বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির পর সিপিএম রীতিমতো খাবি খাচ্ছে। কী করবেন, না করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না সিপিএম নেতারা। ৩৪ বছর রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা একটি বাম দলের এ হেন জলে পড়া অবস্থা দেখে অনেকে মজা পাচ্ছেন, অনেকে হা হুতাশ করছেন। নেতৃত্ব ভেবে পাচ্ছেন না, কোন পথে তাঁরা চলবেন। ৬ থেকে ৮ অগস্ট পর্যন্ত দিল্লিতে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক বসবে। ওই বৈঠকে রাজ্য বিধানসভার ভোটে ভরাডুবি নিয়ে কাঁটাছেঁড়া হতে পারে। দলের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। প্রশ্ন হল, আলোচনা করেই বা হবে টা কী? ২০১১সালে পালা বদলের পর থেকে ১০ বছর কেটে গেল। এখন পর্যন্ত সিপিএমের ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। যতবারই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ততবারই মুখ থুবড়ে পড়ছে দলটা। ভাগ্য ভাল, জ্যোতি বসু, অনিল বিশ্বাস, সরোজ মুখোপাধ্যায়, প্রমোদ দাশগুপ্তেরা বেঁচে নেই। অবশ্য তাঁরা বেঁচে থাকলে দলটার এই দুর্দিনের সম্মুখীন হতে হত কি না, কে জানে। তবে মানুষ তো চিরকাল বাঁচেন না। একদিন না একদিন মরতেই হবে।
এবারকার ভোটে বিপর্যয়ের পর সিপিএমের দিশাহীনতা আরও প্রকট হয়ে পড়েছে। নেতারা যে যা পারছেন, বলছেন। যে যাঁর মতো পথে চলছেন। ভোটের আগে থেকেই দলের লাইন নিয়ে সিপিএমে বিস্তর বিতর্ক ছিল। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করা কিংবা আইএসএফ-এর হাত ধরার প্রশ্নে দলের ভিতরে ও বাইরে নানা জল্পনা ছিল। ভোটে বিপর্যয়ের পর সমালোচকরা খোলাখুলি দলের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় দলের সমর্থকরা নেতৃত্বকে রীতিমতো ধুইয়ে দেন। কে বড় শত্রু, তৃণমূল না বিজেপি, তা নিয়েও নেতৃত্বের মধ্যে ধন্দ ছিল। বিজেপি আর তৃণমূলকে একই পংক্তিতে বসানো নিয়েও প্রশ্ন ছিল। শেষে ভোটের ফল প্রকাশের পর সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র ফেসবুক লাইভে বসে স্বীকার করে নিলেন, তাঁদের বিজেমূল তত্ত্ব মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। এখানেই শেষ নয়। রাজ্য সম্পাদক আরও বললেন, বিজেপির সঙ্গে কাউকে এক আসনে বসানো যায় না। এমনকি তৃণমূলকেও নয়। পাশাপাশি সিপিএম নেতার স্বীকারোক্তি, মমতা সরকার যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, সেগুলিকে আমরা ছোট করে দেখে ভুল করেছি।
যে সিপিএম ভোটের আগে পর্যন্ত তৃণমূলের মুণ্ডপাত করে এসেছে, সেই সিপিএম নেতাদের মুখে একি কথা শোনা গেল! তার কয়েকদিন পরেই বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু মেদিনীপুরে বললেন, বিজেপিকে ঠেকাতে জাতীয় স্তরে যে কোনও দলের সঙ্গে জোট করা যায়।
তার পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা শোনা গেল আদ্যন্ত মমতা বিরোধী বলে পরিচিত প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেবের গলায়। তিনি বললেন, নিউটাউনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নিউটাউনের কোনও ক্ষতি করেননি। নিউটাউনের দায়িত্ব তিনি নেতা-মন্ত্রীর হাতে না রেখে আমলাদের হাতে দিয়েছেন। এই গৌতম দেবই মমতার কট্টর সমালোচক ছিলেন বরাবর।
রাজ্যে পালা বদলের আগে থেকেই রাজ্যবাসী গৌতম দেব এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বৈরথ দেখে এসেছে। রাজারহাট নিউটাউন ছিল বাম জমানায় গৌতম দেবের স্বপ্ন। নতুন নগরী বানাতে গিয়ে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে গৌতম দেবকে। জোর করে জমি নিয়ে নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ ওঠে সেই সময়। মামলা মোকদ্দমা হয়। তখন বিরোধিতা করেছিলেন মমতা। অনেক আন্দোলন করেন তিনি। ক্ষমতায় এলে গৌতম দেবকে গ্রেফতারেরও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। নির্বাচনী সভায় তৃণমূল নেত্রী ফাইল সাজিয়ে রেখে ভাষণ দিতেন, এই সব ফাইলে গৌতম দেবের দুর্নীতির প্রমাণ আছে। আমরা ক্ষমতায় এলে সব তদন্ত করব। গৌতম দেবকে জেলে পাঠাব। গৌতম দেবও পাল্টা হুমকি দিতেন। পালা বদলের পর দেখা গেল, সেই রাজারহাট নিউটাউনকেই নতুন করে সাজাচ্ছেন মমতা। আজ যে আধুনিক শিল্প তালুক বা উপনগরীর চেহারা পাল্টাচ্ছে, তার ভিত কিন্তু বাম জমানায় গৌতমবাবুর উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল। কোথায় তৃণমূল সরকার গৌতম দেবকে জেলে পাঠাল? আজ নিউটাউন নিয়ে মমতার প্রশংসা শোনা যাচ্ছে গৌতম দেবের মুখে।
