শুভেন্দু ঘোষ : ধর্ম-রাজনীতির পাশাখেলায় পণ ধরতে গিয়ে মোদি সরকারের এখন ভরা রাজসভায় দ্রৌপদীর দশা। দেশের ভিতরে এবং বাইরে ক্রমাগত বস্ত্রহরণ হয়েই চলেছে। ভরসা শুধু একটাই— এই অবস্থায় অলক্ষ্য থেকে বিজেপির মধুসূদন দাদা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কংগ্রেস। সর্বহারা দল কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নেতৃত্বহীনতা, অদূরদর্শিতা, বিচক্ষণ কূটনীতিক নেতাদের বৃদ্ধ হয়ে পড়ার কারণে বিজেপি করেকম্মে খেয়ে যাচ্ছে। ‘হাত’ শক্ত করার মতো কবজির অভাবই এই দুর্দশার কারণ। কংগ্রেস এখন টিকে আছে ট্যুইটারের প্রাতঃকৃত্যে। তা না হলে, পেট্রোপণ্য, দ্রব্যমূল্য, জিডিপি, মুদ্রাস্ফীতি সহ জাতীয় ইস্যু নিয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু কলার উঁচু করা রংবাজি ছাড়া কিছুই ঘটছে না। বিরোধীদের কেউ বিকিয়ে গেছে, বাকিরা বিজেপির আগ্রাসন নীতির হাত থেকে নিজের দুর্গ রক্ষায় ব্যস্ত। উত্তর-আধুনিক ধনতান্ত্রিক কাঠামোয় হাতে নয়, ভাতে মারার কৌশলে মাজা ভেঙে গেছে বিরোধীদের, সেই নীতিতেই পাঁচ আঙুলকে কিছুতেই মুঠো করা সম্ভব হচ্ছে না। আর সে কারণেই বিরোধীদের মুখ সেলাই করতে পাকিস্তান ও কাশ্মীরি জঙ্গির ‘সুতো’ ব্যবহার করছে কেন্দ্র। কিন্তু, ভারতের থেকে দশগুণ শক্তিশালী লাল ফৌজের অরুণাচলে উপদ্রব নিয়ে নিজে কুলুপ এঁটেছে সরকার। তারা অবাধে ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ (ল্যাক) পেরিয়ে ঢুকছে। ভারতীয় সেনার মালবাহকদের চড়চাপাটি মেরে চলে যাচ্ছে। সাঁকো ভাঙছে। সেইখানে পাক বিরোধী ভারতের বজ্রগর্ভ নিনাদ মিউমিউ করছে।
অরুণাচলে নিয়ন্ত্রণ রেখার ও-পারে চিনা সেনার গতিবিধি বাড়ছে। নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছেই চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মির মহড়া, সমরসজ্জা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছর লাদাখের সংঘর্ষের পরেই ভারতীয় সেনার নবগঠিত অ্যাভিয়েশন ব্রিগেডের অধীনে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ইজরায়েলি হেরন ড্রোন উড়ছে দিনে-রাতে। সেই ড্রোন থেকে পাওয়া ছবি, হেলিকপ্টারে লাগানো সেন্সর, গ্রাউন্ড রেডার ও কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবি থেকেই জানা গিয়েছে চীনাদের শক্তিবৃদ্ধির নির্দিষ্ট তথ্য।
আরও পড়ুন : রহস্যের জাল গুটিয়ে আনছে লালবাজার, গড়িয়াহাট জোড়া খুনে চিহ্নিত মূল অভিযুক্ত
সীমান্তের ও-পারে চীনের প্রচুর সেনা মোতায়েন, সীমান্তের কাছে তৈরি নতুন গ্রামগুলিকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা, সীমানার কাছে সামরিক প্রস্তুতি অবশ্যই চিন্তার কথা। কিন্তু ভারতীয় সেনাও শক্তি বৃদ্ধি করেছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোতায়েন করা হয়েছে প্রয়োজনীয় সামরিক সম্ভার ও বাড়ানো হচ্ছে পরিকাঠামো। সেই সঙ্গে, উচ্চ প্রযুক্তির নজরদারি পরিকাঠামো মোতায়েনেও বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে।
তা সত্ত্বেও অরুণাচলে ১৩ অক্টোবর দিবাং উপত্যকার অ্যান্ড্রেলা ভ্যালিতে চীনারা ভারতীয় সেনার পাঁচ মালবাহককে মারধর করে। এক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁকে সেনা কপ্টারে হাসপাতালে নিতে হয়। যদিও ঘটনার কথা প্রকাশ করেনি সেনাবাহিনী। প্রায়ই নিয়ন্ত্রণরেখা পার করা ও দু’দেশের সেনার মুখোমুখি হওয়ার ঘটনাও বেড়েছে। চীনারা শুধু সীমান্তের কাছে বেশি করে সেনা মোতায়েনই করছে না, নিয়ন্ত্রণ রেখার ও-পারে বিভিন্ন ধরনের সমর সরঞ্জামও মোতায়েন করছে। গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলিতে দীর্ঘ সময় ধরে চালাচ্ছে যুদ্ধ মহড়া। অনুশীলনের পরেও তাদের বাহিনী ওই সব এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে না।
সেনা সূত্রের খবর, লাদাখের ঘটনার পরে নতুন অনেক সরঞ্জাম কেনা হয়। সেগুলিকে সশস্ত্র করা ও উপগ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে ‘চিতা প্রকল্প’ শুরু করতেও আগ্রহী সেনাবাহিনী।বর্তমানে বালিপাড়া-চারদুয়ার-তাওয়াং সড়কের পাশাপাশি কালাকতাং থেকে শেরগাঁও, রূপা হয়ে তাওয়াং পর্যন্ত ১৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিকল্প সড়ক তৈরি হচ্ছে। ফলে সীমান্ত পর্যন্ত পণ্য ও সেনা গতিবিধি সুগম হবে। জানা গেছে, নেচিফু ও সে লা-র সুড়ঙ্গপথ আগামী বছরই চালু হয়ে যাবে। অরুণাচলের সঙ্গে রেল, বিমান ও জলপথে যোগাযোগ বাড়ানোর বিভিন্ন প্রকল্পও হাতে নেওয়া হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ডের সংখ্যা। আকাশ, স্থল— দু’দিক দিয়ে অরুণাচল প্রদেশের সেনাঘাঁটিতে এম–৭৭৭ হাউৎজার এবং চিনুক হেলিকপ্টারও মোতায়েন করা আছে।
