সাধারণ ধারণা হল ভায়োলেন্স মানে বোমা, গুলি, রক্তাক্ত মৃতদেহ, বারুদের গন্ধ। হ্যাঁ, এমনটাই আমাদের শিখিয়েছে রাষ্ট্র, দেশ, সমাজ আর হিন্দি সিনেমার সেন্সর বোর্ড। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উদযাপন চলছে। মোদি-শাহ-নির্মলা সীতারামনের ভাষায় আমরা এখন অমৃত কালে আছি। সেই অমৃত কালে কেবল গরমে ফুটপাথের বাসিন্দা এক মানুষ যদি চুপচাপ মরে যায়? প্রচণ্ড শীতে কুঁকড়ে পড়ে থাকে ফুটপাথে প্রাণহীন মৃতদেহ। তাহলে তা ভায়োলেন্স নয়। কারণ কেউ গুলি চালায়নি, কেউ বোমা ছোড়েনি, কোনও রক্তপাত হয়নি, কোনও এফআইআর হয়নি। নিঃশব্দে মৃত্যু এসেছে। মিউনিসিপালিটির গার্বেজ ভ্যানে তুলে নিয়ে গিয়ে সেই বেনামি মৃতদেহ পোড়ানো হবে, যে পুড়ে ছাই হয়ে গেল, সেও আমাদের দেশের ওই উই দ্য পিপলের একজন। সম্ভবত কেন? নিশ্চয়ই তার ভোটার কার্ড ছিল না, খাবার ছিল না, মাথার ওপর ছাদ ছিল না কিন্তু তার আধার কার্ড ছিল। প্রতি বছরে গরমে বিশেষত উত্তর ভারতে শ তিনেক, আর শীতে দেশজুড়েই হাজারখানেক মৃত্যু খুব স্বাভাবিক ঘটনা। মাথায় রাখুন, এটা কিন্তু ভায়োলেন্স নয়, কোনও এফআইআর নেই, কোনও তদন্ত নেই, খবরের কাগজের সাতের পাতাতেও ঠাঁই পায় না এই মামুলি খবর। কাজেই এই মামুলি খবর নিয়ে আরও আলোচনা করে লাভ নেই। চলুন এমন ‘হিংসা’ ছাড়াই মৃত্যুর যে নতুন কিসসা আমাদের হাতে এসেছে, তা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।
আপ্পাসাহেব ধর্মাধিকারী নামের এক সমাজকর্মীকে মহারাষ্ট্রের শিন্ডে-বিজেপি সরকার মহারাষ্ট্রভূষণ পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। এই সমাজকর্মীর বিরাট সংখ্যক অনুগামী আছে মহারাষ্ট্রে, অতএব তাঁকে ছোট কোনও অডিটোরিয়াম বা হলে পুরস্কার দেওয়ার মানেই হয় না, কারণ ওনার ফলোয়ারদের তো জানানো দরকার যে এই পুরস্কার জওহরলাল নেহরু দেয়নি, দিচ্ছে শিন্ডে-বিজেপি সরকার। এবং তাও আবার খোদ অমিত শাহ নিজের হাতে তুলে দেবেন এই পুরস্কার। যাঁরা বঙ্গভূষণ নিয়ে খিল্লি করেন, তাঁরা খেয়াল করুন এই পুরস্কারের নাম মহারাষ্ট্র ভূষণ। রাজ্যে রাজ্যে এমন ভূষণ পুরস্কার বহুদিন ধরেই আছে, আমাদের রাজ্যে এই ভূষণ বা বিভূষণ পুরস্কার নব্যতম সংযোজন মাত্র। সেকথা থাক, মূল বিষয়ে ফেরা যাক। সেই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান নভি মুম্বইয়ে ৩০৬ একর খোলা এক ময়দানে আয়োজন করা হয়, লক্ষ মানুষ সেখানে জমা হয়। কখন? বেলা ১০টা থেকে মানুষ জমা হতে থাকে, দুপুর ১টা নাগাদ অমিত শাহ আসেন, অনুষ্ঠান শুরু হয়। সেদিন মানে গত রবিবার ১৬ এপ্রিল তাপমাত্রা ছিল ৩৮-৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিরাট মঞ্চ বাঁধা হয়, এবং এটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না যে সেই মঞ্চে কুল কুল করে ঠান্ডা হাওয়া বইছিল, বাতানুকুল সেই মঞ্চে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী শিন্ডে, উপমুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ, মন্ত্রিসভার বিশিষ্ট মন্ত্রীরা এবং আমাদের ছোটা মোটাভাই অমিত শাহ। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের গায়ে ছিল মোদি জ্যাকেট, হ্যাঁ, এটাই এখন দস্তুর। এবং এতে অসুবিধেও নেই কারণ মঞ্চ এয়ারকন্ডিশনড। আচ্ছা কেন এই অনুষ্ঠান ওই গরমে দুপুর ১টায় করতে হল? খুব সোজা উত্তর, গরম বা বর্ষা দেখে নয়, অমিত শাহ বা মোদিজির মাপের নেতাদের কখন সময় পাওয়া যাবে, তা দেখেই সভা অনুষ্ঠানে সময় বরাদ্দ করা হয়। তদন্ত হোক, হলফ করে বলতে পারি সেদিন অমিত শাহের বিকেলে সন্ধেয় ‘আরও জরুরি কাজ’ ছিল। ছিল বলেই এপ্রিলের এই গরমে বেলা একটায় সমাবেশ ডাকা হয়েছিল, জড়ো করা হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষ, বাসে করে ট্রাকে করে তাদের আনা হয়েছিল মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | প্রশাসন, বিচার, রাজধর্ম? মোদি-যোগী-শাহের আমলে সবটাই প্রহসন
তারপর? এয়ারকন্ডিশন্ড মঞ্চ থেকে যখন বক্তারা ভাষণ দিচ্ছেন, তখন বাচ্চারা কাঁদছে জল দাও, জল দাও বলে। বয়স্করা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ভাষণ শেষ হয়েছে, ততক্ষণে এলিয়ে গিয়েছেন ১০ জন, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দেড়শোর বেশি শিশু প্রৌঢ়, বৃদ্ধদের। রাতে জানা গেল মারা গেছেন ১৩ জন। না, একবারের জন্য এই ঘটনাকে ভায়োলেন্স বলবেন না, কারণ কোনও মাফিয়া তো এই ঘটনা ঘটাননি, ঘটিয়েছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এক রাজ্যের দলবদলু মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর প্রশাসন। না একে ভায়োলেন্স বলবেন না কারণ এখানে কোনও গুলি চলেনি, কোনও রক্তপাত হয়নি, বোমা ফাটেনি, বাতাসে ছিল কান্না, বারুদের গন্ধ ছিল না। না, কখনওই একে ভায়োলেন্স বলা যাবে না কারণ এ ঘটনার পরে কোনও এফআইআর হয়নি, হত্যার দায়ে কাউকে অভিযুক্ত করেনি পুলিশ, পেনাল কোডের কোনও ধারা ব্যবহার করা হয়নি। এ ছিল প্রেম বিতরণের অনুষ্ঠান, অনুষ্ঠানে স্বর্গে গেছেন ১৩ জন মানুষ। কিন্তু সেই স্বর্গে যাওয়ার আগে তাদের পাঠানো হয়েছিল লাশকাটা ঘরে, সেখানে ডঃ বাবাসি কালেল, এই সমস্ত শবদেহ চিরফাঁড় করে জানিয়েছেন, সকলেই মারা গিয়েছে সানস্ট্রোকে, শরীর জলশূন্য হওয়ায় ওঁদের কিডনি, লিভার, ফুসফুস, মস্তিষ্ক একেবারে চুপসে গিয়েছিল। টানা ছয় থেকে সাত ঘণ্টা প্রবল রোদে থাকলে এমন অবস্থা হয়। খেয়াল করুন উনিও কোনও ভায়োলেন্সের কথা বলেননি, শরীর থেকে বুলেট বা স্প্লিনটার বের করেননি, কোনও আঘাতের চিহ্নও খুঁজে পাননি। কিন্তু আমার দেশের ১৩ জন উই দ্য পিপল অমিত শাহের জনসভায় এসে আর বাড়ি ফিরে গেলেন না। ন্যাশনাল মিডিয়াতে সামান্য খবর ছাপা হয়েছে, আর খবরের কাগজে কিছুটা। কিন্তু সে খবর বাসি হয়ে গেছে যখন, তখন মহারাষ্ট্রের শিন্ডে-বিজেপি সরকার ফরমান জারি করেছে এই গরমে কোথাও কোনও জনসভা করার অনুমতি দেওয়া হবে না। মহেশ নারায়ণ গইকার, জয়শ্রী জগন্নাথ পাতিল, মঞ্জুষা কৃষ্ণ ভম্বাদে, স্বপ্নিল সদাশিব কেনি, ভীমা কৃষ্ণ সালভি, সবিতা সঞ্জয় পাওয়ার, মীনাক্ষী মোহন মিস্ত্রি সমেত ১৩ জন এই ফরমান জারি হওয়ার আগেই চলে গাছেন লাশকাটা ঘরে।
