সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বেঁকিয়ে নিতে হয়। ভোটে জনতার রায়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ‘সোনার বাংলা’ গড়তে এই প্রবাদ এখন আপ্ত বাক্য গেরুয়া শিবিরের। জলবৎ কোটি কোটি টাকা খরচ, একাধিক কেন্দ্রীয় এজেন্সি এবং সর্বোপরি বাংলার রাজভবনকে কাজে লাগিয়েও কাজ হাসিল হয়নি। বাংলা দখলের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। বঙ্গবাসী গ্রহণ করেনি বিজেপিকে। ভোটের পর থেকেই বাংলায় বিজেপি প্রায় বেপাত্তা। কিন্তু তাতেও দমেনি কেন্দ্রের শাসক দল। তাই ভোটারদের আঙুলে কালির ছাপ ওঠার আগেই উঠে পড়ে লেগেছে তারা। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার অতিসক্রিয়তায় রাশ টেনে ধরেছে আদালত। অগতির গতি রাজ্যপাল। আসলে বিধানসভা নির্বাচন উত্তরকালে দেশ জুড়ে বিজেপি বিরোধিতার পালে হাওয়া জুগিয়েছে বাংলা তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মোকাবিলায় মোদি-শাহের অন্তিম আশ্রয় বাংলার রাজভবন।
আরও পড়ুন: রাজ্যপালকে মানসিক চিকিৎসার পরামর্শ ফিরহাদের
রাজ্যপাল নিয়োগের নেপথ্যে কেন্দ্রের শাসক দলের ভূমিকা কংগ্রেস আমলেও ছিল। সে নিয়ে বিশেষ করে বাংলায় বিতর্ক হয়েছে। এমনকি রাজ্যপালের অপসারণ চেয়ে পথে নামার ঘটনা রাজ্যের ইতিহাসে নতুন নয়। কিন্তু সেইসব বিরোধ-বিসংবাদকে অনেক পিছনে ফেলে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যৌথ উদ্যোগে রাজ্যের জনমত গুঁড়িয়ে দেওয়ার যে কর্মযজ্ঞ রাজভবন থেকে শুরু হয়েছে, তার নজির নেই।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: ট্যুইটবাবু ধনকড়
রাজভবনের বর্তমান কর্ণাধার জগদীপ ধনকর বাংলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে যেভাবে প্রতিদিন প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে চলেছেন, তা সব সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গত, রাজ্যে কোভিড আক্রান্তের পাশে দাঁড়ানো, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণের মতো সামাজিক কাজে শাসক তৃণমূল তো বটেই এমনকি ভোটে শূন্য পাওয়া বামদলগুলোকেও রাস্তায় দেখা যাচ্ছে। কিন্তু গত ভোটে এক লপ্তে প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠা বিজেপিকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিবাজির বাইরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন: ‘সেইল’ নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈরথ
ভোটের আগে বিজেপির আস্থা ছিল দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর। শাসনক্ষমতার ব্যবহার করেই রাজ্যে পালাবদল ঘটানোর পরিকল্পনা ছিল বিজেপির। তাই গত দশ বছরে বস্তুত রাজ্যের কোনো বিষয়ে ধারাবাহিক কোনো আন্দোলন না করেই স্রেফ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহদের কাঁধে চেপেই স্বপ্নপূরণে বুঁদ হয়ে ছিল বঙ্গ বিজেপি। কিন্তু মোদী-অমিত জুটির বাজারে যে চোরা ধস নেমেছিল, তা টের পায়নি এই ভক্তকুল। এই ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নেওয়া নয়, বরং ঘুরপথে স্বপ্ন পূরণের নিরন্তর ছক কষে চলেছে বিজেপি।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: মিশন ২০২৪
