তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, তুমি আমার কতদিনের চেনা, তোমার শরীর, অসুখ, ক্ষত, অভিমান, রাগ, জেদ ওই মা উড়ালপুলের তীক্ষ্ণ ঘুড়ির মাঞ্জার মতোই আমার ঠোঁটে, গলায়, মাংসে-মজ্জায় আলতো টান দিয়ে যায়, তোমার পাতলা মখমলি লাল ঠোঁটের মতোই ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয় তোমার-আমার নিত্য সঙ্গপোনের নিখুঁত বিভাজিকার উতরাইয়ের মতোই। নিশিদিন তোমার সঙ্গলিপ্সায় হেঁটেছি ফুটপাথের খেবড়ো ডিঙিয়ে, চওড়া রাস্তায় বাস-মিনি-ট্যাক্সি-ওলা-উবরের ফাঁক গলে, ফুটব্রিজের শূন্যতা পেরিয়ে, এককোমর জল বেয়ে, গঙ্গার হাওয়ায় ভেসে ভেসে ভোর-সকালের নিপুণ আলো হয়ে, রোদ-বৃষ্টির খেলাঘরের দাওয়ায় চাটাই পেতে, বিশ্রাম শেষে গোধূলির পানে ফের হেঁটে যাওয়া, অবিরাম, সন্ধের উজান পানে, রাত গভীর হওয়ার পরেও তোমাকে চেনার, স্পর্শ করার অভিপ্রায়ে, সত্যি বলছি, তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, এখনও চেনা চৌহদ্দিতে ঢুকতে পারলাম নান তুমি ঢুকতে দিলে কই? সেই আদিগন্ত নিষিদ্ধ, নিরিবিলিতে তোমায় চিনলাম কই? কিন্তু চিনতেই তো চেয়েছি। সহজ নয়, তুমিই জানিয়েছো, চোখে আঙুল দিয়ে ইশারায়, কোমরে হাত রেখে গ্রীবা টান করে, ঋজু শরীরে, কোমল হাতছানিতে, নগ্ন, নরম সুরে, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে, সত্যি চুমুর দিব্যি, তিলোত্তমা, কত অজানাই থেকে গিয়েছে।
এত চুমু, এত আদর, তারপরেও তুমি বলবে তিলোত্তমা, টুকি। জানি, তোমায় খুঁজে পাব না, তুমি পেতে দেবে না, পেয়েছি মনে করে ধাপ্পা দিতে গেলেও একমুঠো নির্জন বাতাসে আ্মার হাত দুটো বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে। তুমি বড্ড জানো, আমি-আমরা তোমায় কোনওদিন বুঝে উঠতে পারব না, পারা যায় না, যাবে না। বহু প্রেম বিলিয়েও হাওড়া ব্রিজের হাতলে হাত রেখে, গঙ্গার ঘোলা জলে পরিপক্ব দৃশ্যমানতায় চোখ ঝাপসা হয়ে যাবে, জানি। তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, ফর্সাপানা মেয়েটার বিন্যস্ত বিনুনির মতো দ্বিতীয় হুগলি সেতুর টান টান করে বাঁধা তারের শরীরে চুপ করে নেমে আসে রোদ, টুপ করে ঝরে পড়ে আদুরে্ বৃষ্টি, শ্রাবণের মাতলামিতে আকাশ-মর্ত্য একাকার হয়ে গেলেও, জানি, তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, তুমি চিনতে দেবে না। ইলিয়ট পার্কের ছাঁটা ঘাসে, ভিক্টোরিয়ার আনাচ-কানাচে সবুজ কোলাহলে, রবীন্দ্র সরোবরের আলো-আঁধারিতে, লেকের সবজেটে