মা দুগ্গা আসার আগেই ধরাধামে নেমে আসেন কিশোরকুমার। এ বার যেন মহালয়া থেকে পুজো শুরু হয়েছে। ঘরে দেবতা নেই, মণ্ডপও কেমন দরকচা মেরে আছে। কিন্তু তাতে কী! কলকে ফুলের মতো রাশি রাশি চোঙা। কিশোরকুমার গাইছেন, ‘আরও কাছাকাছি। আরও কাছে এসো।’ উফফ কী মাচো ডাক। কেউ কি আসছে? মুখে বাঁশি নিয়ে ট্রাফিক পুলিশ ছুটছে, হাতিবাগানের হাটে ছেঁড়া জিন্সের ফাঁকে নিশির হাতছানি, প্রবল যানজটে ট্রাক ড্রাইভার খইনি ডলছে, কে যেন সেদিন বলল, ‘রাস্তায় গাড়িতে চড়ে বসলে মশাই অখণ্ড সময়। নাপিত ডেকে গাড়িতে বসেই দাড়ি কামিয়ে নিতে পারি। গাড়ি নড়বে না।’ তবু কিশোরকুমার গাইছেন, ‘মন যে মানে না…।’ উত্তরে আশা ভোঁসলের নখরা, ‘অবুঝ হয়ো না।’ মনে পড়ল একটা দাঁড়িয়ে থাকা লাল গাড়িতে উঠে নাচছিলেন নায়িকা। আর নায়ক দু’হাত বাড়িয়ে তাঁকে ডাকছিলেন, ‘আরও কাছ এসো।’ হুতোমের ভাষায়, ‘ সহরে ঢি ঢি হয়ে গ্যাছে, আজ রাত্তিরে অমুক জায়গায় বারোইয়ারি পূজোয় হাফ আকড়াই হবে। কি ইয়ারগোচের স্কুলবয়, কি বাহাত্তুরে ইনভেলিড, সকলেই হাফ আখড়াই শুনতে লাগল। বাজার গরম হয়ে উঠল। ধোপারা বিলক্ষণ রোজগার কত্তে লাগল। কোঁচান ধুতি, ধোপদস্ত কামিজ ও ডুরে শান্তিপুরে উড়ুনির এক রাত্তিরের ভাড়া আট আনা চড়ে উঠল।’
মণ্ডপে দেবতা এল কি এল না, কলকাতা দিব্যি চিঁড়েচ্যাপ্টা
(ছবি সৌজন্য: Pixabay)
কিন্তু হুতোমের কলকেতা আর নেই। এখন মেজাজমর্জি আলাদা। কেউ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিল, ফিলিং ডিসগাস্টেড, কেউ লিখল, ফিলিং ট্রাফিক পুলিশ, চোখে চশমা ঠোসা, ফতুয়া পরা এক আধবুড়ো শুধু লিখল, ‘ফিলিং হুতোম প্যাঁচা।’ আমি কখন কী ফিল করি, আমি রাত্তিরে ঘুমাই, নাকি ওঠে ঘনঘন হাই—সব জাকারবার্গের খেরোর খাতায় লেখা হচ্ছে অহর্নিশ। অতএব একে তো অনন্ত যানজট, তার উপর কিশোরকুমারের কাছে আসার ডাক—-এসব দেখেশুনে কে যেন প্রিয়মানুষকে লিখল, ‘ফিলিং চিঁড়েচ্যাপ্টা।’ মণ্ডপে দেবতা এল কি এল না, কলকাতা দিব্যি চিঁড়েচ্যাপ্টা।
আজ পুজোর নেট প্র্যাক্টিস
(ছবি সৌজন্য: Pixabay)
করোনার তৃতীয় ঢেউ এখনও আসেনি। অতএব ‘আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি।’ মা দুগ্গা দিন কতক নিভৃতবাসে ছিলেন। সেইসময় মণ্ডপে দেবতার আসনে বসেছিলেন কিশোরকুমার। উত্তর কলকাতার এক পুজো মণ্ডপে দিন দুই আগে উঁকি মেরে দেখলাম, কেউ নেই। শুধু কিশোরকুমার বাজছে, ‘আমার পূজার ফুল ভালোবাসা হয়ে গেছে, তুমি যেন ভুল বুঝো না।’ কে ভুল বুঝবে? ভুল বোঝার আছেটাই বা কে?
আপনার চাঁদাটা?
(ছবি সৌজন্য: Facebook)
আজ পুজোর নেট প্র্যাক্টিস। মফসসলের ছেলেরা বিল হাতে ঘুরছে। বিলে কত নাম। সভাপতি গজপতি গুঁই, যুগ্মসম্পাদক, মিঠুন সরখেল ও ভুবন পোদ্দার, কোষাধ্যক্ষ, পালান সাহা। রাস্তাঘাটে লোক দেখলেই গলায় গামছা প্যাঁচাতে বাকি রাখছে। আপনার চাঁদাটা? আবার মনে পড়ল হুতোমের কথা। ছেলেছোকরারা সিংগিবাবুদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। সিংগিবাবু সে সময় আপিসে বেরুচ্ছিলেন। সেই সময় চার-পাঁচ জনে তাঁকে ঘিরে ধরে ‘ধরেছি ধরেছি’ বলে চেঁচাতে লাগলেন। সিংগিবাবু বললেন, ব্যাপারখানা কী? এক জন তাঁকে বলল, কৈলাশ থেকে আসার সময়, সিংগির পা ভেঙে গেছে। সুতরাং মা বাহন ছাড়া আসতে পারছেন না। মা আমাদের স্বপ্ন দিয়েছেন, যদি কোনও সিংগি জোগাড় করতে পারি, তবেই তিনি আসবেন। আজ বহু খুঁজে আপনাকে পেয়েছি। চলুন, চলুন। সিংগিবাবু অতঃপর ছেলেদের কথায় খুশি হয়ে দশ টাকা চাঁদা দিলেন।
শুধু প্রেম আর বিরহ
(ছবি সৌজন্য: Pinterest)
বারো ইয়ারের কত রঙ্গে ভরে উঠেছে বঙ্গদেশ। আজ কিশোরকুমার এসেছেন। কাল আসবেন মান্না দে। পথেঘাটে আকুলিবিকুলি…যদি কাগজে লেখো নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে…। শুধু প্রেম আর বিরহ। হাজার আলোর রোশনাইয়ে দীর্ঘশ্বাসের দিনলিপি। ওদিকে ঘাপটি মেরে বসে আছেন হেমন্ত মুখুজ্জে। বেবাক নিশ্চল হয়ে পড়া শহরে তিনি ছাড়া কে-ই বা গাইবেন, পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি।