয়ে আলোচনা করবো। কিন্তু দ্য অর্গানাইজারে এই কথা লেখা হচ্ছে, লিখছেন স্বয়ং সম্পাদক, তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আগে দেখে নেওয়া যাক।
বুঝিয়ে বলি, সকাল বেলায় প্রফুল্ল কেতকরের মনে হল না, মোদির ক্যারিশমা কাজ করছে না, হিন্দুত্বও ঠিকঠাক কাজ করছে না কারণ জয় বজরঙ্গবলী বলে ইভিএম-এর বোতাম টেপার নোংরা আবেদনের পরেও কর্নাটকের মানুষ কান দেয়নি। যে কর্নাটক সেই অর্থে হনুমানের জন্মভূমি, যে কর্নাটকে ২০২৩-এ ৮৪ শতাংশ মানুষ হিন্দু। তো এইটা বুঝে প্রফুল্ল কেতকর পেন আর কাগজ নিয়ে এই কথাগুলো লিখে ফেললেন? Most For the Bharatiya Janata Party (BJP), it is the right time to take stock of the situation. Without strong leadership and effective delivery at the regional level, Prime Minister Modi’s charisma and Hindutva as an ideological glue would not be sufficient. এটাই তো সঠিক সময় যখন ভারতীয় জনতা পার্টির উচিত পরিস্থিতির বিচার বিশ্লেষণ করা। রাজ্যে রাজ্যে শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং এবং সেই নেতৃত্বের কার্যকরী ভূমিকা না থাকলে শুধুই মোদি ম্যাজিক আর হিন্দুত্বকেই আদর্শ হিসেবে ধরে থাকলে কাজ হবে না। সকালে উঠে তাঁর এই কথা মনে হল, আর তিনি সেটা লিখে ফেললেন? না এমনটা আরএসএস-এ হয় না, বিজেপিতে হয় না, কমিউনিস্ট পার্টিতে হয় না। এসব কংগ্রেসে হয়, জনতা দলে হয়, তৃণমূলেও হয়, আরএসএস–বিজেপিতে হয় না। আরএসএস বা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্রে কিছু ছাপা হলে, বিশেষ করে সম্পাদকীয় বা উত্তর সম্পাদকীয়তে কিছু লেখা হলে তার পেছনে গোটা সংগঠনের সায় থাকে। একটা ঘটনা বলি, সিপিআইএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির তালিকা বেরিয়েছে, কে কে আছে তা নিয়ে আলোচনা করছি আমরা, মানে সাংবাদিকরা। সাংবাদিক দেবাশিস ভট্টাচার্য সেদিন বলেছিলেন, কে কে তালিকাতে আছে সেটা জানা জরুরি, তার চেয়েও জরুরি হল তালিকার উপরে নীচে কারা আছে। তালিকা উপর থেকে নীচে যেভাবে সাজানো হয়েছে, সেটাও পার্টি নেতৃত্বের ঠিক করা, ওটা অ্যালফাবেটিকালি সাজানো হয় না। আরএসএস-এও তাই। এই লেখার আগে আলোচনা হয়েছে, সরসংঘচালক মোহন ভাগবত সায় দিয়েছেন, সংঘের সিনিয়র নেতারা সায় দিয়েছেন, তারপর ছাপা হয়েছে কেবল নয়, একটি বিশেষ কাগজকে দিয়েই তাকে ছড়িয়েও দেওয়া হয়েছে। ওঁরা জানেন ভালো করেই যে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা হবে, ওঁরা আলোচনার সূত্রপাত করে দিলেন। আরএসএস-কে এক আপাত নিরীহ সামাজিক সংগঠন হিসেবেই চিহ্নিত করেন সংঘের মানুষজন। কিন্তু আমরা সবাই জানি, আরএসএস হচ্ছে মাথা, তার দুটো জাতীয় মুখপত্র, দ্য অর্গানাইজার, পাঞ্চজন্য। তার রাজনৈতিক শাখা বিজেপি, শ্রমিক শাখা ভারতীয় মজদুর সংঘ, তার আরও অনেক সিস্টার অর্গানাইজেশন আছে, ছাত্র থেকে কৃষক, জঙ্গি বজরং দল থেকে হিন্দু জাগরণ সংঘ, সেনাবাহিনীর প্রাক্তনদের নিয়ে সংগঠন আছে। সব মিলিয়ে এক সহস্র শুঁড়ওয়ালা অক্টোপাস, মাথা নির্দেশ দেয় প্রতিটা শুঁড়কে, কী করিতে হইবে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | পরিযায়ী শ্রমিকের তত্ত্ব ভুল, তথ্যে জল মেশাচ্ছেন দিলীপ, শুভেন্দু