জলে, লতানে গাছের ফাঁক গলে আসা আলোয়, মিলেনিয়াম পার্কের ভিজে বেঞ্চে শ্যাওলা-সবুজ আদিখ্যেতারা ঠোঁট ছুঁয়ে যাবে, জানি, তবুও তুমুল চুমুর দিব্যি, তিলোত্তমা, তোমায় চিনে উঠতে পারিনি। বিকেল পেরিয়ে সন্ধের আবডালে, পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়ে আঁধার, সে আঁধার গভীরে যেতে বলে কোথায় যেন লুকিয়ে পড়ে, আমার সন্তর্পণ গতিবিধিতে তার সজাগ দৃষ্টি, সেই গভীরে যাওয়ার মৌতাত-মাখা তিলোত্তমা, তোমার রূপসুধা পান করে, চুমুর দিব্যি, চিনতে পারিনি তোমায়, নিশিনিলয়ের নিষিদ্ধতায় আবেগে ডুব দিয়েও জেনে উঠতে পারিনি হস্টেলের গলি, তস্য গলি আর ক্যাম্পাসের না-বলা, না-জানা প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলা সামাজিক অবক্ষয়ের নির্মম আখ্যান, শুধু জেনে নিয়েছি, বা নিতে পেরেছি উচ্চ থেকে উচ্চতর মেধার করিডর, চাষাবাদের বিস্তৃত ভূমি। তিলোত্তমা. চুমুর দিব্যি, নেশাতুর জীবন জেনে উঠতে পারিনি, জানতে চেয়েছি, নিশিনিলয়ের প্রতিটি কোণে পড়ে নিতে চেয়েছি তোমাকে, তোমার শরীরের অভিমানী ক্ষত, কামনার মদিরায় চুমুক দিয়ে জানতে চেয়েছি ওই বারান্দার একফালি নির্জন শূন্যতায় চুমু পেরিয়ে কতটা নীচে নামতে চেয়েছো তুমি, ঠিক কোথায় চুমুর আস্তরণে গলে যাওয়া যায়, তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, জানতে চেয়েও জানতে পারিনি। তোমার দেহের মাঝে নদী আছে,
গৌর চাঁদচুড়া আমার/ বুকজোড়া আমার সাতনলী।
গৌর আমার শঙ্খ শাড়ি -/গৌর মালা পুঁইছে পলা চুল বাঁধা দড়ি/
গৌর দুই হাতের চুড়ি/ সে যে আমার গৌর, গৌর কাঁচুলি।
তখন কত রাত? সেই যুগলমিলন! নিতান্ত নীরবে গান শুনেছি তোমার পাশে বসে। কেমনতরো মাতোয়ারা হয়েছি, তুমি জানো। খঞ্জনি মন কেমন টগবগ নেশায় জেগে উঠত, তুমি জানো, আমিও। সে যেন ‘আপন ঘরের পরের আমি’ হয়ে বসত করে! সে সমঝদারির তোয়াক্কা করে না। চোখে চোখে কুশল বিনিময়, গাঁজার গন্ধে ছয়লাম ধোঁয়া ঠেলে একটু একটু করে নিশিঠেকের আসরে ঠাঁই হতেই ঠাহর হল চারপাশের অন্যসব প্রিয় স্বজন, বন্ধুদের মুখগুলি। গানের মাঝে গানের গহন কথার কথকের চোখ দুটিতে এত প্রেম! রাত আখড়ায় আমি তোমায় অন্তর্লীন গানের কথা বলতে বলতে জিজ্ঞেস করেছি বহুবার, জানতে চেয়েছি, তোমার মনের এমন বেপরোয়া উদাসীনতার কারণ। মধুর হেসে তুমি ঠিক ততবার এড়িয়ে গেছ। কখনও বহু জনতার
মাঝে চোখে চোখে আদর করতে করতে শুনিয়েছ,
সে-অগ্নিতে হলে দাহন/ হয়ে যাবে অগ্নিবাহন/
কর্ম হবে সিদ্ধ কারক/ কাঞ্চন বর্ণ হবে তার।
এমন সুরাতিয়া উড়ানে নতজানু হয়ে আমিও চিনতে চেয়েছি তোমায়, তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, ওই হস্টেলের রাত, তুমি দেখা দাও এবার। এমন লৌকিক নিশিঠেক, সত্যিই সহজধারা সঙ্গ যাপন। কলকাতার রেস্তো-বার, উলুখুলু রঙ-রসিয়া পানশালা, গোপন এলিট নিশিনিলয়, বউবাজার-পার্ক স্ট্রিট অথবা, চাঁদনি চকের নিয়ত ছুঁক-ছুঁক ছায়াবাজি সরিয়ে কখনও সখনও রাতের মৌতাতে এমন সব অজানা ঠেকের সাকিন শান্তির শরণ এনে দেয় কি অন্তরমহলে। অন্তরে সেই নিশি উদযাপনের মিঠে আরামের বিভা তোমার শরীরেও, তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, দু’হাতের বেড়ে তোমায় হৃদমাঝারে ধরে রেখেও জানতে পারিনি, মেধা-ঠেকের নিষিদ্ধ কলকাকলি। তবে এমনতরো মূ্হূর্তে তোমায় অপলক দেখি আর তারাপদ রায়ের ‘একেকদিন’ বলি,
‘মনে হয়, মনে হয় এর হাতে ভাগ্য ভবিষ্যত,
সমর্পণ করে এক জন্ম চোখ বুজে ভাসা যায়!
না, তোমায় তবুও চিনে উঠতে পারিনি, তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, কোত্থাও সিসি ক্যামেরা নেই, তাই অবাধ যৌনতা আছে, কন্ডোম আছে, মদ আছে, মাদক আছে, সু-উত্তাপী সুখ আছে, শরীরী প্রেম আছে, বিকৃত প্রেম আছে, কাম আছে, লালসা আছে, লিপ্সা আছে, র্যাগিং আছে, আরও কত কী আছে, জানতে চেয়েছি, তুমিই জানতে দাওনি, শুধু তাকিয়ে হেসেছো, আ্রর আমায় ফাঁসিয়েছো দেদার উত্তাপে, চুমুর বাহানায়, শরীরে হাত রেখে, কথা দিয়ে ভুলিয়ে । তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, কত অজানার পরিসরে নিত্য আনাগোনা কেন এত অচেনার?
তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, নবীনবরণ জানি, চলতি কথায় ফ্রেশার্স (ফ্রেশার্স ওয়েলকাম-এর অপভ্রংশ)। ফ্রেশার্স তো ভদ্রভাবেই হবে। আসলে অ্যান্টি-র্যাগিং কমিটি খুব স্ট্রিক্ট হলে সেটাই তো হওয়া উচিত। তিলোত্তমা, তোমার বুকে এক বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রতি বছর ফ্রেশার্সে প্রথমে কিছু পারফরম্যান্স, তারপর অধ্যাপকদের বক্তব্য এবং একদম শেষে, তাঁরা বেরিয়ে গেলে এক রুদ্ধদ্বার বিনোদনের আয়োজন। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে প্রত্যেককে ডেকে যেসব কাজ করতে বলা হয়, সেগুলোর বেশিরভাগই চূড়ান্ত ন্যক্কারজনক। নবীনবরণের বদলে বিকৃত যৌনতার উদযাপন। নারী ধর্ষণ বা কুকুরের সঙ্গম ভঙ্গিমা করে দেখাতে হয় এক নামকরা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রদের, কোনও ছাত্রীকে নিজের পরিচয় দেওয়ার মাঝে মাঝে