আমাকে মারবে? কলকাতার লোক আমাকে মারবে? তারা কী খায়? হিন্দুধর্মের যাবতীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সারাজীবন লড়াই করা রামমোহন রায়কে (Ram Mohan Roy’s 250th birth anniversary) একবার হত্যার ছক কষা হয়েছিল। তা জানতে পেরে একথা বলেছিলেন রামমোহন। কারণ, এই মানুষটির উচ্চতা ছিল ৬ ফুট। মাথা ছিল অস্বাভাবিক বড়। এই জন্য বিলেতের লোকজন তাঁকে অসাধারণ পুরুষ বলত। প্রতিদিন ১২ সের দুধ পান করতেন। কালাপানি পেরনোর সময় জাহাজে দু’টি গাভী সঙ্গে করে নিয়েছিলেন বলেও শোনা যায়। কেউ কেউ লিখেছেন একবারে একটি আস্ত পাঁঠার মাংস খেতে পারতেন।
জীবনের শুরু থেকে ঘরে-বাইরে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে যাওয়া এই মানুষটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তিনি যে নিন্দা লাভ করেছিলেন, সেই নিন্দাই তাঁর গৌরবের মুকুট। জওহরলাল নেহরু তাঁকে ভারতের জাতীয়তাবাদের জনক ও বিশ্বকবি ভারত পথিক আখ্যা দিয়েছিলেন। এই মানুষটিই আবার শরীরের বিষয়ে বেশ যত্নবান ছিলেন। তিনি শরীরকে ভগবানের মন্দির মনে করতেন। সেই কালের অন্যদের মতো তাঁরও বাবরি চুল ছিল।
আরও পড়ুন: Qutub Minar: জ্ঞানবাপী বিতর্কের মধ্যে কুতুব মিনার কমপ্লেক্স খোঁড়ার নির্দেশ কেন্দ্রের
ফরাসি বিপ্লবের ঝড়ের মুখে তাঁর জন্ম। বাবা রামকান্ত ও মা তারিণী দেবী দু’জনই ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। বাবা শেষ জীবনে বৈষ্ণব হন। আর মা ছিলেন গোঁড়া শাক্ত। পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করা রামমোহনকে একবার তাঁর দাদু পুজোর সময় হাতে বেলপাতা দিয়েছিলেন। রামমোহন সেটা অঞ্জলি না দিয়ে চিবোতে শুরু করেন। তা দেখে মা তো বেজায় চটে গেলেন। মুখ থেকে বেলপাতা বের করে ফেলে দিয়ে নিজের বাবাকেই বকাঝকা শুরু করলেন। তা দেখে রামমোহনের দাদু মেয়েকে বলেন যে, তাঁর ছেলে বিধর্মী হবে। বিলেত যাওয়ার আগে তাঁর আত্মীয়স্বজন তাকে বাধা দেন। কারণ সেই যুগে দেশের শাস্ত্র অনুযায়ী সমুদ্রযাত্রা চিরতরে নিষিদ্ধ ছিল।রামমোহন প্রথম ব্যক্তি, যিনি এসব অযৌক্তিক প্রথাকে উপেক্ষা করে বিলেত গমন করেন। সে সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন তাঁর পালিত পুত্র, রামরত্ন মুখোপাধ্যায় নামে পাচক ব্রাহ্মণ এবং রামহরি নামে ভৃত্য।
তখনকার রক্ষণশীল হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে গিয়ে ভারতকে আধুনিক করে গড়ে তোলার যাবতীয় মালমশলার জোগান প্রথম এই মানুষটিই দিয়েছিলেন। তাই বাড়ি থেকে ত্যজ্যপুত্র করার পর যখন পৃথক বাড়িতে বসবাস শুরু করেন তখন তাঁর বিরোধী পক্ষরা রামমোহনের বাড়ির কাছে এসে সকালে মুরগির ডাক ডাকত। শোনা যায়, বাড়ির ভিতরে গরুর হাড় ফেলে যেত। এমনকী তাঁর বিরুদ্ধে গানও বাঁধা হয়েছিল। ‘সুরাই মেলের কুল, (বেটার) বাড়ি খানাকুল, বেটা সর্বনাশের মূল। ওঁ তৎসৎ বলে বেটা বানিয়েছে স্কুল। ও সে জেতের দফা করলে রফা, মজালে তিন কুল।’ একবার তিনি মধু দিয়ে রুটি খেতে খেতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে (তখন বালক) বলেছিলেন, বেরাদর (ভাই) আমি মধু ও রুটি খাচ্ছি। কিন্তু লোকে বলে আমি গরুর মাংস ভোজন করে থাকি। সামাজিক কুৎসা, জীবনের উপর আক্রমণ সবকিছুই সইতে হয়েছে রামমোহনকে।