ভারতের এসব গগনবিদারী যাত্রাপালার সংলাপের মধ্যেও চীন তার সমর ভাণ্ডার বাড়িয়ে চলেছে কারও তোয়াক্কা না করেই।
মহাকাশে চীনের শব্দের চেয়েও দ্রুতগামী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা ফের আন্তর্জাতিক অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উস্কে দিতে পারে। ইতিমধ্যেই পেন্টাগন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের কাজ শুরু করেছে। চীনের এই ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি গতিসম্পন্ন। মাইলের এককে ধরলে প্রতি সেকেন্ডে এক মাইলেরও বেশি গতিতে ছুটতে পারে এই প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র। যদিও পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম ওই ক্ষেপণাস্ত্রটি মহাকাশে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হয়নি বলে ওই রিপোর্টে জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যের প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রটি চলে যায়। তবে পরীক্ষার ফল যাই হোক, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দিক থেকে চীন আমেরিকাকে ছাপিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়েছে বলে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন। এই ধরনের অতি দ্রুতগামী ক্ষেপণাস্ত্রকে আকাশে চিহ্নিত করে ধ্বংস করার মতো প্রযুক্তি এখনও পেন্টাগনেরই নেই। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, চীনের শক্তির কাছে ভারত দুগ্ধপোষ্য শিশুর বেশি কিছু নয়। সেক্ষেত্রে পাকিস্তান ওরফে ‘সুণ্ডির দেবো পিণ্ডি চটকে’ গোছের হুঙ্কার ছাড়া হল্লারাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর গলায় গান নেই। অতএব, দেশাত্মবোধের মশাল অনির্বাণ রাখতে কাশ্মীর ও পাকিস্তানই গৈরিক দলের একমাত্র
জ্বালানি।
সে কারণেই কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সম্প্রতি উপত্যকায় সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দু ও শিখ সমাজের সদস্যদের হত্যা করে কাশ্মীরে নতুন করে অশান্তি সৃষ্টি করার কৌশল নিয়েছে পাকিস্তানের মদত পাওয়া জঙ্গিরা। যা রুখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শীর্ষ কর্তা ও গোয়েন্দা কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন শাহ। এদিকে, ভারত-পাকিস্তান টি-২০ বিশ্বকাপের ম্যাচ রয়েছে ২৪ অক্টোবর। সরকারের উপরে চাপ বাড়িয়ে সেই ম্যাচ বাতিলের দাবি তুলেছে আসাদউদ্দিন ওয়েইসির এমআইএম থেকে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি।
আরও পড়ুন : ফেরা হল না মন্নতে, মাদক মামলায় ফের জামিন খারিজ আরিয়ানের
বিরোধীদের প্রশ্ন, যে ইসলামাবাদের মদতে জঙ্গিরা কাশ্মীরে নিরীহ ভারতবাসীকে হত্যা করে চলেছে, সেই পাকিস্তানের সঙ্গে কেন ক্রিকেট ম্যাচ খেলবে ভারতীয় দল? শুধু বিরোধীরাই নয়, একই দাবি উঠেছে বিজেপির অন্দরমহলেও। অতীতে ইউপিএ আমলে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হলেই সন্ত্রাসের দোহাই দিয়ে তা বাতিলের দাবিতে সরব হতো বিজেপি নেতৃত্ব। এ যাত্রায় বিরোধীরা সেই দাবি তোলায় পাল্টা চাপে সরকার। যতটুকু জানা যাচ্ছে, আগামী ২৩-২৫ অক্টোবর তিন দিনের জন্য জম্মু-কাশ্মীর সফরে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে, দেশের মানুষকে বুঁদ করে রাখতে পাকিস্তানের আফিমই ভরসা। একটা সময় সোভিয়েতের তল্পিবাহক হয়ে আমেরিকার বিরাগভাজন হয়েছিল ভারত। তখন পাকিস্তানকে ডলার ও সমর সম্ভার দেওয়া, পাক মাটিতে জঙ্গি আঁতুড়ঘর তৈরিতে মদত, সব দিয়েছিল আমেরিকা। সোভিয়েত ও চীনের সঙ্গে মাখামাখি এখন অতীত। অপরপক্ষে এখন আমেরিকার গায়ে গা ঘষতে গিয়ে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে চীনের অপ্রিয় হয়েছে দিল্লি। ফলে চীনের হাতে প্রতিদিন পিঠে বেতের বাড়ি খেলেও, পাক বিরোধিতার রক্তচক্ষু দেখিয়ে দেশের জনতাকে হাসিমুখে পান্তাভাত জুগিয়ে চলেছে সরকার। বিরোধীরাও সকালে ঘুম থেকে উঠে সেই ভাত চটকে খেয়ে ট্যুইট-কৃষিতে নেমে পড়ছে। এটাই কি তাহলে ভারতের ভবিতব্য!