উচ্চারণ করতে হয় শীৎকার-বাক্য, চোখে জল এসে গেলেও ছাড় নেই, এবং চারপাশের সুপ্রতিষ্ঠিত সিনিয়রদের আমোদেরও খামতি নেই, কোনও আধুনিক সভ্য সমাজের বিনোদন যে এমন হতে পারে, তা চর্মচক্ষে না দেখলে অনুভব করা শক্ত। সিনিয়রদের অভয়বাণী ও আশ্বাসবাণী, একদিনের ব্যাপার। এটার পরে দেখবি, সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে বন্ডিং আরও স্ট্রং হবে। অর্থাৎ এই ধরনের বিকৃত যৌনগন্ধী কার্যকলাপ করতে বলা আদপে তেমন গুরুতর ব্যাপারই নয়, বরং তা আখেরে নব্য মেধাবীদের উপকারই করবে, আহা তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, কী মনোরম বার্তা, বছরের পর বছর। এই ঘৃণ্য অনুশীলনের বিরুদ্ধে যে মুখ খোলা উচিত, সেকথা মনে হয় না কেন কারও? বরং এসব কথা বাইরে বেরনো অপরাধ, এমন এক ভাবনার কাছেই নতজানু থাকে মেধা । যেমন বাড়ি, পরিবারের বদনাম হবে ভেবে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা চেপে দেওয়ার চেষ্টা চলে, অনেকটা সেইরকম। অনেকেই তেমনটাই ভেবে নিয়ে, আপাত সুরক্ষার কথা চিন্তা করে সেই অলিখিত নিয়মকে শিরোধার্য করে নেয়। কেউ ব্যতিক্রম থাকে । উপর মহলের কাছে চিঠি কিংবা র্যাগিং মেলে জানায় বিস্তারিত। কখনও ক্লাসের শেষে, আবারও এক রুদ্ধদ্বার পরিস্থিতি। স্যারেরা আসেন, জানতে চাওয়া হয় এরকম সত্যিই কিছু ঘটেছে কিনা। তখন মুখ চাওয়া চাওয়ি চলে। তারপর অবশ্য এক এক করে বলা শুরু হয়, কী কী ঘটেছে। চেপে রাখা কথার তোড় তখন আর আটকায় কে! ঘটনার জেরে জড়িত সিনিয়রদের কেরিয়ার নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন ওঠা উচিত। ওঠে কি? তবে বহু শিক্ষা প্রতিষ্টানের ফ্রেশার্সের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।
কে যে এমন প্রভূত সাহসের পরিচয় দেয়, কোনওদিনই জানা যায় না। বলাই বাহুল্য সিনিয়রদের কাছে সে তৎক্ষণাৎ খলনায়কে পরিণত হয়। সেই অচেনা সাহসিকের প্রতি বিরূপ মন্তব্য উড়ে আসে, কারণ সে নাকি সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কে ‘ফাটল’ ধরানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু, সত্যি বলছি তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, যখন আমাদের চোখের সামনে কাঠুয়ার ঘটনা ঘটে যায়, উন্নাও ঘটে যায়, ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিরদের শ্লীলতাহানি হয়, মণিপুরের ভিডিয়ো ভাইরাল হয়, তখন সেই সাহসীর কথা ভাবতে হয়। কিন্তু সে সাহস কজনই বা দেখাচ্ছে, বা দেখাতে পারে!