কমিউনিস্ট পার্টিতেও সরকারে থাকা মন্ত্রী ইত্যাদি দলের প্রধানদের নির্দেশেই চলেন, অন্তত চলার কথা, আরএসএস-ও ঠিক তেমনভাবেই বিজেপিকে চালায়। প্রতিটা কাজের ওপর কড়া নজর রাখে এবং নির্দেশ দেয়, সতর্ক করে, দিশা দেখায়। এমনটাই চলছিল, আরএসএস জনসঙ্ঘকে পথ দেখাত, তারপর জনতা দলে মিশে যাওয়া জনসঙ্ঘের নেতারা নির্দেশ পেতেন ওই আরএসএস সরসংঘচালকের কাছ থেকে। পরে বিজেপি তৈরি হল, রজ্জু ভাইয়া, রাজেন্দ্র সিং বা কে এস সুদর্শন প্রশ্নাতীতভাবেই বিজেপিকে নির্দেশ দিয়েছেন, জানিয়ে দিয়েছেন, কী করিতে হইবে। কিন্তু খেয়াল করুন, মোহন ভাগবত নরেন্দ্র মোদির থেকে মাত্র ছ’ দিনের ছোট, সমবয়সি। এবং মোদি নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন তা অকল্পনীয়। মোদি-শাহের নেতৃত্ব বিজেপির থেকে বড়, এমনকী আরএসএস-এর থেকেও উচ্চতায় আকারে বড়। কাজেই সেই পুরনো প্রশ্ন এসেই গেছে, কুকুর ল্যাজকে নাড়াবে না ল্যাজ কুকুরকে নাড়াবে? গত কিছু বছর জুড়েই বহু বহু ক্ষেত্রেই ওই ল্যাজ কুকুরকে নাড়িয়ে যাচ্ছে, সেখানেই মূল সমস্যা। বিজেপিতে নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহ আসার আগে এই হাইকমান্ড কালচার ছিল না, যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। দলের সভাপতি মানে সভাপতি, জে পি নাড্ডার মতো দুধুভাতু সভাপতি একজনও ছিল না। বকলমে দলকে চালাচ্ছেন অমিত শাহ এ তো আলাদা করে বলার দরকার নেই। বিজেপি এমনটা ছিল না। আরএসএস থেকে আসা নেতাদের এক অন্য ধরনের মর্যাদা ছিল। অনৈতিক কাজ নিয়ে বিস্তর মতভেদ ছিল, দল ভাঙানোর যে নির্লজ্জ খেলা চলছে, মানুষের চোখের সামনেই কোটি কোটি টাকা লেনদেন করে নির্বাচিত সরকার ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, এসব আগে ছিল না। রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির শক্তপোক্ত নেতা ছিল, যাঁরা কর্তাভজা ছিলেন না। শুভেন্দু, সুকান্ত আর দিলীপ ঘোষের পাশে তপন শিকদারকে রাখুন যিনি মুরলীধর লেনে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে থাকতেন, পণ্ডিত বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীকে রাখুন যিনি এক কামরার ঘরে খান তিন চার ধুতি পাঞ্জাবি নিয়েই দিন কাটিয়েছেন, কিন্তু দিল্লির আজ্ঞাবহ ছিলেন না, ক্রমাগত দিল্লি থেকে কেউ এসে দল কীভাবে চলবে তা বলতেন না। তপন শিকদারের মুখে কেউ কোনওদিন যশস্বী অটলবিহারিজি শুনেছেন? কারিয়াকর্তা? কী অদ্ভুত মিষ্টি বাংলা বলতেন বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী।