প্লান এ, সিবিআই-ইডি ব্যর্থ হতেই তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছেন রাজ্যপাল। প্রধান বিরোধী দল, ভোটে হেরে ছন্নছাড়া হলে কী হবে এখন মুরলীধর সেনের ব্যাটন তুলে নিয়েছেন ধনকর। কোনো রাখঢাক নেই তাঁর। সরাসরি বিজেপির হয়ে খেলতে নেমেছেন। জেলায় জেলায় নির্বাচনের পর হিংসাত্বক কাজকর্ম হচ্ছে। এই অভিযোগ তুলে জেলা সফরে যাচ্ছেন, তাঁর সফর সঙ্গী সংশ্লিষ্ট এলাকার বিজেপি সাংসদ ও কর্মীরা। সেই জেলা সফরের পরেই রাজ্যপাল নিজের রিপোর্টে বস্তুত বিজেপির তোলা অভিযোগের প্রতিলিপি তুলে ধরেছেন। তাঁর সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই এই ঘোর কোভিডকালে দিল্লি থেকে ছুটে আসছেন আধিকারিকরা। অন্যান্য সাংবিধানিক স্বশাসিত সংস্থার মতো মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন,সংখ্যালঘু কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান বিজেপির শাখা সংগঠনে পর্যবসিত হয়েছে মোদি জমানায়। এইসব কমিশনকে বাংলায় পাঠিয়ে রাজ্যপালের অভিযোগের সমর্থনে মত তৈরি করা হচ্ছে। সবটাই যে হচ্ছে মোদি-শাহের ‘প্ল্যান বি’ অনুসারে, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: মিশন ২০২৪(২)
কিন্তু কিছুতেই জনমানসে দাগ ফেলতে পারছে না বিজেপি। ফলে, রাজভবনের দায়িত্ব আরও বেড়েছে। রাজ্যপাল এখন বিধানসভার বিষয়েও মন্তব্য করতে শুরু করেছেন। সর্বশেষ, তাঁর দিল্লি অভিযান। তাও বিশেষ গায়ে মাখার দরকার হতো না। তিনি তার আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি চিঠি দেন। কিন্তু দিল্লির বিমান ধরার প্রাকমুহূর্তে তিনি সেই চিঠি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে দেন।
স্বভাবতই তাতে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর স্বরাষ্ট্র দফতর রাজ্যপালকে করা জবাব দিয়েছে। রাজ্যের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা এমন বেহাল, যে তাতে রাজ্যপাল ‘ভারাক্রান্ত হৃদয়ে’ মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখতে বাধ্য হয়েছেন। নবান্ন থেকেও সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। স্বরাষ্ট্র দফতরের মতে, ‘মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালের মধ্যে মতবিনিময় ওভাবে (পড়ুন সোশ্যাল মিডিয়ায়) প্রকাশ করে দেওয়া প্রথাগত শিষ্টাচার বিরোধী। নবান্নের দাবি, তাঁর চিঠিতে রাজ্যপাল যেসব কথা বলেছেন তার অনেক কিছুই মনগড়া। এভাবে একতরফা তিনি বলে যাচ্ছেন তাতে রাজ্য সরকার বিস্মিত।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, রাজ্যের বিজেপি সাংগঠনিক দুর্বলতায় পায়ের তলায় মাটি পাচ্ছে না। সেই অভাব পূরণ করতে মরিয়া হয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ফের সামনে এগিয়ে দিয়েছে রাজ্যপালকে। মনে রাখতে হবে, ধনকড়ের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত। অর্থাৎ পরবর্তী লোকসভা ভোট এই রাজ্যপালের আমলেই হওয়ার কথা। গত বিধানসভায় অভূতপূর্ব বিজয়ের পর দেশ জুড়ে বিজেপির বিকল্প খোঁজার তাগিদ বেড়েছে। মমতাকে ঘিরে বিরোধী জোটের সম্ভাবনা জোট যত তীব্র হবে, ততই বাংলাকে বিপদে ফেলার সবরকম চেষ্টা জোরদার করবে কেন্দ্র।