নয়াদিল্লি: রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব (Alapan Bandyopadhyay) ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামলায় হাইকোর্টে রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলল কেন্দ্র। সোমবার সুপ্রিম কোর্টে আলাপন (Alapan Bandyopadhyay) মামলার শুনানির সময় কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা অভিযোগ করেন, আলাপন মামলায় হাইকোর্ট যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তাতে রাজনৈতিক রং রয়েছে। বিচারপতি এএম খানবিলকর ও বিচারপতি সিটি রবিকুমার তুষার মেহতার বক্তব্য শুনলেও এ দিন রায়দান স্থগিত রাখেন। এই মামলায় রাজ্যের প্রাক্তন আমলার হয়ে সওয়াল করছেন বরিষ্ঠ আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি (Alapan Bandyopadhyay case)।
সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল (CAT) আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামলা দিল্লিতে স্থানান্তর করলে, সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে গিয়েছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। উচ্চ আদালত আলাপনের পক্ষেই রায় দিয়ে ‘ক্যাট’-এর এই নির্দেশ খারিজ করে দিয়েছিল।
আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামলা কেন দিল্লির প্রিন্সিপ্যাল বেঞ্চে সরানো হল, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে হাইকোর্ট। রাজ্যকেন্দ্রিক বিষয় দিল্লিতে পাঠানো নিয়ে আপত্তিও ছিল আদালতের। বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য ও রবীন্দ্রনাথ সামন্তের ডিভিশন বেঞ্চ পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছিল, ‘প্রকৃত ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়।’ এই পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতেই হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আলাপনের মামলা দিল্লিতে সরানো যাবে না।
ক্যাট নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায় কেন্দ্র। এই মামলায় হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের এক্তিয়ার নিয়েও শীর্ষ আদালতে প্রশ্ন তোলেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। এ দিন এই মামলাতেই কেন্দ্রের তরফে আইনজীবী হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে রাজনৈতিক রঙের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন।
আলাপন মামলা সরানোর নির্দেশ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী বলে দাবি করেছিল হাইকোর্ট। এ দিন সুপ্রিম শুনানির সময় কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা বললেন, ‘এখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা কোথা থেকে আসছে? ক্যাটের চেয়ারম্যান শুধু এক বেঞ্চ থেকে আর এক বেঞ্চে মামলা স্থানান্তরিত করেছে।’ এই ধরনের পর্যবেক্ষণে রাজনীতির প্রভাব আছে বলে দাবি করেন তিনি। তাঁর মতে, এই ধরনের পর্যবেক্ষণ এড়িয়ে চলা উচিত।
সলিসিটর জেনারেলের মন্তব্যের বিরোধিতা করে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি বলেন, ‘পর্যবেক্ষণে কাউকে আঘাত করা হয়নি। আলাপন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি বরাবরই কলকাতায় থেকেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের আইএস এফিসার। পশ্চিমবঙ্গেই বরাবর কাজ করেছেন। অবসরের পরও তিনি কলকাতাতেই থাকছেন।’ তাই এই মামলা কলকাতাতেই থাকা উচিত ছিল বলে তিনি পাল্টা দাবি করেন।
ঘটনার সূত্রপাত ঘূর্ণিঝড় ইয়াসকে কেন্দ্র করে। ২৮ মে ইয়াসে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ বৈঠক ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কলাইকুন্ডায় এই বৈঠক ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৎকলীন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু, তিনি মমতার সঙ্গে ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে দিঘায় চলে যাওয়ায়, ওই বৈঠকে বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যের প্রশাসনিক বৈঠকে যোগ দিতে পূর্ব মোদিনীপুরে চলে যান।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই জলঘোলা শুরু হয়। কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রের তরফে অভিযোগ করা হয়, প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি না নিয়েই বৈঠক ছেড়ে চলে গিয়েছেন আলাপন। যদিও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের এই অভিযোগ খণ্ডন করে জানান, নরেন্দ্র মোদির অনুমতি নিয়েই সে দিন আমার সঙ্গে বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন আলাপন। এই চাপানউতরের মধ্যেই দিল্লিতে নর্থ ব্লকে হাজির হতে বলা হয়েছিল আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু তিনি দিল্লিতে না গিয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। মমতার আবেদনের প্রেক্ষিতে কেন্দ্র তাঁর চাকরির মেয়াদ তিনমাস বাড়ালেও আলাপন তা গ্রহণ করেননি।
আরও পড়ুন : আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে কোনও গলদ নেই জানাল শীর্ষ আদালত
এর পরই কেন্দ্রের তরফে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে কড়া চিঠি পাঠানো হয়। ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকে উপস্থিত না হওয়ায় আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিপর্যয় মোকাবিলা আইন ভঙ্গ করার অভিযোগ ওঠে। বিপর্যয় আইনে তাঁর বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে শো-কজ করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শো-কজের জবাব দিয়ে চাকরি থেকে তিনি ইস্তফা দেন।
তার পরেও কিন্তু আলাপন বিতর্ক থামেনি। নির্ধারিত সময় দিল্লিতে যোগ না দেওয়ায় রাজ্যের মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে শো-কজ করে কেন্দ্র। ডিপার্টমেন্ট অফ পার্সোনেল অ্যান্ড ট্রেনিং-এর তরফে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করা হয়। এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়া খারিজ করার জন্য ‘সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনালে’র কলকাতা বেঞ্চে মামলা করেছিলেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিবের অভিযোগ, অবসরপ্রাপ্ত কর্মী হিসেবে তাঁর যে সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য, তা তিনি পাচ্ছেন না। এই দাবিতে কলকাতার ক্যাটের বেঞ্চে যান তিনি। ২২ অক্টোবর ক্যাট (CAT)-এর কলকাতা বেঞ্চ থেকে মামলা দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় প্রিন্সিপাল বেঞ্চ। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই হাইকোর্টে যান আলাপন।