কিন্তু সে জমানা গয়া, আপাতত মোদিজি প্রধানমন্ত্রী আর অমিত শাহ দলের কাণ্ডারি, মোটা ভাই আর ছোটা মোটা ভাইয়ের হাতেই গোটা দল। প্রথমত এই দুজন নীতি নৈতিকতার ধার ধারেন না, এটা এনাদের গুজরাত অধ্যায়ের দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে। ক্ষমতা চাই, যে ভাবে হোক। বিজেপি তো ছেড়ে দিন দেশের একটা রাজনৈতিক দলও এতটা নীচে নামেনি কোনওদিন। পয়সা টাকা, ইডি, সিবিআই, ভিজিলেন্স, পদ যা যা ব্যবহার করা সম্ভব সব ব্যবহার করে চলেছেন এই দুজনে, দলের মধ্যে, দলের বাইরে। ওনাদের সঙ্গে না মিললে দলের নেতা ছিটকে যাবে, সাইডলাইনে বসে থাকবে। ওঁরা চান সম্পূর্ণ আনুগত্য। কাজেই রাজ্যে রাজ্যে অনুগত ভৃত্য তৈরি হচ্ছে, যাঁদের নিজেদের জোরে নির্বাচন জেতার ক্ষমতা নেই। যোগী আদিত্যনাথ আর হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে বাদ দিলে আর একজন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী নিজের জোরে দলকে রাজ্যে জিতিয়ে আনতে পারবেন না, দল জানে, পাবলিক জানে, আরএসএসও জানে। আচ্ছা এ কি একদিনে হয়েছে? না। তাহলে আগে আরএসএস-এর এই দ্য অর্গানাইজার বা পাঞ্চজন্য কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিল? না ছাপা বন্ধ ছিল? আসলে কথায় আছে, যো জিতা ওহি সিকন্দর। জিততে থাকলে কেউ কোনও প্রশ্ন করে না, চলতি কা নাম গাড়ি হ্যায়। কিন্তু হারলে প্রশ্ন ওঠে। ক’দিন আগেই ২০১৮তে দেশের ৭১ শতাংশ ভূখণ্ডে বিজেপির শাসন ছিল, আজ তা কমে ৪৩ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে নেতৃত্বের মধ্যে তুমুল আকচা আকচি। প্রত্যেকে মোদি–শাহকে খুশি করার কাজেই ব্যস্ত। সামনে পাঁচটা রাজ্যের নির্বাচন। বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া ঘোষিতভাবেই মোদি-শাহ বিরোধী, ছত্তিশগড়ে রমন সিং মোটাভাই আর ছোটা মোটা ভাইয়ের সুনজরে নেই, আর মধ্যপ্রদেশ এই দুজনে মিলেই গুলিয়ে দিয়ে এখন সামাল দিতে পারছেন না। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ২২ জন এমএলকে ভাঙিয়েছিলেন, তার পরেই মামাজি মানে শিবরাজ সিং চৌহানের সরকার তৈরি হয়। এখন নির্বাচন সামনে, ওই ২২ জন কংগ্রেসি বিধায়ক যাঁরা দল ছেড়েছিলেন, তাঁরা তো বিজেপির স্থানীয় নেতাদের হারিয়েই জিতেছিলেন, এখন সেই নেতারা কি বসে বসে আঙুল চুষবেন? তাঁরাও আসন চাইছেন, না পেলে নিশ্চিত দাঁড়িয়ে পড়বেন নির্বাচনে, ভোট কাটবেন। এবং জ্যোতিরাদিত্য বনাম মামাজি লড়াই তো আছেই। উত্তরপ্রদেশ, অসম, উত্তরাখণ্ড বাদ দিলে কোথায় স্বস্তিতে আছে বিজেপি? মহারাষ্ট্র আর মধ্যপ্রদেশ দল ভাঙিয়ে সরকার, কাজেই হারের মুখে দাঁড়িয়ে অন্য যে কোনও দলের মতোই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, সামনের মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় বা তেলঙ্গানায় বিজেপি হারলে দলের ভেতরের এই লড়াই আরও ছড়িয়ে পড়বে, তখন এই দুই মোটাভাইয়ের বহু দোষ তুলে ধরা হবে। কিন্তু ক্যাডার বেসড পার্টি এক বিরাট উচ্চতার থেকে পিছলে পড়ে গেলে আর উঠতে পারে না, ইতিহাস সাক্ষী। দ্য অর্গানাইজার, প্রফুল্ল কেতকর, আরএসএস এ কথা ভালো করেই জানে, জানে বলেই তাঁদের স্বপ্ন হিন্দুরাষ্ট্রের এতটা কাছে এসেও ইউ-টার্ন নেওয়ার মুখে তাঁরা এসওএস পাঠাচ্ছেন, জরুরি সিগন্যাল, সামাল সামাল রব উঠেছে। প্রশ্ন হল সামাল দেওয়া যাবে কি?