ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে তাদের ইনভেস্টর শ্রী সিমেন্টসের ঝামেলা কবে মিটবে? বা আদৌ মিটবে কী? এই প্রশ্নে এই অতিমারির মধ্যেও বিব্রত কলকাতা ফুটবল। দু পক্ষের অনড় অবস্থানই এই অস্বস্তিকর পরস্থিতির জন্য দায়ী। ব্যাপারটা এখন পয়েন্ট অব নো রিটার্ন-এ চলে গেছে। শ্রী সিমেন্টসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হরিমোহন বাঙ্গুর পরিষ্কারই জানিয়ে দিয়েছেন, চুক্তি পত্রে সই না করলে তারা আর টিম গড়ার ব্যাপারে এক পা-ও এগোবে না। আর ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের বক্তব্য হল, চুক্তি পত্রে বেশ কয়েকটি জায়গায় আপত্তি আছে তাদের। আলোচনার মাধ্যমে সেই সব আপত্তিকর অংশ বাদ দিলে তারা সই করতে প্রস্তুত। ব্যাপারটা শুধু এই জায়গায় থেমে নেই। এ ওকে চিঠি দিচ্ছে। পাল্টা চিঠি দিচ্ছে অপর পক্ষও। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।
এরই মধ্যে হঠাৎ ভেসে উঠৈছে এটিকে মোহনবাগানের কথা। গত বছরেই এই চুক্তি হয়েছে। এবং তা নিয়ে কোনও পক্ষেরই কোনও সমস্যার কথা শোনা যায়নি। যত সমস্যা শ্রী সিমেন্টসের সঙ্গে ইস্ট বেঙ্গলের চুক্তি নিয়ে। এখন দু পক্ষেরই মুখে এটিকে মোহনবাগানের কথা। শ্রী সিমেন্টস বলছে, এটিকে এবং মোহনবাগানের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। সেখানে তো বলা হচ্ছে না, এটিকে মোহনবাগান ক্লাবটা দখল করে নিয়েছে। তা হলে ইস্ট বেঙ্গলের ক্ষেত্রে সে কথা উঠছে কেন? পাল্টা ইস্ট বেঙ্গলের যুক্তি হল, শ্রী সিমেন্টস যদি তাদের চুক্তিপত্রের সঙ্গে এটিকে মোহনবাগানের চুক্তিপত্র কপি পেস্ট করে পাঠায় তাহলে আমরা চোখ বুঁজে সই করে দেব।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে শ্রী সিমেন্টসের দেওয়া চুক্তি পত্রে ইস্ট বেঙ্গল গত নয় মাসে সই করতে পারল না। আর মোহনবাগানের সঙ্গে এটিকের চুক্তিপত্র পাঠালেই সই হয়ে যাবে। কেন এই বৈষম্য? কারণ মোহনবাগান যে চুক্তি করেছে তাতে ক্লাবের কোনও সম্পত্তির অধিকারী হয়নি এটিকে। ক্লাব ক্লাবের মতো চলবে। শুধু আই এস এল-এর দলটি চালাবে এটিকে। সেই বোর্ডে মোহনবাগানের দুজন নিশ্চয়ই আছেন। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা দেখবে এটিকে-র কর্তারা। সেখানে মোহনবাগান কর্তাদের কোনও ভূমিকা নেই। বাগান কর্তারা তাই এখন তাদের ক্লাব তাঁবু সুন্দর করে গড়ে তুলতে ব্যস্ত রয়েছেন। হয়তো আগামী ২৯ জুলাই মোহনবাগান দিবসে নবনির্মিত তাঁবুর উদ্বোধন হবে। এখানে একটা কথা বলা দরকার। যেহেতু সিনিয়র ফুটবল টিমটার মালিক এখন আর মোহনবাগান নয়, তা চলে গেছে এটিকে-র হাতে, তাই মোহনবাগান ক্লাব তাঁবু থেকে তাদের ড্রেসিং রুমটা বের করে গ্যালারির তলায় পাঠিয়ে দিয়েছে। মোহনবাগান তাঁবুর ঐতিহাসিক ড্রেসিং রুম আর তাঁবুতে নেই। এর একটাই কারণ। ফুটবল টিমটাকে কোনও ভাবেই তাঁবুর সঙ্গে যুক্ত করতে চায় না সবুজ মেরুন কর্তারা। গত বছর না হয় কোভিডের জন্য আই এস এল হয়েছে গোয়াতে। কিন্তু এক দিন না একদিন কোভিডের অত্যাচার কমবে। তখন কিন্তু এটিকে-র প্লেয়াররা মোহনবাগান তাঁবুতে ঢুকতে পারবে না। তাদের জন্য জায়গা বরাদ্দ হয়েছে গ্যালারির তলা।
ইস্ট বেঙ্গলের এই সমস্যা নেই। তারা বার বার বলে দিয়েছে শ্রী সিমেন্টসের সঙ্গে তাদের সংযুক্তির পর এস সি ইস্ট বেঙ্গলের প্লেয়াররা যদি তাদের মাঠ, ড্রেসিং রুম, জিম কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি ব্যবহার করতে চায় তা পারবে। কিন্তু শ্রী সিমেন্টস যে সব শর্ত দিয়েছে যেমন সদস্যরা ক্লাবের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না, সদস্যদের সদস্য কার্ড নবীকরন করতে হবে পাশের এরিয়ান তাঁবুতে গিয়ে, ক্লাবে সদস্যদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত হবে—এগুলো লাল হলুদ কর্তারা মানতে রাজি হচ্ছেন না। এবং সেজন্য চুক্তি পত্রে সইও করছেন না।
দু পক্ষের এই জল মাপামাপির বহর দেখে একটা জিনিস পরিষ্কার হচ্ছে না। তা হল অচলাবস্থা কাটাতে তারা মুখোমুখি বসছে না কেন। হরিমোহন বাঙুর বলে দিয়েছেন, চুক্তিতে সই না হলে তারা অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে রাজি নন। অন্য কিছু মানে মুখোমুখি আলোচনা। তবে ইস্ট বেঙ্গল মুখোমুখি বসতে রাজি। এবং তাদের বিশ্বাস মুখোমুখি বসলে চুক্তির যে সব অংশ নিয়ে তাদের আপত্তি আছে সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। প্রশ্ন হল, শ্রী সিমেন্টস এ রকম অনমনীয় মনোভাব নিচ্ছে কেন? তাদের বক্তব্য তারা ইতিমধ্যেই পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে। এবং সেটা ইস্ট বেঙ্গল চূড়ান্ত চুক্তিপত্রে সই করবে সেটা ধরে নিয়ে। এখন যদি ইস্ট বেঙ্গল সেখান থেকে সরে আসে তারা নিরুপায়।
তাহলে উপায় কী? উপায় এই অচলাবস্থা কাটাতে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ। সেটা হতে পারেন রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একমাত্র তিনিই পারেন দু পক্ষকে নিয়ে বসে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানের উপায় বাতলাতে। কারণ ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে শ্রী সিমেন্টসের সম্পর্কের অনুঘটক তিনিই। গত বছর যেদিন মোহনবাগানের সঙ্গে এটিকে-র সংযুক্তি হয় সেদিনই তিনি ফোন করেছিলেন দেবব্রত সরকারকে। জানতে চেয়েছিলেন, আই এস এল-এ খেলার ব্যাপারে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব কী ভাবছে? দেবব্রতর উত্তর ছিল ইনভেস্টর পেলেই তারা খেলতে রাজি। মুখ্যমন্ত্রী তখন আশ্বস্ত করেন ব্যাপারটার দায়িত্ব তিনি নিচ্ছেন। এবং কথা রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এক মাসের মধ্যে তিনি ইনভেস্টর খুঁজে এনে দেন। তাঁর উপস্থিতিতে নবান্নে হয় দু পক্ষের টার্ম সিটে সই। ঠিক হয় চুড়ান্ত চুক্তিপত্রে সই হবে কিছু দিন পরে। কিন্তু সেই চুক্তিপত্র দেখে বেঁকে বসেছে ইস্ট বেঙ্গল। অনড় মনোভাব দেখাচ্ছে শ্রী সিমেন্টস-ও। কোনও পক্ষই দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। এই প্রেক্ষিতে সমাধান সূত্র বের করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী-ই।
এখন কোভিড-ইয়াসের সমস্যার মাঝে মুখ্যমন্ত্রী সময় বের করে দু পক্ষকে নিয়ে বসতে পারবেন কি না তার উপরেই নির্ভর করছে শ্রী সিমেন্টস এবং ইস্ট বেঙ্গলের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া এই অচলাবস্থা কাটবে না।