বেশ কিছুদিন ধরেই মেজাজাটা কেমন যেন বিগড়ে আছে! অনেক ভেবেও তেমন কোনও কারণ খুঁজে পাননি। এ দিকে, মেজাজের বারোটা বেজে যাওয়ার কারণেও ঘরে-বাইরে আপনার রোষের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। বাড়ছে তিক্ততা, বিরক্ত আপনিও। মাঝে মধ্যে মনে হয় এই সব কিছুর জন্য এই হিমেল হাওয়াই দায়ী। তবে মন খারাপের বৃষ্টি হলেও মন খারাপের শীতকাল আবার হয় নাকি?
মনোবিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন হতেই পারে। আবহাওয়ায় তারতম্য কিংবা পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে আমাদের মনের উপর। বিদেশে এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা ও আলোচনা হলেও ভারতে সে ভাবে পরিসংখ্যান দিয়ে এই অসুখের ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন। তা বলে সমস্যা যে নেই তা কিন্তু নয়। এই নিয়ে কলকাতা টিভি ডিজিটালের প্রতিনিধি সুদেষ্ণা নাথের সঙ্গে কথা বললেন বিশিষ্ট মনোবিদ দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
আবহাওয়ার পরিবর্তন ও মন খারাপ
শীতকালে দিন ছোট ও রাত বড় হওয়ার কারনে ঠিকমতো সূর্যের আলো পাই না আমরা। মাঝেমধ্যেই মেঘলা আকাশ ও হিমেল হাওয়ায় প্রভাবিত হয় আমাদের সার্কাডিয়ান রিদম(circadian rhythm)। সার্কাডিয়ান রিদম বিঘ্নিত হলে প্রভাব পড়ে শরীর ও মনের উপর।
এই সার্কাডিয়ান রিদম ঠিক কী?
সার্কাডিয়ান রিদম (circadian rhythm) কিংবা সহজ ভাষায় যাকে বলে বডি ক্লক(body clock)।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত, আমাদের শরীরে, মনে ও ব্যবহারে কিছু স্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে। আমাদের ইকো সিস্টেম(eco system) বিশেষ করে সূর্যের আলোর (sunlight) সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা ২৪ ঘন্টার এই চক্রকে বলা হয় সার্কাডিয়ান রিদম। এই সার্কাডিয়ান রিদম বিভিন্ন কারনে প্রভাবিত হতে পারে। সেগুলির অন্যতম আবহাওয়ার পরিবর্তন। বিশেষ করে এই পরিবর্তনে আমাদের শরীর পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পাচ্ছে কি না এবং যেটা পাওয়া যাচ্ছে সেটা প্রয়োজনের থেকে কম না বেশি, এর সরাসরি প্রভাব পড়ে আমাদের সার্কাডিয়ান রিদমের উপর। ফলে প্রভাবিত হয় আমাদের শরীর ও মনও। দেখা দেয় সিজনাল এফেক্টিভ ডিসর্ডার(seasonal affective disorder)।
সিজনাল এফেক্টিভ ডিসর্ডার ঠিক কী
আবহাওয়ার পরিবর্তনে অনেকে যেমন শারীরিক সমস্যায় ভোগেন, তেমন আবার একাংশের মধ্যে দেখা দেয় মুড ডিসর্ডার(mood disorder)। ডাক্তারি ভাষায় একে বলা হয় সিজনাল এফেক্টিভ ডিসঅর্ডার (Seasonal affective disorder) কিংবা স্যাড (SAD)। মনোবিজ্ঞানে ডায়গোনস্টিক সিস্টেম ম্যানুয়াল ফাইভ (diagnostic system manual5)বা (DSM 5) অনুযায়ী এই স্যাড (SAD) হল ডিপ্রেশনের(depression)একটি সাব সেট(sub-set)।মানে, এই সিজনাল এফেক্টিভ ডিসর্ডার হল এক ধরনের ডিপ্রেশন (depression)। তবে এর লক্ষণ ডিপ্রেশনের ঠিক উল্টো।
লক্ষণগুলো কী?
অন্য সময় যে মানুষটি একদম ঠিকঠাক থাকেন। সেই তিনিই হয়ত আবহাওয়ার বদলের সময় ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁর স্বভাবে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন-
কীভাবে বুঝবেন আপনি স্যাড-এ ভুগছেন?
পশ্চিমের দেশগুলিতে এই সিজন্যাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডারের(seasonal affective disorder) প্রভাব আরও বেশি দেখা যায়। তাই সহজে বোঝ যায়। তুলনায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে(South Asian Countries)আবহাওয়ার পরিবর্তন সেভাবে গ্রাহ্য করা হয় না। তাই শীতকালে বেশি ঘুম পাওয়া কিংবা অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা তৈরি হলেও, এটা সাময়িক বলে উপেক্ষিত থাকে। তাই সমস্যার সুরাহা হয় না। এর প্রভাব পরে নিত্যদিনের জীবনযাপনেও। আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় কোনও বিশেষ কারণ ছাড়াই অযথা এক্সট্রিম অ্যাংজাইটি (extreme anxiety)বা প্রচণ্ড উদ্বেগে ভোগেন তা হলে বুঝতে হবে স্যাডের সমস্যা রয়েছে। এই উদ্বেগই হল রোগের সংকেত।
কোন বয়সিদের মধ্যে এর প্রভাব দেখা যায়
যে কোনও ব্যক্তির এই সিজন্যাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার হতে পারে। তবে কিশোরদের মধ্যে ও ষাটোর্ধ্বদের মধ্যে এই স্যাডের(SAD)প্রভাব বেশি দেখা যায়। সময়ে ব্যবস্থা না নিলে অন্যান্য শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
সমস্যা সমাধানের পথ
আমরা একটা ইকো সিস্টেমের(eco system) মধ্যে বসবাস করি। সেই ইকো সিস্টেমে(ecosystem) যে কোনও পরিবর্তনের প্রতি আমাদের শরীর ও মন অত্যন্ত সংবেদনশীল। নিত্যদিনের জীবনযুদ্ধে আমরা এই পরিবর্তন গ্রাহ্য না করলেও প্রভাবিত হয় শরীর ও মনে।
তাই স্যাড কাটিয়ে উঠেতে সজাগ হতে হবে। হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও এই কাজগুলো করলে উপকার পাবেন-
স্যাডের হাত ধরে অন্য কোনও মানসিক সমস্যার সম্ভাবনা ?
এই সমস্যায় যাঁরা ভোগেন তাদের প্রায় ২৫ শতাংশের পরবর্তী ক্ষেত্রে বাইপোলার ডিসর্ডারের(bipolar disorder)সমস্যা হয়। তাই স্যাড(SAD) যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়ে বা বছরে তিন বারের বেশি হয় তা হলে অবশ্যই মনোবিদের পরামর্শ নিন। পরিস্থিতি অবনতি হলে প্রয়োজনে এই সমস্যার জন্য ব্রাইট লাইট থেরাপি(bright light therapy) ব্যবহার করা যেতে পারে।
তবে এই সমস্যা কিন্তু হালফিলের নয়, শুনলে অবাক হবেন ১৯৮৪ সালে আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে মুডের পরিবর্তনের কথা প্রথমবার আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ(National Institute of Mental Health ) নথিভুক্ত করেছিলেন ডাঃ রোজেনথ্যাল ও তার সহকর্মীরা।
(দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, কনসালটেন্ট জেরিয়াট্রিক সাইকিয়াট্রিস্ট, কলকাতা অ্যান্ড মেম্বার, ইন্টারন্যাশনাল সাইকোজেরিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন)