‘এই ফাটকাবাজীর দেশে
স্বপ্নের পাখিগুলো’ …
বেঁচে আছে। ভীষণ রকমভাবে বেঁচে আছে। অতিমারী, জীবনের নিও নরমাল রকমসকম আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। শিখিয়েছে বোধহয় তার থেকেও বেশি। এই আছি, এই নেই ভাঙাচোরা জীবনে স্বপ্নগুলো খুব যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখতে শেখাচ্ছে ভয়ংকর ভাইরাসটা।
ট্রেনে ওঠার সরকারি অনুমতি পাওয়ার পর রোজই দেখছি বিরাট সংখ্যক মহিলা বিক্রেতা কামরায় উঠছেন। টিপ-দুল-হার-ক্লিপ মনোহারী জিনিসের পাশাপাশি পসরায় রেখেছেন স্যানিটাইজ়ার, মাস্ক। রোজ সকালে ঘরের ঠাকুরকে পুজো দিয়ে হাতে গোটা কতক গুঁজিয়া না হলে নকুলদানা নিয়ে স্টেশনে আসেন ওরা! মাস্ক সরিয়ে দিনের শুরুতেই ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেলেন প্রসাদটুকু। দু’চারটে গালগপ্প করতে করতেই ট্রেন আসে, ফাঁকা ট্রেন। ক্রেতা নেই বললেই চলে। তবু পসরা নিয়ে ট্রেনে ওঠেন ওরা, সঙ্গী একবুক আশা। একটা কামরাতেই দু’জন, চার জন, এমনকি ছ’জনও একসঙ্গে বিক্রিবাটরা করেন। কারুরই বিক্রি তেমন কিছু হয় না। তবে রেষারেষি নেই ওদের মধ্যে। সবাই বন্ধু! যেন ধরেই নিয়েছেন, নিজের স্বপ্ন বাঁচানো নিজের দায়িত্ব। ভাগ্যে থাকলে স্বপ্ন টিকে থাকবেই। বড় অদ্ভুত লাগে ওদের দেখে! অনর্গল গালগল্প, ঠাট্টা ইয়ার্কি করে যান। ওরা যেন জীবনটাকে পরে থাকতে দেন পাশে, মাঝেসাঝে উঁকি দিয়ে দেখে নেন আদৌ সে আছে তো? নাকি পগাড় পাড়? আছে দেখেই নিশ্চিন্তে আবার মেতে ওঠেন স্বপ্ন সাজাতে! ব্যস্ত হয়ে পড়েন বেঁচে থাকতে। কারুর মুখে রাধা-কৃষ্ণপ্রেমের কলি তো কেউ উদাত্ত গলায় গান কালী কীর্তন। কেউ বা টিপের পাতার ব্যাগ থেকে পাতিলেবু বের করে বিক্রির চেষ্টা করেন। মনে করিয়ে দেন, ‘মোদি-মমতার’ করোনা ঠেকাতে লেবু খাওয়ার দাওয়াই। লেবু, কাঁঠালি কলার ঝুড়ির পাশে ট্রেনের চাকার তালেতালে দোলে ওদের স্বপ্নগুলো।ওরা ছাড়া কেউই বোধহয় সন্ধান জানেন না সে স্বপ্নের!
কার্যত তালাবন্দি জনজীবনে রাস্তায় বাস নেই। সিংহভাগ মানুষের পকেটে ওলা, উবেরে চড়ার রেস্তো নেই। তাতে কী! হাওড়া ব্রিজ দিয়ে হেঁটেই যাচ্ছেন কাতারে কাতারে মানুষ। হাঁটতে হাঁটতেই পৌঁছে যাচ্ছেন কেউ ধর্মতলা, কেউ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। শুধুই কি পেটের দায়ে? নাকি বেঁচে থাকার স্বপ্নটাকে লালন করছেন ওরা? হাঁটতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠলে ব্রিজে থমকে দাঁড়াচ্ছেন প্রৌঢ় পথচারী। পকেট হাতড়ে বের করে আনছেন সস্তার মোবাইল। শেষ বিকেলের গঙ্গার সৌন্দর্য মোবাইলবন্দি করছেন অনাবিল আনন্দে!
ঠিক তখনই হয়তো সঙ্গীর হাতে হাত রেখে রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছেন কোন তরুণী। ফিরছেন ঘরের পথে! এতোটা পথ হাঁটার পরিশ্রম কিচ্ছুটি গায়ে লাগছে না ওদের । মুখে অকৃত্রিম হাসি! এমন হাসি তো স্বপ্নেরই হয়! মুঠো ঘামছে, ভরসা বাড়ছে ওদের।
একসঙ্গে বাড়ি ফেরার টানে বান্ধবীর অফিসের তলায় চা- সিগারেটে নিজেকে ব্যস্ত রাখছেন মধ্য তিরিশের যুবা। অপেক্ষা করছেন স্বপ্নের মুহূর্তের। সারা দিনের ক্লান্তির পরও মুখে কী ভীষণ প্রশান্তি, কারুর ভরসা হতে পারলে বুঝি এমনটাই হয়!
ব্রিজের ওপরই বাজার নিয়ে বসেছেন বয়স্ক বিক্রেতা। ফিরতি পথে বাড়ির বাজার করতে থমকাচ্ছেন কোন এক বৃদ্ধা। রুমালের খুঁট খুলে গুনে গুনে খুচরো বের করে ভেন্ডি- পটলের দাম মেটাচ্ছেন। এও তো বাঁচারই স্বপ্ন!
ভরা শরীরে এক প্যাকেট লেবু নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে বছর কুড়ির সন্তানসম্ভবা তরুণী। বিক্রি হচ্ছে না বলে হতাশা নেই চোখেমুখে। অপেক্ষা করছে ও! বেঁচে ওঠার অপেক্ষা, সুদিনে ফেরার অপেক্ষা ।
ফিরতি পথে ট্রেনের ফাঁকা কামরার জানলার বাইরে সুস্থতার খোঁজে চোখ রাখছেন বৃদ্ধা। ‘মরেই বোধহয় যাবো এবার’ বলার পরই ট্রেনের পরিবর্তিত সময়সূচি নিয়ে কৌতূহল দেখিয়ে ফেলছেন। বলছেন ‘কাল তো আবার বেরোতে হবে’! আশা দেখছেন আগামীর, দেখাচ্ছেনও!
চারদিকে এত হতাশা, এত অন্ধকারের মধ্যে এগুলোই টুকরো টুকরো আলো। বেঁচে থাকার গন্ধ, জীবনের উত্তাপ। এরাই রোজ শেখাচ্ছেন, আমাদের আলো- দিনের প্রতীক্ষা শেষ হওয়ার নয়, ভাল- দিন আসবেই আসবে।