বাঁকুড়া: একদিকে করোনা আর অন্যদিকে আফগানিস্তানের তালেবান রাজ। এই সব কিছুর মাঝেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলার অন্যতম সোনাঝুরির পাগড়ি শিল্প।বাঁকুড়ার প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে পাগড়ি শিল্প অন্যতম। কিন্তু যাদের জন্য পাগড়ি তৈরি করা বর্তমানে তাদের জীবন এখন সংকটে। এককথায় কাবুলে তালিবান শাসনের জেরে আফগানদের জন্য তৈরি পাগড়ি শিল্প এখন ক্ষতির মুখে।তাই পেশার তাগিদে বর্তমানে পাগড়ি ছেড়ে শাড়ি বুনছেন পাগড়ি শিল্পীরা। বাজারদর পড়ে যাওয়ায় কোন রকমে এখন শাড়ি বুনে দিন চালাচ্ছেন সোনামুখীর পাগড়ি শিল্পীরা।
বাঁকুড়ার সোনামুখী শহরের পাগড়ি শিল্প বেশ জনপ্রিয়। পরম্পরায় এই শিল্প তাক লাগিয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। বিশেষ করে আফগানিস্থান, পাকিস্তান ও সৌদি আরবে। তবে এই পাগড়ি শিল্পের সুত্রপাত ও আবির্ভাব হয়েছে সোনামুখীতে। ব্যবসার সুবাদে আসা কাবুলিওয়ালাদের হাত ধরেই শুরু হয় বাংলায় পাগড়ি শিল্পের যাত্রা।
জানা যায়, আফগানিস্থান থেকে সোনামুখী শহরে একসময় হিং বিক্রি করতে আসতেন কাবুলিওয়ালারা। তাঁরা মাথায় যে পাগড়ি পরে আসতেন সেই পাগড়ির অনুকরণেই সোনামুখীর কৃষ্ণবাজারে শুরু হয় পাগড়ি বোনা। তাঁতিদের হাত ধরেই সিল্কের কাপড় দিয়ে প্রথম তৈরী হয় পাগড়ি। সোনামুখীর তাঁত শিল্পীদের নিপুন হাতে বানানো সিল্কের তৈরি এই পাগড়ি নজরে আসে কাবুলিওয়ালাদের। আর তার পরেই হিং বিক্রি করতে এসে এক কাবুলিওয়ালা তা সংগ্রহ করে নিয়ে যান নিজের দেশে। নতুন রকম এই পাগড়ি দেখতে ছিল বেশ। ফলে খুব অল্প সময়েই সোনামুখীর তাঁত শিল্পীদের তৈরি পাগড়ির চাহিদা বেড়তে থাকে। কাবুলিওয়ালদের হাত ধরেই শুরু হয় এদেশ থেকে পাগড়ি আদান প্রদান। ভালো দাম মেলায় ধীরে ধীরে পাগড়ির পাশপাশি শুরু হয় গামছা ও চাদর বোনা। পাগড়ি শিল্পের জন্য ক্রমশই সুনাম বাড়তে থাকে বাঁকুড়ার এই ছোট্ট সোনামুখী শহরের।
আরও পড়ুন নতুন বছরে অনলাইন লেনদেনে বদল আনছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া
প্রায় পাঁচ দশক ধরে চারশো টাকা থেকে চার হাজার টাকা দামের সেই সব পাগড়ি কলকাতা ও দিল্লীর রপ্তানিকারী একাধিক সংস্থার হাত ধরে পাড়ি দিত আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও সৌদি আরবে। প্রতি মাসে সোনামুখীর তাঁতে তৈরী কয়েক হাজার পাগড়ি পৌঁছোত ওই তিন দেশে।কিন্তু করোনার জেরে লকডাউন ঘোষণা হলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় পাগড়ি শিল্পীরা। ধীরে ধীরে সেই সামলে উঠে ফের জেগে ওঠে এই শিল্প। কিন্তু সম্প্রতি আফগানিস্থানে তালিবান আগ্রাসনের জন্য পাগড়ি শিল্প নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে।
আরও পড়ুন স্কুল বন্ধের জের, মোবাইলের প্রতি আসক্তি বাড়ছে স্কুল পড়ুয়াদের
সোনামুখী থেকে শেষ জুলাই মাসে কয়েকশো পাগড়ি পাড়ি দেয় আফগানিস্তানে। তারপর থেকে পাগড়ি রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ। এমনটাই দাবি সোনামুখীর শিল্পীদের। তবুও আশার আলো নিয়ে শোনা যাচ্ছিল তাঁত যন্ত্রের শব্দ। বাড়িতে বাড়িতে চলছিল চরকা ঘুরিয়ে সুতো কাটার ব্যস্ততা। কিন্তু পাগড়ি বিক্রি না হওয়ায় এবার টান পড়ছে মূলধনে। কিভাবে বিক্রি হবে পাগড়ির সেই চিন্তায় রাতের ঘুম ছুটেছে শিল্পী ও তাদের পরিবারের। এই চিন্তায় পুজোর মুখে দিশেহারা সোনামুখীর কৃষ্ণবাজারে পাগড়ি শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে ভাবে যুক্ত কয়েক হাজার তাঁত শিল্পী। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ার তাঁত শিল্পীরা এখন পাগড়ি ছেড়ে শাড়ি বোনার কাজও শুরু করেছেন। তাই বাড়িতেই জমছে পাগড়ির স্তূপ। যে আশায় কাবুলিওয়ালাদের জন্য পাগড়ি বোনা শুরু হয়েছিল, সেই সোনামুখীর পাগড়ি শিল্প আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে।