২০২৩ সাংবাদিকদের কাছে, সে রবীশ কুমার হোক আর অর্ণব গোস্বামীই হোক, প্রত্যেকের কাছেই এক দারুণ উত্তেজনাময় বছর। সারা বছরজুড়ে চলবে নির্বাচন। মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, ত্রিপুরা, তেলঙ্গানা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক এবং সম্ভবত কাশ্মীরে। তার মধ্যে মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরাতে আগামী মার্চ মাসে। তৃণমূল দল এককভাবেই মেঘালয়ে মোট ৬০টা আসনের মধ্যে ৫২টা আসনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে দিয়েছে। মানে উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে পিনাকেতে লাগে টংকার, পাঞ্চজন্য কার হাতে জানা নেই, তবে রণদামামা বেজে উঠেছে। কাজেই মাথায় রাখুন দেশ জুড়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমেত নকড়া ছকড়া মন্ত্রীরা, নিজের রাজ্যেই পরাজিত দুধুভাতু সভাপতি জে পি নাড্ডা ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করবেন। ফ্ল্যাগ, পোস্টার, লিফলেট যাঁরা ছাপেন, যাঁরা কাট আউট তৈরি করেন, মঞ্চ বাঁধেন, সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া দেন, গণতন্ত্রের এই নাচনে, ডান্স অফ ডেমোক্রসিতে তাঁদের রোজগার, অতএব তাঁরা তৈরি হচ্ছেন। মিডিয়া সাজাচ্ছে তাদের ঘুঁটি, গোদি মিডিয়া তাদের নিজ নিজ প্রভুদের ভজনার পুরো ব্লু প্রিন্ট, নীল নকশা ছকে ফেলেছে। এবং স্বাভাবিকভাবেই গভর্নেন্স গেছে চুলোর দোরে। মোদি সরকার এ বছর সেমিফাইনাল আর সামনের বছর ফাইনালের জন্য জান লড়িয়ে দেবে। ক্ষমতায় থাকা, নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় থাকাটাই লক্ষ্য। তার জন্য মিশন ১৪৪, মিশন ১৭২, নানান ছক চলছে। কী নিয়ে যাবেন মানুষের কাছে? রেকর্ড বেকারত্ব? রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি? কী করেছেন গত আট বছরে? সবার জন্য ঘর? হয়নি। সবার শিক্ষা হয়নি। সবার স্বাস্থ্য? অলীক কল্পনা। কৃষকের আয় বৃদ্ধি? বাড়া তো দূরস্থান, কমেছে। শিল্পে নেমে আসছে মন্দা। তাহলে? মানুষের কাছে কী নিয়ে যাবেন? আছে আছে অস্ত্র আছে। ছোটা মোটা ভাই, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গেলেন ত্রিপুরাতে। বললেন, রাহুল বাবা, কান খুল কর শুনলো, ১ জানুয়ারি অযোধ্যাতে গগনচুম্বী মন্দির উদ্বোধন হবে। ত্রিপুরাতে মার্চে ভোট, ৫ বছর শাসন করেছে বিজেপি সরকার, প্রথমে বিপ্লব দেব, পরে মানিক সাহা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। ভোটের ঢাক পেটাতে গিয়ে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বকলমে বিজেপির সংগঠনের এক নম্বর মানুষ আলোচনা করছেন বেকারত্ব নিয়ে নয়, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে নয়, আলোচনা হচ্ছে অযোধ্যার রামমন্দিরের উদ্বোধনের তারিখ নিয়ে। তার আগে তিনি বললেন, চিৎকার করে বললেন, এর আগে পাকিস্তান আমাদের সীমান্ত পার করে মেরে যেত, এই প্রথম পুলওয়ামার পরে সার্জিকাল স্ট্রাইক হল, পাকিস্তান বুঝল, দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কোনও মৌনিবাবা নয়। ইতিহাসে পাক-ভারত যুদ্ধ হয়েছে তিন তিনবার, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জওহরলাল নেহেরু, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধী। তিনবারই চূড়ান্ত পরাজয় হয়েছে পকিস্তানের। ১৯৭১-এ ইস্টার্ন কমান্ডের লেফটান্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাক লেফটেন্যান্ট জেনেরাল নিয়াজির আত্মসমর্পণের সেই ছবি এখনও সবার চোখের সামনে, তখন