পানের দোকানে বসেই লিখে ফেলেছেন ১১টি উপন্যাস। যদিও ছাপা হয়নি সেগুলো। পানওলা বলেই এখনও তাঁর মোবাইলেই পড়ে রইল উপন্যাসগুলি। আক্ষেপ পিন্টুর।
বেহালা ও টালিগঞ্জের সংযোগ তৈরি করেছে যে পথ, বর্তমানে তাকে ভাগ করা হয়েছে বিরেন রায় রোড, রাজা রামমোহন রায় রোড… প্রভৃতি নামে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকারী পথ হওয়ার জন্য এই পথে গাড়ি চলাচল এখন অনেক বেশি। সাধারণ মানুষকে রাস্তা পার হতে হলে অপেক্ষা করতে হয় তা ছাড়া গাড়ির হর্ন আর ইঞ্জিনের শব্দে কানে তালা পড়ার জোগাড় হয়।
এই রাজা রামমোহন রায় রোডেই আবার মদনমোহন তলা বাজার। সেই বাজারে সকাল থেকেই যে চিৎকার শুরু হয় তাও কানে তালা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য কম নয়। এই বাজারেই দেখতে পাবেন তিন ফুট বাই তিন ফুটের ছোট্ট একটা টিনের গুমটির পান দোকানে, বেলা একটু বাড়লেই যা হয়ে যায় আগুনের মতো সেই দোকানে বসে বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতার চিৎকার চেঁচামেচি, পথের কানে তালা ধরানো গাড়িঘোড়ার হর্ন ও ইঞ্জিনের শব্দকে উপেক্ষা করে একমনে লিখে চলেছেন একজন সাহিত্য সেবক। এক নয় দুই নয় দীর্ঘ বাইশটা বছর তিনি এভাবেই লিখে চলেছেন। তিনি লেখক পিন্টু পোহান। জন্ম ১৯৭৮, কলকাতার এক নিম্নবিত্ত পরিবারে। পিতা পূর্ণচন্দ্র পোহান। মা উজ্জ্বলা দেবী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠ। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু জয়শ্রী হরিচরণ বিদ্যাপীঠে, পরে বড়িশা শশীভূষণ জনকল্যাণ বিদ্যাপীঠ থেকে মাধ্যমিক ও সোদপুর শ্রীমন্ত বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর কলেজে ভর্তি হয়েও আর্থিক কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বন্ধ রেখে জীবন ও জীবিকার পথের সন্ধানে বের হতে হয়। দিনের পর দিন পথ হাতড়ে বেরিয়ে শেষে নিরাশ হয়ে বেহালার মদনমোহন তলায় ফুটপাতে এই অস্থায়ী দোকান খুলে শুরু করেন নতুন করে জীবন সংগ্রাম।
আরও পড়ুন : ২৫ দিনের পর জামিন পেলেন আরিয়ান, আজই ফিরতে পারছেন না মন্নতে
লেখক হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর ছেলেবেলা থেকেই। লেখার অভ্যাসও ছিল তাঁর সেজন্যই শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক নয়, পাঠ্যপুস্তকের বাইরে প্রচুর গল্প-কবিতার বই পড়তেন। দারিদ্রসীমার নীচে বাসকরা একটি পরিবারের ছেলে, যার জানার আগ্রহ ছিল অসীম, পাশে সেভাবে কাউকে না পেলেও পেয়েছিল স্থানীয় একটি গ্রন্থাগার। পেয়েছিল দু’একটি কালোয়ারের দোকান, যেখানে কেজি দরে বই পাওয়া যায়। সেগুলোর সাহায্য সম্বল করেই এগিয়ে ছিল তার সাহিত্য সাধনা। তিনি দোকান দিয়ে আর্থিক অভাব-অনটনের সমস্যা কিছুটা মেটাতে পারলেন বটে, কিন্তু দেখা দিল অন্য সমস্যা। মাসের পর মাস দোকানদারি করেই কেটে যায়। না পারেন নতুন কোনও বই পড়তে , না পারেন নতুন কোনও গল্প লিখতে।
এদিকে আবার দোকান বন্ধ রেখে সাহিত্য চর্চা করতে গেলে যে তিনি আরও আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়বেন সেই অপ্রিয় সত্যটাও তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গিয়েছেন। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে অবশেষে তিনি একটা ব্যবস্থা করে ফেললেন কিছুদিনের মধ্যে। দোকানে বসেই তিনি লিখতে আর পড়তে শুরু করলেন। বিষয়টা অনেকেই ভালো চোখে নিল না।
তাঁর চারপাশের তথাকথিত সভ্য সমাজের অনেক সদস্যর মনে হল, এ নিছক পাগলামি ছাড়া কিছু নয়। তাঁরা আর স্থির হয়ে থাকতে পারলেন না। শুরু করলেন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। হাজারো মানুষের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপকে উপেক্ষা করে পথের পাশে তাঁর সেই ছোট্ট দোকানে কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি চালিয়ে গেলেন তাঁর সাহিত্যচর্চা। দোকানে বসেই খাতা পেন হাতে লিখে চলেন ৷
আরও পড়ুন : আরিয়ান মামলার অফিসার ইনচার্জ সমীর ওয়াংখেড় নন, সাফ জানাল NCB
তিনি বন্ধুদের নিয়ে ” এবার বাঁধনছেঁড়া” নামের একটি পত্রিকাও বের করতে শুরু করলেন। আর্থিক কারণে সেই পত্রিকা কয়েক বছর চলার পর বন্ধ হয়ে গেলে বড় মানসিক আঘাত পান তিনি। কিন্তু আবার নিজেকে সামলে নেন। লেখার ক্ষেত্র বাড়িয়ে নেন। স্থানীয় কয়েকটি পাক্ষিক সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা করার পাশাপাশি নিয়মিত গল্প-কবিতা লিখে পাঠাতে শুরু করেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারির সমস্ত পত্র-পত্রিকায়।
একটি স্কুলের ম্যাগাজিনে বন্ধুর নামে যার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়েছিল, শুকতারার গল্প প্রতিযোগিতায় ভাল গল্প লেখার জন্য যার কখনও কখনও নাম প্রকাশিত হত, তাঁর লেখাই প্রকাশিত হতে শুরু করল আনন্দবাজার পত্রিকা, আনন্দমেলা, সানন্দা, দেশ, নবকল্লোল, শুকতারা, কৃত্তিবাস, শিলাদিত্য… বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। শুধু লিখে আর ছোট্ট একটা দোকানের ওপরে ভরসা করে যে নিজেকে আর পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না বুঝতে পেরে তিনি বাংলা সাহিত্যে এমএ হন সেই দোকানে বসেই পড়াশোনা করে। তিনি বাংলা সাহিত্যে এমএ। আজ তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার। পারুলমাসির ছাগলছানা, নোটন নোটন পায়রাগুলি, ইলিশখেকো ভূত ও কচুরিপানার ভেলা। তবু আজও কখনও যদি বেহালার মদনমোহন তলায় যান, দেখতে পাবেন, ফুটপাতের একটা ছোট্ট দোকানে রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে দোকানদারির পাশাপাশি মানুষের সাধক। তাঁর নাম পিন্টু পোহান।