কলকাতা: ‘তুমি আসবে বলে…’। নচিকেতা চক্রবর্তীর এই গান অনেকেই শুনেছেন। সত্যি সত্যিই তো তিনি আসবেন বলেই অনেক কিছু হয়েছে। অনেক কিছু পেয়েছে বাংলা। হ্যাঁ, না পাওয়ার তালিকাটাও কম নয়, কিন্তু তিনিই দেখিয়েছেন ৩৪ বছরের বাম শাসনের পতন ঘটানো যায়। নামটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ থেকে এক যুগ আগে ঠিক এই দিনেই বামেদের চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বাংলার মসনদ দখল করেছিলেন তিনি। মহাকরণ থেকে চুলের মুঠি ধরে বের করে দেওয়া হয়েছিল যাঁকে, সেই মহাকরণই কেঁপে উঠল মমতারই পদধ্বনিতে। বারান্দা থেকে কর্মী-সমর্থক তথা সাধারণ মানুষকে হাত নেড়ে, নমস্কার করে যেন বলছিলেন, ‘আমি এসেছি, প্রতিটা ইটের জবাব পাথরে দিয়েছি বিজয়ের মালা হাতে।’ কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে ২২৬ আসন নিয়ে বাংলা দখল করল তৃণমূল। অবশ্য, মমতার দল একাই সেই বারে ১৮৪ আসনে জয়লাভ করে। ২০ মে, রাজভবনে উচ্চস্বরে শপথ নিলেন, ‘আমি, মমতা ব্যানার্জি। ঈশ্বরের নামে শপথ করছি যে…’। তৃণমূল নেত্রী থেকে পরিচয় বদলে মমতা ব্যানার্জির নামের পাশে বসল ‘মুখ্যমন্ত্রী’।
এরপর লোকসভা ভোট, পঞ্চায়েত নির্বাচন। জয়ের ধারা অব্যাহত তৃণমূলের। তারপর কাট টু ২০১৬-র বিধানসভা। তখন সারদা কেলেঙ্কারি, পোস্তা উড়ালপুল বিপর্যয়, নারদ কেলেঙ্কারি চর্চায়। যে কংগ্রেস বাম সরকারের পরিবর্তনের জন্য তৃণমূলকে সঙ্গ দিয়েছিল, সেই কংগ্রেসই দাঁড়াল বামেদের পাশে। তবে সেটিকে জোট না আসন সমঝোতা বলা যায়, তা নিয়ে বিতর্ক এখনও রয়েছে। কিন্তু ফল যা বেরোল তাতে অবাক সকলেই। বামেদের আরও রক্ষক্ষরণ হল। বরং লাভ হয় কংগ্রেসের। অন্যদিকে, ২১১টি আসন জেতে ঘাসফুল শিবির। বড় থেকে আরও বড় হল তৃণমূল।
আরও পড়ুন: Karnataka VIP Trailed | ইতিহাস গড়ে ১৩ মে, বাংলার এক যুগ পর কর্নাটক, এক ডজন মন্ত্রীর হার!
এরপর এল পঞ্চায়েত নির্বাচন। বিরোধীদের প্রচুর অভিযোগের মধ্যেও বিপুল ভোটে পঞ্চায়েতগুলি দখল করে তৃণমূল। তবে খারাপ সময়ও যে আসে। লুডো খেলায় মই বেয়ে চড়চড়িয়ে বাড়তে থাকা তৃণমূলকে উনিশের লোকসভা ভোটে পড়তে হল একেবারে সাপের মুখে। ২০১৪-এর লোকসভা ভোটে ৩৪ আসন জেতা মমতার দল নেমে এল ২২-এ। অন্যদিকে, অবিশ্বাস্যভাবে ১৮টি আসন নিয়ে শক্তপোক্ত বিরোধীর ভূমিকায় নয়া অবতারে উঠে এল বিজেপি। তারপর বিজেপির ফের পরিবর্তনের ডাক। একে একে অনেক নেতাই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। ধীরে ধীরে এল ২০২১। অনেকেরই ধারণা ছিল, এবারের বিধানসভা ভোটে মুখ থুবড়ে পড়বে তৃণমূল। তখন নতুন ‘সোনার বাংলা’গড়ার স্বপ্ন দেখছিল বিজেপি। শুরু হয় ঝোড়ো প্রচার। তৃণমূল, বিজেপি, বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ, সব দল তাদের মতো করে ঘুঁটি সাজাচ্ছে। এরই মধ্যে প্রচার চলাকালীন পা ভাঙে মমতার। তখন ভাঙা পায়েই ‘খেলা হবে’ বলে ডাক দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। সত্যি সত্যিই যেন খেলা হল। ভোট হল, ব্যালট খুলল। কিন্তু এত বড় সারপ্রাইজ যে পাওয়া যাবে, তা ঘাসফুল শিবিরের বড় নেতারাও কল্পনা করতে পারেননি। বিজেপি ১০০-র গণ্ডিও পেরোতে পারল না। অন্যদিকে, ২০১১, ২০১৬-র ফলকে ছাপিয়ে গিয়ে একাই ২১৩ আসন পায় মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল। জয়ের হ্যাটট্রিক হল। আরও যেন সতেজ হল ঘাসফুল শিবির। তবে নন্দীগ্রামে হেরেছেন খোদ সুপ্রিমো। তা নিয়ে অবশ্য নানা মতবিরোধ রয়েছে। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। কিন্তু ‘২৯৪ আসনে আমিই প্রার্থী’ বলা মহিলা সবশেষে তো জিতিয়েছেন। জেতাটাই বড় কথা হেরে গেলে শেম শেম! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটাই কথা বলেছেন, উন্নয়ন, উন্নয়ন আর উন্নয়ন। হ্যাঁ, কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েছে, বেশ কিছু দুর্নীতির খবরও বাইরে এসেছে, তদন্ত চলছে। কিন্তু তারপরও কালীঘাটের ওই মেয়েটা রয়েছে। তাঁকে রাফ অ্যান্ড টাফ দেখা গেলেও শিশুসুলভ, মাতৃসুলভ মেয়েটা থাকবে।