আরও পড়ুন: ছেলে গ্রেফতার হয়েছে, শোনার পর থেকেই অসুস্থ মা
তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, এক সুন্দর নির্ভেজাল স্বপ্নের অপমৃত্যুর পর বুলিইং বা র্যাগিং নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই যথেষ্ট সরব, সেটা ইতিবাচক দিক। সংবেদনশীল মানুষ হিসাবে তাঁরা এই ধরনের অভ্যাস চিরতরে বন্ধ হওয়ার বিষয়ে মুখ খুলেছেন। অনেক প্রাক্তন ছাত্র সরাসরি দায়ী করেছেন ছাত্র ইউনিয়নকে। কয়েকজন বর্তমান ছাত্রের পোস্ট থেকে জানা যায়, জুনিয়রদের যাতে সহজে চিহ্নিত করা যায়, সেজন্য চুলে মিলিটারি ছাঁট, নির্দিষ্ট ড্রেস কোড, সন্ধে ছটার মধ্যে হস্টেলে ঢোকার মতো ফ্যাসিবাদী নিয়ম সেখানে জারি রাখা হয়েছে। তবে বুঝতে অসুবিধে নেই, অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও এই চর্চা চলছে বছরের পর বছর ধরে। র্যাগিং শব্দটির সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়ে যা জানা, তা হল র্যাগিং মূলত ঘটে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। এর মাধ্যমে সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের নাকি খানিক গড়েপিটে নেওয়া হয়, যাতে পরবর্তী কর্মজীবনে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো মানসিক কাঠিন্য তৈরি হয়। সেই গড়ে পিটে নেওয়ার পদ্ধতি কেমন হয়, তার কিছু কিছু গল্প শুনে অনেকেই ‘কখনও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব না’ শপথ নিয়ে ফেলে অত্যন্ত কাঁচা বয়সে। বিশ্ববিখ্যাত এক ইউনিভার্সিটিতে একদিন রাতে সব জুনিয়রকে ছাদে নিয়ে গিয়ে পাঁচিলে উঠতে বলে নির্দেশ দেওয়া হয় ঝাঁপ মারতে। বুদ্ধি খাটিয়ে সে সব জুনিয়র য়খন ছাদেই ঝাঁপ মারে, তখন সিনিয়রদের সে কী বাহবা, পিঠ চাপড়ানি! কখনও হস্টেলে অচেনা সিনিয়ররা এসে জুনিয়রদের বলত, বল দেখি, আমরা কোন ইয়ারের? উত্তর ভুল হলে চড়। উত্তর ঠিক হলে পরবর্তী জিজ্ঞাসা, কী করে জানলি? আন্দাজে বলেছে শুনলে তার ভাগ্যেও সেই চড়। এভাবে শিখিয়ে দেওয়া হত, সিনিয়রের সামনে আন্দাজ করার চেষ্টা অপরাধ। রাতের অন্ধকারে জুনিয়র ছাত্রদের ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ছাদের পাঁচিলে দাঁড় করানো বা অকারণ চড় মারা কোন ধরনের মানসিক কাঠিন্য গঠনের শিক্ষা, তা সেই সব সিনিয়রই বলতে পারবে।
২০০৯ সালে ইউজিসি অ্যান্টি-র্যাগিং হেল্পলাইন লঞ্চ করে। দৃশ্যটা একটু একটু করে বদলায়। কলেজে কলেজে তৈরি হয়েছে অ্যান্টি-র্যাগিং সেল। কিন্তু বিক্ষিপ্ত ঘটনা যে আদৌ তাতে বন্ধ হয়নি, সেকথা হলফ করে বলাই যায়। বিশেষত হস্টেলে, যেখানে ক্লাসের সময়ের পরেও সিনিয়রদের নজরদারিতে থাকতে হয়, সেখানে যা ঘটছে তার বেশিরভাগটাই যে কর্তৃপক্ষের নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে, তা নদিয়ার হাঁসখালির তরতাজা তরুণের মর্মান্তিক মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। অ্যান্টি-র্যাগিং সেলে রিপোর্ট করতে বলার নির্দেশ কলেজের সর্বত্র টাঙানো থাকে, ভর্তির সময়ে ছাত্রছাত্রীদের একটি ফর্মেও সই করতে হয়। তারপরেও যা ঘটছে, তা সামনে না আসার কারণ কী হতে পারে, সেটা বুঝতে খুব বেশি ভাবতে হয় না, তিলোত্তমা, সত্যি বলছি চুমুর দিব্যি।
এক বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র ধোঁয়াশার চাদর বিছানো। স্বাভাবিক। সিসি ক্যামেরা নেই, লাগাতে দেওয়া হয় না, প্রশাসনের উপর নানাবিধ চাপ, আইকার্ড গলায় না ঝোলানোর অলিখিত ফতোয়া কেন? মুক্তমনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোহাই, সিসি ক্যামেরায় কীসের আপত্তি? কোন কুকর্ম ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়? স্বপ্নপূরণের আগেই নিভে যাওয়ার পিছনে নানা মত। হস্টেল ক্যাম্পাস এবং ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস, এই দুই জায়গাতেই তার উপর কোনও চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল, একথা প্রাথমিকভাবে জানা যায়। হস্টেলের কিছু বাসিন্দার বয়ান অনুযায়ী, ঘটনার দিন সন্ধেবেলা ছেলেটি অন্য একটি বন্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে দেয়। অন্যদিকে ক্যাম্পাসের কয়েকজনের মত, ছেলেটিকে সকলে মিলে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই কেউ বা কারা তাকে ‘গে’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার ফলে ছেলেটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। মাত্র দুদিনের মধ্যে এত ঘটনা ঘটে গেল যে একটি তরতাজা ছেলের প্রাণ চলে গেল, এই বিষয়টিই ভাবাচ্ছে। হস্টেল এবং ক্যাম্পাস, দুই তরফের বয়ানই যথেষ্ট অসঙ্গতিপূর্ণ। দেহে অজস্র আঘাতের চিহ্ন কোথা থেকে এল, তাও এক বিরাট প্রশ্ন। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বড় হতে চাওয়ার এক অভ্রভেদী আকাঙ্ক্ষা থাকে। দুর্ভাগ্য এই যে সেই বড়-কে সংজ্ঞায়িত করা হয় ক্ষমতাবান বলে। তারই বাস্তব প্রতিফলন ঘটে চলেছে প্রতিদিনের জীবনে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সিনিয়রিটির সুযোগ নিয়ে জুনিয়রদের হেনস্থা, অসম্মান করার মতো ঘটনা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে এখন। কিছুদিন আগে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এক ম্যানেজারের অভব্য আচরণ নিয়ে শোরগোল ওঠে। সে তো এই জঘন্য-অথচ-স্বাভাবিক পরিকাঠামোরই বাই-প্রোডাক্ট। তার ইতিহাস ঘাঁটলে হয়ত দেখা যাবে, জীবনের কোনও না কোনও সময়ে সে-ও চূড়ান্ত হেনস্থার শিকার হয়েছে, বাড়িতে, স্কুলে কিংবা কলেজে। অন্য একজনের তুলনায় বয়সে বড়, শারীরিকভাবে বেশি শক্তিধর, কিংবা মেধার দিক থেকে শক্তিশালী, মূলত এই তিন ধরনের ব্যক্তির নাম উঠে আসে স্কুলে সংঘটিত র্যাগিংয়ের ক্ষেত্রে। সুসংবদ্ধভাবে একজনকে ক্রমাগত বুলি করে যাওয়া, শারীরিক নিগ্রহ সেখানে আকছার ঘটে।
এছাড়া শারীরিকভাবে দুর্বল, ছোটখাটো-গোলগাল চেহারা, চিকন কণ্ঠস্বর, অনেক বয়স অবধি দাড়িগোঁফের চিহ্ন না থাকা কোনও বয়ঃসন্ধির ছেলের কাছে কী পরিমাণ দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে, সে অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। বিশেষত যে স্কুলে কেবল ছেলেরাই পড়ে, সেখানে এমন এক চেহারার ছেলে বা স্বভাবগতভাবে মেয়েলি ছেলে অনায়াসে হয়ে ওঠে সুঠাম চেহারার পুরুষালি বন্ধুদের যৌন চাহিদা মেটানোর মাধ্যম। যখন-তখন তার বুকে হাত দেওয়া বা জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া চলতে থাকে অবাধে। সূত্র বলছে, ব্রিটেনের শতাব্দীপ্রাচীন পাবলিক স্কুল ও বোর্ডিং স্কুলে এই অনুশীলন চলেছে দীর্ঘ কয়েক শতক। বয়সে বড় বোর্ডারদের জুতো পরিষ্কার করা, জামাকাপড় কাচা, জলখাবার তৈরি করার মতো কাজ করতে হত কমবয়সিদের। এর পোশাকি নাম ছিল ফ্যাগিং। যাদের খাটানো হত, তাদের বলা হত ‘ফ্যাগ’। মূলত বোর্ডিংয়ে নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখতে আমদানি করা হয়েছিল ‘ফ্যাগিং’। কাজ করতে না চাইলে জুটত শারীরিক নিগ্রহ বা যৌন হেনস্থার মতো কড়া শাস্তি। ষোড়শ শতকে ইংল্যান্ডের সেন্ট পলস স্কুল, এটন কলেজ, উইনচেস্টার কলেজের বেশ নামডাক ছিল ফ্যাগিং প্রতিষ্ঠান হিসাবে। বিশিষ্ট রোমান্টিক কবি পার্সি বিশে শেলী এটন কলেজে তাঁর প্রিফেক্টের ফ্যাগ হতে অস্বীকার করায় হেনস্থার শিকার হন। ১৯৩২ সালে বাংলার যে গভর্নরের দিকে গুলি ছুড়েছিলেন বীণা দাস, সেই স্ট্যানলি জ্যাকসন পড়তেন গ্রেটার লন্ডনের হ্যারো স্কুলে। তাঁর ফ্যাগ ছিলেন চার বছরের ছোট উইনস্টন চার্চিল। এই হ্যারো স্কুলেই পড়েছিলেন অভিনেতা সাইমন উইলিয়ামস। ফ্যাগিংয়ের যন্ত্রণা নিয়ে পরে মুখ খুলেছিলেন তিনি। ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার টায়ারম্যান তাঁর বই এ হিস্টরি অফ হ্যারো স্কুল-এ উল্লেখ করেছেন যৌন নিগ্রহের কথা।
১৯৩০ সালে পশ্চিম লন্ডনের সেডবার্গ স্কুলের এক ১৪ বছরের ছাত্র ফ্যাগিং সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। টনক নড়ে প্রশাসনের। সেডবার্গে ফ্যাগিং বন্ধের নির্দেশ দেয় আদালত। গত শতাব্দীর নয়ের দশকে এসে ধীরে ধীরে বন্ধ হয় এই সংস্কৃতি। ব্রিটেনের এই বোর্ডিং স্কুল কালচার ছড়িয়ে পড়েছিল উপনিবেশগুলোতেও। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত কিছু বিখ্যাত বোর্ডিং স্কুল, যেমন দার্জিলিঙের সেন্ট পলস স্কুল, গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া স্কুল, দেরাদুনের দুন স্কুল, আজমিরের মেয়ো কলেজের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর ধরে চলেছে এই অনুশীলন। কয়েক বছর আগে সিন্ধিয়া স্কুলের ক্লাস এইটের এক ছাত্র আত্মহত্যার চেষ্টা করলে এই তথ্য সামনে আসে। পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ ছিলেন সিন্ধিয়ার প্রাক্তনী। তিনি নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন সেই সময়। তিরানব্বই বছর আগের সেডবার্গ স্কুলের সেই নাম-না-জানা ছাত্রটি, ন’বছর আগের সিন্ধিয়া স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্রটি, কিংবা যাদবপুরের বাংলা প্রথম বর্ষের ছাত্রটি। তিলোত্তমা, ভাবতে পারছি না, চিনতে পারছি না তোমায়, চুমুর দিব্যি, চিনতে চাই, জানতে চাই কেন বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়তে এসেছিল সে। সে স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে গিয়েছে, পড়ে আছে শুধু কিছু কথা, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
তিলোত্তমা, চুমুর দিব্যি, প্রেম নেই, যৌনতা আছে, ভালবাসা নেই, ন্যক্কারজনক নির্যাতন আছে, মেধার আবাসভূমি বলেই কি রাজনীতির এত বাড়াবাড়ি?