চলে গেলেন ঈশ্বরের সন্তান। চলে গেলেন জম্মুর সবথেকে সেরা প্রতিভা। চলে গেলেন ভারতবর্ষের আর এক অমূল্য রত্ন। মঞ্চের মাঝে আর ধ্যানে বসবেন না পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা। মাথার ওপর শুধুমাত্র একটা নীল আলো, কোলের ওপর সদ্যোজাত সন্তানস্নেহে রাখা যন্ত্রটি, দুই হাতে আঙুলে সন্তুরের দুই ছড়ি মাতাল করে রেখেছে গোটা অডিটোরিয়াম, দর্শক তন্ময় হয়ে রয়েছে শুধুমাত্র সুরের জাদুতে।
প্রাচ্যের যন্ত্রসংগীত যে কত শক্তিশালী, যেকোনো মুহূর্তে সৃজন করতে পারে নির্বানার পৃথিবী তা বুঝি শিব কুমার শর্মা ছাড়া আর কেউ জানতেন না। ম্যাজিক অনেকেই জানেন, কিন্তু ম্যাজিকের মোহজাল যে সবার আয়ত্তে থাকে না। এমনি এক শিল্পী তিনি যার বাজনা শুনতেন শিল্পীরা, আর ডাক্তাররা তাকে বলতেন তবলা ছাড়া তাকে রেকর্ড করার জন্য যাতে মিউজিক থেরাপিতে ব্যবহার করা যায়। তার বাজনা শোনানো হতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাসপাতালের ICCU তে থাকা গভীর কোমার রোগীদের। আশ্চর্যজনক ভাবে সাড়াও মিলতো রোগীদের। শোনা যায়, কোমায় থাকা কিংবদন্তি রেসার মাইকেল শুমাখারকে মিউজিক থেরাপির জন্য শিব কুমার শর্মার মিউজিক ব্যবহার করা হয় প্রতিদিন।
৮৪ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আজ ভোরে চলে গেলেন তিনি। মৃত্যু আসলে তাকে নিয়ে গেলো না, মৃত্যু আসলে এক অধ্যায় কে আজ পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে দিলো সকলের অলক্ষে। নিঃস্ব করে দিয়ে গেলো জম্মু কাশ্মীরের মিউজিকের ইতিহাসকে। নিঃস্ব করে দিয়ে গেলো বলিউড এর স্বর্ণযুগের এক ইতিহাসকে। নিঃস্ব করে দিয়ে গেলো কালজয়ী ভারতীয় রাগসঙ্গীতের ইতিহাসকে। জম্মুর এক প্রাচীন, অতি প্রাচীন যন্ত্র ছিল এই সন্তুর। বাজানো খুব একটা সহজ ছিল না। মূলত সুফী গানের সঙ্গেই ব্যবহার করা হতো এই যন্ত্র। বাবা ছিলেন প্রথিতযশা শিল্পী। বাবার কাছেই ১৩ বছর অবধি শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম এবং তবলায় রেওয়াজ। হটাৎ করেই একদিন চোখ পড়লো সন্তুরে। সেই শুরু যার শেষ ১০ই মে’র সকালে, প্রয়াণ মুহূর্তে।
একসময় অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। চালচুলো ছিলোনা এই ছেলের। জানতেন না ভবিষ্যৎ কোন দিকে নির্ধারিত। কিন্তু কথা থেকে যেন মনের মধ্যে চলছে একটাই আওয়াজ। সন্তুর নিয়ে অনেক কিছু করা যাবে। দিনে চলতে লাগলো ১৫ থেকে ১৮ ঘন্টা রেওয়াজ। এমন বহু দিন হয়েছে যেদিন বিকেলবেলা বসেছেন রেওয়াজে, রাগ নিয়ে চর্চা করতে করতে বুঝতেই পারেন নি, কখন রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেছে। আর তার সুফল ফলতে লাগলো অচিরেই। মাত্র ১৮ তেই ডাক এলো দেশের সেরা সঙ্গীত সম্মেলন থেকে। সামনের সারিতে বসে তখন উস্তাদ আল্লারাখা, পণ্ডিত রবিশঙ্করের মতো নক্ষত্ররা। এর পরেরটা শুধুই উল্কার মতো উত্থান কাহিনী। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ডাক আসতে লাগলো বিদেশের মাটি থেকে।
