নিজের ঘরেই কি এবার চ্যালেঞ্জের মুখে নরেন্দ্র মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’? দুই শতাব্দীর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড (ও এফ বি) এর বেসরকারিকরনে উদ্যোগ নিয়েছে মোদী সরকার। আর তাতেই বাঁধ সেধেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ। গত সপ্তাহে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আনুষ্ঠানিক ভাবে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ এই ঘোষণা করতেই প্রতিবাদে মুখর হয়েছে বিরোধী দলের অনুগত শ্রমিক-কর্মী ইউনিয়নগুলি। কংগ্রেস ও বাম ইউনিয়নের সঙ্গে মোদীর এই ‘আত্মনির্ভরতা’ মডেল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে সঙ্ঘ পরিবারের শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ (বি এম এস)। তবে এটাই প্রথম নয়, ইতিমধ্যে শ্রমিক কোড ইস্যুতে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মোদীর পথে কাঁটা বিছিয়েছে সঙ্ঘ। এবার সেই প্রতিবাদের তালিকায় যুক্ত হল প্রধানমন্ত্রীর আত্মনির্ভর ভারত গঠনের অন্যতম স্বপ্ন প্রকল্প ও এফ বি-র বেসরকারিকরণ উদ্যোগ।
কেন্দ্রের শাসক দলের প্রাণ ভোমরা আরএসএস। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির ভরাডুবিতে শেষ পর্যন্ত সঙ্ঘও আস্থা হারাচ্ছে মোদীর ওপর ? এই আলোচনায় আসার আগে সংক্ষেপে ও এফ বি বিতর্ক কী, সেটা দেখে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুন: মোদীর নেতৃত্বে দেশ আজ বিপর্যস্ত!
ভারতের সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর কাজে যে গোলা-বারুদ, বন্দুক ইত্যাদি দরকার হয় তা উৎপাদিত হয় ৪১ টি কারখানায়। কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত এই কারখানাগুলিকে এক ছাতার তলায় এনে গঠিত হয়েছিল অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড। বৃটিশ যুগে গঠিত ২৪৬ বছর বয়সী এই বোর্ডের সদর দফতর কলকাতায়। বর্তমানে ও এফ বি-র আওতাভুক্ত শ্রমিক কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৮২ হাজার। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ওই ৪১ টি কারখানাকে ৭টি আলাদা কর্পোরেট রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় ভাগ করা হবে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ টেনে সংস্থাগুলির উৎপাদন দক্ষতা বাড়ানোই সরকারের প্রধান লক্ষ্য। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ৪১ টি কারখানার উৎপাদন ওএফবি-র নিয়ন্ত্রণে হয়। অর্থাৎ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে হয়। কেন্দ্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে থেকে প্রতিরক্ষা উৎপাদন দফতর ওএফবিকে কাজ করতে হয়। স্বভাবতই, দেশের নিরাপত্তার ব্যাপারে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই উৎপাদনের গোটা প্রক্রিয়ার দায়িত্ব ওএফবির ওপরে ন্যস্ত ছিল এতকাল।
প্রতিরক্ষার এই প্রাচীন সংস্থাটির জন্য কর্পোরেট দুনিয়ার দরজা খুলে দিতে চলেছেন মোদী। তাঁদের যুক্তি, এতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অটুট রেখে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি সম্ভব হবে। ফলে, নতুন পুঁজি লগ্নির সুবাদে উৎপাদনের দক্ষতা বাড়বে। ফলে রফতানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিশ্চিত। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ‘কর্পোরেটাইজেশন’ কে ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। বিরোধীদের দাবি, বিদেশি পুঁজি টানার নামে ঘুরপথে বেসরকারিকরনের রাস্তা তৈরি করতে উদ্যত মোদী সরকার। বছর দুয়েক এই একই পরিকল্পনা করেছিলো এনডিএ সরকার। কিন্তু কারখানার শ্রমিক ও বোর্ড কর্মচারীরা প্রতিবাদে সরব হন। কলকাতায় ওএফবি-র সদর দফতরে লাগাতার বিক্ষোভ চলে। সংসদেও বিরোধীরা সরব হন। তার জেরে সাময়িক পিছু হটলেও কোভিড পর্বের লকডাউনের সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত পাশ করিয়েছে। এমনই দাবি বিরোধীদের। বামেদের অল ইন্ডিয়া ডিফেন্স এমপ্লিজ ফেডারেশন (এ এই ডি ই এফ), কংগ্রেস এর আইএনটিইউসি প্রভাবিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ওয়ার্কার্স ফেডারেশন এর প্রতিবাদ করছে,সেটা প্রত্যাশিত। তারা রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলায় বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিয়েছে,সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আরএসএসের শ্রমিক সংগঠন (বিজেপির নয়) ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ অনুমোদিত ভারতীয় প্রতিরক্ষা মজদুর সঙ্ঘ মোদী সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘দানবীয়’ দাবি করে বিবৃতি দেওয়া ততটা স্বভাবিক নয়। বিএমএসের সাধারণ সম্পাদক মুকেশ সিং রীতিমত হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেন, কর্পোরেটকরনের নামে ধাপে ধাপে বেসরকারিকরণ করতে চাইছে সরকার। বাম ও কংগ্রেসপন্থী দুই সংগঠনের সঙ্গে যৌথ বিবৃতি দিয়ে সঙ্ঘ অনুগত বিএমপিএস বস্তুত মোদী বিরোধী সুরে সুরে মিলিয়েছে। সেই যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দেশের সুরক্ষা,সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিরক্ষা প্রস্তুতিতে গুরুতর প্রভাব ফেলবে কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ। অবিলম্বে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে কংগ্রেস,বামেদের সঙ্গে মোদীর বিরুদ্ধে গলা মিলিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। যা কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তার পক্ষে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং প্রতিশ্রুতি দিয়েও প্রলেপ দিতে পারেনি।
তবে এটাই প্রথম নয়। এর আগে কোভিড চিকিৎসার জন্য আপ বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে আরোগ্য সেতু অ্যাপ চালু করার বিরুদ্ধে মোদীকে চিঠি দিয়ে করা সমালোচনা করেছিল সঙ্ঘ পরিবারের আরেক সদস্য, স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ। সম্প্রতি,কেন্দ্রের শ্রম কোডের বিষয়েও তাদের আপত্তি জানিয়ে প্রতিবাদ করেছে বিএমএস। সেখানেও বাম ও কংগ্রেস ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে প্রস্তাবিত শ্রম কোড রূপায়ণ প্রত্যাহারের দাবি তুলেছে বিএমএস। সঙ্ঘের এই ভূমিকা নরেন্দ্র মোদীর বিড়ম্বনা বাড়াচ্ছে। দেশের সার্বভৌমত্য খর্ব করার আয়োজন করছেন প্রধানমন্ত্রী। কথায় কথায় দেশপ্রেমের ধজা ওড়ানো মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধীদের তোলা এহেন অভিযোগে সীলমোহর দিচ্ছে আরএসএস। গন্ধটা বেশ সন্দেহজনক !
এটা কি স্রেফ সতর্কীকরণ ? নাকি মোদীর ‘জনবিরোধী’ পদক্ষেপ সম্পর্কে তৈরি হয় ক্ষোভ সামাল দিতে সেফটি ভালভের কাজ সারছে আরএসএস? উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ীর পর লালকৃষ্ণ আদবানিকে সামনে রেখে লোকসভা ভোট লড়েছিলো বিজেপি। ততদিনে নানা কারণে আদবানি আরএসএসের চক্ষুশূল। তাই লোকসভা ভোটে আদবানির পাশ থেকে সরে গিয়ে কংগ্রেসের সরকার গঠনের রাস্তা মসৃণ করে দিয়েছিল আরএসএস। মোদী ও তাঁর শাগরেদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জুটির করোনা মোকাবিলা সহ নানা কারণে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। এই জনবিক্ষোভ যাতে হিন্দুত্ব রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে সেদিকে নজর দেওয়ার লক্ষেই বাম কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এই অনুমান সত্য হলে, ২০২৪ মোদীর জন্য দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করছে নির্ঘাত। ‘ইন্ডিয়া সাইনিং’ বিজ্ঞাপন দিয়েও প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসা হয়নি আদবানির, নাগপুর তথা আরএসএস মুখ ফেরানোয়। এবারেও কি তেমনই পুনরাবৃত্তি অপেক্ষা করছে মোদী-শাহের জন্য?