আরও পড়ুন: Assam Professor: অসমে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীর নিন্দা করে গ্রেফতার অধ্যাপক
বাইরের লোক তো বটেই রামমোহনের নিজের পরিবার, এমনকী তাঁর মাও স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে মামলা ঠুকেছিলেন দেওরপোকে দিয়ে। আদালতে রামমোহনের মা এও বলেছিলেন যে, ধর্মত্যাগী পুত্রের মস্তক যদি এখানে ছিন্ন করা হয়, তাহলে আমি পুণ্যকাজ বলে মনে করব। রামমোহনের ছেলের বিয়ের সময় তাঁর বিরুদ্ধ দল বিয়ে ভাঙার অনেক চেষ্টা করে। এমনকী রামমোহনকে একঘরে করে রাখার আয়োজন করা হয়। যদিও তারা ব্যর্থ হয়েছিল। কলকাতায় যখন ব্রাহ্মসভায় উপাসনা করতে যেতেন, তখন লোকে তাঁর গাড়িতে ঢিল ছুড়ত। তাই বেশিরভাগ সময় গাড়ির জানালা বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হতেন। শুধু তাই নয়, তাঁর বিরোধী পক্ষ তাঁকে খুনের চেষ্টা পর্যন্ত করেছে।
রামমোহনের বয়স যখন ১৬-১৭, তিনি তিব্বত গিয়েছিলেন। তিব্বতের সর্বপ্রধান বৌদ্ধ পুরোহিতকে বলা হয় ‘লামা’। তাঁদের ধারণা, লামা জগতের সৃষ্টি ও স্থিতির কর্তা। কিন্তু রামমোহন এইসব কথাবার্তা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি সেখানে তীব্র প্রতিবাদ করেন। এতেই গোল বাধল। তিব্বতিরা তাঁকে মারার জন্য খেপে উঠল। সে সময় তিব্বতের মেয়েরা রামমোহনকে রক্ষা করে। এই কৃতজ্ঞতা তিনি সারা জীবন নারী জাতির কাছে অনুভব করতেন। বহু বহু লোকের কাছে গর্ব করে একথা বলেওছেন।
আরও পড়ুন: Balurghat: কালবৈশাখীর ঝড়ে লন্ডভন্ড দক্ষিণ দিনাজপুর, তিন দিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন এলাকা
রামমোহন নারীদের সবসময় সম্মানের চোখে দেখতেন। বহুবিবাহকে নারীর কলঙ্ক হিসেবে তিনি দেখতেন। তাই তিনি ভারতীয় নারীদের রক্ষার জন্যে শুধু সতীদাহ পথা রদ করেননি, নারীদের সম্মান রক্ষার জন্যে বহু বিবাহের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করেন। হিন্দু নারীদের সমাজে অসহায় হওয়ার কারণ ছিল সম্পত্তির অধিকারী না হওয়া। রামমোহন নারীর সম্পত্তি লাভের জন্যে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি শাস্ত্র ঘেঁটে বলেন— প্রাচীন ঋষিগণ ব্যবস্থা করেছিলেন যে, মৃত-স্বামীর সম্পত্তিতে পুত্রের সঙ্গে স্ত্রীও সমান অধিকারী। একাধিক পত্নী থাকলেও তাঁরা সবাই সমানভাবে সম্পত্তির অংশীদার।
সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রসঙ্গে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘মহাপুরুষ যখন আসেন তখন বিরোধ নিয়েই আসেন, নইলে তাঁর আসার কোন সার্থকতা নেই। ভেসে-চলার দল মানুষের ভাসার স্রোতকেই মানে। যিনি উজিয়ে নিয়ে তরীকে ঘাটে পৌঁছিয়ে দিবেন, তাঁর দুঃখের অন্ত নেই, স্রোতের সঙ্গে প্রতিকূলতা তাঁর প্রত্যেক পদেই।’ ঠিক তাই ঘটেছিল রামমোহনের জীবনের প্রতি পদে।