শ্রোতারা বিমুগ্ধ এই নতুন যন্ত্রের সুরের তান্ডবে। সুরেলা ভালোবাসায় মাতাল তখন রাগপ্রেমীরা। আর তিনি একমনে সাধনা করা যাচ্ছেন চন্ডিগড়, বেনারস এলাহাবাদ ঘরানার তাল, লয়, রাগ নিয়ে। সাধনা করতে করতে পাল্টেই ফেললেন যন্ত্রটিকে। প্রাচীন সন্তুর নতুন রূপ পেলো তার হাতের জাদু ছোঁয়ায়। তিনিই প্রথম কোলে রেখে সন্তুর বাজাতে শুরু করলেন যাতে হামিং কম হয়। স্ট্রিংয়ে সামান্য কিছু পরিবর্তন করে আওয়াজকে করে তুললেন আরও পেলব, আরও নরম। দেবী সরস্বতী বুঝি সবটুকু উজাড় করে দিলেন তার আঙুলে। সৃষ্টি করলেন নতুন নতুন আলাপ। এক রাগ থেকে আর এক রাগে অনায়াস সেতুবন্ধন তৈরী হলো নতুন ধ্বনি। স্রস্টার অন্তর্ধ্বনি যেন ফুটে উঠলো এই সব নতুন সুর, টান লয়ে।
কিন্তু কিংবদন্তি তো তিনিই হন যিনি নিজেকে প্রতিমুহূর্তে ভেঙে ফেলেন, নতুন করে আবার তৈরী করেন। এক চূড়া থেকে অনায়াসে আর এক চূড়ায় বিচরণ করেন। যেকেনো পরিস্থিতি, পরিবেশ, পরিপ্রেক্ষিতে যারা সহজ সুরের শয়তানি দেখিয়ে বেড়ান। আর মুখচোরা শিব কুমার শর্মার জন্ম যেন ভারতীয় সংগীতের কিংবদন্তি হওয়ার জন্যই। যিনি প্রথম দেখিয়েছিলেন সংগীতের ব্যাকরণ যিনি জানেন তার কাছে সংগীতের কোনো বিভাজন হয় না। যিনি শাস্ত্রীয় সংগীতের সাধনা করতে পারেন। তিনিই আবার হরি প্রসাদ চৌরাশিয়াকে সাথে নিয়ে প্রবলভাবে বাণিজ্যিক ছবি সিলসিলা, চাঁদনী, লামহে, ডরের মতো ছবির সঙ্গীত সৃজন করতে পারেন। যিনি দীর্ঘ এক মাস সন্তুর নিয়ে ক্লাসিকাল কনসার্ট করে শ্রীনগর এয়ারপোর্টে নামার পরমুহূর্তেই যশ চোপড়ার টেলিগ্রাম পান – এখুনি মুম্বাই এসো। বিশ্রাম হবে না। দিল তো পাগল হায় এর মিউজিকে তোমার সাহায্য চাই। সেই তো কিংবদন্তি যার কনসার্ট শেষে ক্যালিফোর্নিয়ার সেরা কার্ডিয়াক সার্জন প্রোগ্র্যাম শেষে বলে বসেন, “আমি রাগ বুঝি না, কিন্তু তোমাকে একটাই অনুরোধ। তবলা এবং তানপুরা ছাড়া কিছু মিউজিক রেকর্ড করো। আমার ধারণা সেটা মিউজিক থেরাপিতে খুব সাহায্য করবে।” এর কয়েক বছর পরে সারা পৃথিবীতে তার সন্তুরের আওয়াজ মিউসিক থেরাপিতে এক নতুন ধারার জন্ম দেয়।
নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সেদিন নেতাজি অন্দর স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। তৎকালীন রাজ্য সরকার সম্বর্ধনা দেয় পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা এবং উস্তাদ জাকির হুসেনকে। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল দুজনের অনুষ্ঠান। এক মঞ্চে দুই কিংবদন্তি। অনুষ্ঠানের দিন সকালে শহরের এক পাঁচতারা হোটেলে ব্রেকফাস্ট টেবিলে সময় দিয়েছিলেন এই প্রতিবেদককে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, জাকিরজির সঙ্গে কি বাজাবেন কিছু পরিকল্পনা করেছেন? উত্তরে ছিল সেই সন্ন্যাসীর স্মিতহাসি। সঙ্গে মৃদুস্বরে শিবজির উত্তর, “পরিকল্পনা করে বাজনা হয় না, প্রতিযোগিতা হয়। বাজনাটা আসে আনন্দে। মুড এর ওপর। আবহাওয়ার ওপর। সঙ্গীর সংগতের ওপর বাজনার গতি নির্ভর করে। মঞ্চে জাকিরজিকে তবলা বাঁধতে দেখলেই ভেতরে সুর খেলা করে। বাকিটা নিজের থেকেই হয়ে যায়।” আরও বলেছিলেন, “এখনকার মিউজিসিয়ানরা এই ধরণের অনুষ্ঠানে কে বড়ো মাতব্বর সেটা প্রমাণ করতে নেমে পড়েন। ফলে শেষমেশ একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরী হয়। সঙ্গীত হেরে যায়। জাকিরজি এবংআমি দুজনেই সংগীতের ছাত্র। আমাদের কিছু প্রমাণ করার নেই। শুধু বাজানোর আনন্দে বাজাবো। ধ্বনি নয়, অন্তর্ধ্বনি নিয়ে বাঁচি আমরা। আমরা হেরে যাবো, জিতে যাবে সঙ্গীত।
সন্তুরের সেই রোমান্টিকতাই আজ ছাই হয়ে গেলো। আজ হার জিত টাই অতীত হয়ে গেলো।