মৃত্যুর মূল্য আছে, মাথা পিছু পাঁচ লক্ষ টাকা। ক্লোজড চ্যাপটার। আচ্ছা আমাদের রাজ্যের এই যে গেরুয়া বাহিনী, প্রত্যেক বিষয়ে অশিক্ষিত মন্তব্য করতে থাকা কাঁথির খোকাবাবু, এনারা একটা কথাও বলেছেন? একটা কথা? এই ঘটনা যেদিন ঘটছে যখন ঘটছে, প্রায় ঠিক তখন আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের স্কুল-কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। সোমবার থেকে স্কুল কলেজ বন্ধ, ঘোষণা হওয়ার পর আমাদের রাজ্যের বিরোধী দল, তাদের নেতাদের কী প্রতিক্রিয়া ছিল? বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছিলেন, ‘গরমের ছুটি যেন আরামের না হয়! বেসরকারি স্কুলে অনলাইন বা মর্নিং ক্লাস হলে সরকার পারবে না কেন? বাংলার আগামী প্রজন্মকে পিছিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত সফল হতে দেবেন না। ছাত্রছাত্রীদের বলব, বাড়িতে লেখাপড়া যেন বন্ধ না হয়। অভিভাবকরা নজর রাখুন। না হলে, বড্ড ক্ষতি হয়ে যাবে। রাষ্ট্রবাদী শিক্ষকরা যতটা এবং যেভাবে সম্ভব পড়ুয়াদের পাশে থাকুন। ছুটি কোনও সমাধান নয়, ক্ষতিকারক সংস্কৃতি।’ সুজন চক্রবর্তী, সিপিএম নেতা, তিনি বলেছিলেন, ‘কলকাতায় গত ১০ বছরে ৩০ শতাংশ সবুজ কমেছে। তাই গ্রীষ্মকালে শহরের তাপমাত্রা যে বাড়বে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না, তাই সবক্ষেত্রেই সরকারের বিকল্প ভাবনা রাখা উচিত ছিল। কিন্তু কোনও বিকল্প পথ না রেখেই ছুটিকেই একমাত্র রাস্তা হিসেবে বেছে নিয়েছে সরকার। কারণ মুখ্যমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, তিনি ডিএ দিতে পারবেন না তাই ছুটি দিয়েছেন। সেই মতো তিনি ছুটি দিয়েছেন, তাঁর আর কিছুই দেওয়ার নেই।’ এককালের বিরোধী দলনেতার এই হল বিবৃতি, বাংলায় বলেছেন বটে কিন্তু বাংলায় বোঝা যাবে না। প্রথমত কোন তথ্য জেনে, পড়ে, দেখে উনি বললেন যে কলকাতায় ৩০ শতাংশ সবুজ ১০ বছরে কমেছে? দ্বিতীয়ত বিকল্প ভাবনাটা কী? যতদিন তা না আসবে ততদিন এই গরমে স্কুল খোলা থাকবে? আর প্রসঙ্গ তো রাজ্য, উনি কেবল কলকাতার কথাই বা বলছেন কেন? আসলে স্কুল খোলা থাকলে এই গরমে যদি একজন ছাত্র বা একজন মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যু হয়, তাহলে সেই লাশ নিয়ে নবান্ন অভিযান করার সামান্য আশাটুকুও চলে গেল বলেই কি এই আক্ষেপ? সাধারণত ২ মে থেকে স্কুল কলেজে গরমের ছুটি পড়ার কথা, এক প্রচণ্ড দাবদাহে তাকে দিন পনেরো এগিয়ে আনার মধ্যে যে সতর্কতা রয়েছে তা নিয়েও রাজনীতি? এই সামান্য সতর্কতা নিলে আজ মহারাষ্ট্রের ওই ১৩ জন উই দ্য পিপল বেঁচে থাকত, তাদের কিডনি, ফুসফুস ছিঁড়ে কেটে ‘সান স্ট্রোকে মারা গেছেন’ বলে ঘোষণা করতে হত না। রাষ্ট্রের এই ভয়ঙ্কর হিংসাকে সানস্ট্রোকের আড়াল দিয়ে ঢাকতে হত না। আমার দেশের ১৩ জন সহনাগরিককে খুন করা হয়েছে, আমরা বিচার চাইছি।