প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন? ইন্দিরা গান্ধী। কোন দল সরকারে? কংগ্রেস। কিন্তু ছোটা মোটা ভাই চিল্লিয়ে বললেন, এই প্রথম পাকিস্তান কো করারা জবাব মিলা। এসবই ছিল তেনার ভাষণ জুড়ে। তো তেনার তো আপাতত কাজ নির্বাচনী প্রচার করে বেড়ানো। সেই কাজেই তিনি গেলেন কর্নাটকের মান্ড্যাতে। সেখানে গিয়ে বললেন, আপনাদের বাছতে হবে যারা রামমন্দির তৈরি করেছে, যারা কাশী মথুরাকে ঢেলে সাজিয়েছে তাদের, না তাদের যারা টিপু সুলতানের ভক্ত। আপনাদের বাছতে হবে দেশপ্রেমিকদের বা ওই টুকরে টুকরে গ্যাংয়ের লোকজনদের। এ এক অদ্ভুত দল, দেশের সংসদে দেশের বিরোধী দলকে, দলের নেতাদের, এরা দেশদ্রোহী বলে, ইতিহাসে এর নজির কেবল হিটলার ছাড়া আর কেউ নেই, যিনি নাৎসি পার্টি বাদ দিয়ে জার্মানির প্রত্যেক দলকে দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করতেন। এবং কারা আজকের কংগ্রেস থেকে কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী থেকে বিরোধী সমস্ত দলকে দেশদ্রোহী বলছে? যারা, যাদের নেতা গুরুজিরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে ইংরেজদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আজ আলোচনা তা নিয়ে নয়। প্রশ্ন হল কেন এই বিজেপি নেতারা নির্বাচনের ময়দানে এই কথাগুলো বলছেন? ধরুন কর্নাটক বিজেপির দলনেতা নলীন কটিল জনসভাতেই বললেন, রাস্তা, আলো ইত্যাদি নিয়ে কথা বলার সময় এটা নয়, আপনি যদি লাভ জেহাদের বিরুদ্ধে হন তাহলে রাজ্যে বিজেপি সরকারকেই আনতে হবে। রাজ্য সভাপতি সাফ জানাচ্ছেন, রাস্তা, গর্ত, নালা ইস্যু নয়, লাভ জিহাদই হল ইস্যু। এবং সাধ্বী প্রজ্ঞা থেকে সম্বিত পাত্র থেকে দলের ছোট বড় মাঝারি নেতারা লাভ জেহাদ, রাম লালার মন্দির, রাহুল বাবা মুসলিমদের সঙ্গে আছে, আমরাই দেশপ্রেমী, বিরোধীরা দেশদ্রোহী এসব বলেই চলেছেন, কেন? এই বছর ১০টা রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ভোট। উত্তর পূর্বাঞ্চলের ছোট রাজ্যগুলোর কাছে ৫-৭ টা আসন রয়েছে, কিন্তু মধ্যপ্রদেশে ২৯টা, কর্নাটকে ২৮টা, রাজস্থানে ২৫টা, তেলঙ্গানায় ১৭টা, ছত্তিশগড়ে ১১টা, মোট ১১০টা লোকসভা আসন রয়েছে। গত ২০১৯ নির্বাচনে ছত্তিশগড়ে ৯টা, কর্নাটকে ২৫টা, মধ্যপ্রদেশে ২৮টা, তেলঙ্গানায় ৪টে, রাজস্থানে ২৫টা, মানে ১১০-এর ৯১টা আসন বিজেপির হাতেই ছিল। কিন্তু এই পাঁচ বছরে অনেকগুলো সমস্যা তৈরি হয়েছে। গতবার হেরে যাওয়া আসন জেতার যে বাওয়াল শুনছেন, সেগুলো নেহাতই ছেলে ভোলানো কথা। বিজেপির সমস্যা হল তাদের জেতা আসন ধরে রাখা। তার কারণ তারাও জানে, মোদি সরকার এমন কিছুই করেনি যা দেখে মানুষ গতবারের হারা আসনগুলো বিজেপির হাতে তুলে দেবে। বরং যে যে আসনে বিজেপি জিতেছিল, অন্তত সেই আসনগুলোকেই ধরে রাখতে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। আর এই পাঁচটা রাজ্যেও যদি বিজেপি ১০-১৫টা আসনও হারায় তাহলে বিজেপি কোনওভাবেই ২০০-২০৫-২১০ এর ওপরে উঠতে পারবে না। এবার সেই আসন ধরে রাখার ক্ষেত্রে বিজেপির তিনটে বড় সমস্যা হল, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে পুওর পারফর্ম্যান্স, মধ্যপ্রদেশে নিজের দলের বিধায়ক রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, কর্নাটকে তার থেকেও অবস্থা খারাপ, ইয়েদুরিয়াপ্পাকে সরিয়ে ভাসবরাজ বোম্মাইকে আনার পরে প্রশাসন ভেঙে পড়েছে, দুর্নীতির নতুন নতুন খবর বেরিয়ে আসছে। আবার কর্নাটক এক দক্ষিণী রাজ্য যেখানে বিজেপি এর আগেরবারেও হেরেইছিল, এমএলএ কিনে বেচে সরকার দখল করার পরেও পারফর্ম্যান্স ‘নিল’। দ্বিতীয় সমস্যা হল নেতা নেই, ভাসবরাজ বোম্মাইকে দলের ক’জন নেতা হিসেবে মানেন? শিবরাজ সিং চৌহান মধ্যপ্রদেশে নিশ্চয়ই এক বড় নাম, কিন্তু তাঁর বয়স হয়েছে, সিন্ধিয়ার সঙ্গে তার ছত্তিশ কা আঁকড়া, বিরাট আকচাআকচি, যার ফলে শিবরাজ বিজেপি নেতৃত্বের কাছে পছন্দের মানুষ নন। কিন্তু শিবরাজ সিং চৌহানকে কি বিজেপি সরিয়ে রাখতে পারবে? আবার যদি না পারে তাহলে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া কোন খেলা খেলবেন, তাও জানা নেই। একই সমস্যা রাজস্থানেও, সেখানে বসুন্ধরা রাজে বিজেপি নেতৃত্বের, বিশেষ করে শাহ–মোদির ভারি অপছন্দের মানুষ, কিন্তু তাঁকে সরিয়ে রাখলে তিনি একাই পাকা ঘুঁটি কেচিয়ে দিতে জানেন। একই অবস্থা ছত্তিশগড়ে রমন সিংয়ের। আসলে এক্কেবারে কংগ্রেসের মতো বিজেপির এই যে দিল্লি হাইকমান্ড তৈরি হয়েছে, তা রাজ্যে রাজ্যে কাঠপুতুল সরকার তৈরি করছে, দুর্দান্ত সমস্ত নেতাদের বদলে আজ রাজ্যে কেবল দিল্লির কাঠপুতুল, কাজেই এদের নির্বাচন জিততেও দিল্লির সাহায্য লাগবে। তার মানে সেই একই মুখ মোদিজি, একই ট্রাম্প কার্ড, সেখানে সমস্যা হল সবটাই তো গুজরাত নয়, ভূমিপুত্রের আবেগ আলাদা, কতবার একই কার্ড খেলা হবে? কারণ সামনেই তো লোকসভার ভোট, সেখানেও তো ওই একই মুখকে হাজির করতে হবে। তিন নম্বর সমস্যা হল কংগ্রেস যদি কর্নাটকে জিতে যায়, যার এক প্রবল সম্ভাবনা এখনও পর্যন্ত আছে, তাহলে কংগ্রেসের যে মরাল বুস্ট আপ হবে সেটা সাংঘাতিক। এক তো হিমাচলের পর আবার একটা রাজ্য জয়। দু’নম্বর হল, কংগ্রেস বলতে পারবে এমএলএ কিনে বেচে সরকার তৈরি করার বিরুদ্ধে মানুষ রায় দিল। তিন নম্বরটা আরও বড় ব্যাপার, কংগ্রেস বলবে, রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা নির্বাচনী সাফল্য এনে দিল, এটা মধ্যপ্রদেশ আর রাজস্থানে ছড়িয়ে গেলে সমূহ বিপদ। আর এখনও পর্যন্ত বিজেপি হরে দরে উত্তর ভারতেরই দল, দক্ষিণে কর্নাটক ছাড়া আর তার কীই বা আছে? সেই কর্নাটক চলে যাওয়া মানে দাক্ষিণাত্য অভিযান আপাতত বন্ধ। কাজেই বিজেপির কাছে ব্যাক টু স্কোয়ার, সেই পুরনো হিন্দুত্ব আর জঙ্গি জাতীয়তাবাদ ছাড়া আর কিছুই হাতে নেই। রামমন্দির গোবলয় ছাড়া কাজ করবে না, সেও আবার বিহারকে বাদ দিয়ে। হাতে থাকল দেশজুড়ে জঙ্গি জাতীয়তাবাদের আবেগ ছড়ানো, আবার একটা পুলওয়ামা, আবার ঘর মে ঘুঁস কর মারেঙ্গে, কিন্তু চীনের দাঁত খেঁচানির সামনে শান্ত হয়ে যাওয়া, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মেটানোর কথা বলা মোদি সরকার সেদিকেও যাবার ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারবে না। যদিও আপাতত এই ১০ রাজ্যের নির্বাচন আর ২০২৪-এর নির্বাচন রোটি কপড়া মকান, কৃষকদের আয়, বেকারত্ব বা মূল্যবৃদ্ধির বদলে বিজেপি তাকে রামমন্দির আর ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গের দিকেই নিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। সেই চেষ্টার বিরুদ্ধে ভারত জোড়ো যাত্রা, রাহুল গান্ধীকে ঘিরে আবেগ, লক্ষ মানুষের পথে নামা এক কার্যকরী ভূমিকা নেবে কি না সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। যে প্রশ্ন নিয়ে আমি আপনি তো ভাবছিই, কিন্তু এ প্রশ্ন নিয়ে সব থেকে বেশি ভাবছে বিজেপি নেতৃত্ব। তার প্রতিফলন সর্বত্র, ভারত জোড়ো যাত্রা তার শেষ পর্যায়ে, এবার হরিয়ানা হয়ে কাশ্মীর। কিন্তু বিজেপির ছোট বড় মেজো সেজো নেতারা রাহুল গান্ধী আর ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে হঠাৎই বেশি রকমের প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন। পাপ্পু নে পরেশান কর দিয়া কেয়া?