যাক সে কথা। সম্প্রতি তৃণমূলের দৈনিক মুখপত্র ‘জাগো বাংলা’য় সিপিএমের প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের কন্যা অধ্যাপক অজন্তা বিশ্বাসের একটি ধারাবাহিক নিবন্ধ প্রকাশ নিয়ে সিপিএমের ঘরে বাইরে আলোড়ন শুরু হয়েছে। চার কিস্তিতে ‘বঙ্গ রাজনীতিতে নারীশক্তি’ শিরোনামে ওই নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। শেষ কিস্তিতে অনিল-কন্যার কলমে মমতার প্রশংসা করা হয়েছে। তার হেডিং হয়েছে, ‘ইতিহাস সৃষ্টি করলেন মমতা’। ওই কিস্তিতে সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের পিছনে মমতার প্রতিবাদী ভূমিকাকে বড় করে দেখানো হয়েছে, যা সিপিএমের রাজনৈতিক লাইনের বিরোধী। কেন প্রয়াত অনিলবাবুর কন্যা তৃণমূলের মুখপত্রে এরকম নিবন্ধ লিখতে গেলেন, তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা চর্চা শুরু হয়েছে। অজন্তাকে ট্রোল করা হচ্ছে। সিপিএমের গবেষক ও অধ্যাপক শাখা তাঁকে শো কজ করতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রও বলেছেন, অজন্তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হবে। সিপিএম নেতৃত্ব এই নিয়ে মহা ফাঁপরে পড়েছেন।
একজন বামপন্থী অধ্যাপক যদি জাগো বাংলা পত্রিকায় কিছু লেখেন, তা হলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়, কে জানে। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ওঠা বা ব্যবস্থা নেওয়া তো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। যা নিয়ে সিপিএম বরাবর আন্দোলন করে এসেছে। এটা নিয়ে এত গেল গেল রব তোলার কী আছে, বোঝা যাচ্ছে না।
সিপিএম নেতৃত্ব যুক্তি দিতে পারেন, তাঁদের দলের কিছু নিয়ম আছে, গঠনতান্ত্রিক বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। দলের একটা বাঁধুনি আছে। যে যা খুশি করতে পারে না।
কথা হচ্ছিল এক সিপিএম নেতার সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন, লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না। সকাল থেকে ফোনের পর ফোন। সবাই বলছেন, অজন্তা এটা কী করলেন। আমি বললাম, আর লজ্জার কী আছে। দলটাই তো প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাই যে যা খুশি করছেন, বলছেন, লিখছেন। যত শাস্তির কথা বলবেন আপনারা, তত এসব বাড়বে। বরং উপেক্ষা করাই ভাল। ওই সিপিএম নেতা একটু রুষ্টই হলেন আমার উপর। বললেন, আপনাদের নিয়ে এই হয়েছে মুশকিল।
আসলে গত প্রায় এগারো, বারো বছর ধরে একের পর এক ভোটে বিপর্যয় চলছে সিপিএমের। সেই যে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট থেকে তাদের রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে, তা আর বন্ধ হচ্ছে না। বরং বেড়েই চলেছে। বিধানসভা ভোটে সিপিএম তথা বামেরা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম বিধানসভায় বামেদের কপালে একটি আসনও জোটেনি। সব মিলিয়ে দিশাহারা সিপিএম নেতারা। যে যাঁর মতো চলছেন, বলছেন। কারও উপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। কে কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন? এরকম দুর্দিনও এল সিপিএমের? কেউ কখনও ভাবতে পেরেছিল, এই হাল হবে সিপিএমের?
দলের একটা বড় অংশের অভিমত, ২০০৯ সালে প্রকাশ কারাতের জেদের বশে পরমাণু চুক্তির ইস্যুতে কংগ্রেস সরকারের উপর থেকে বামেদের সমর্থন তুলে নেওয়াটাই কাল হয়েছিল সিপিএমের। জ্যোতি বসু তখন অসুস্থ। প্রকাশ কারাত প্রবীণ নেতাকে দেখতে এসেছিলেন ইন্দিরা ভবনে। জ্যোতিবাবু বারবার প্রকাশ কারাতকে বলেছিলেন, আর যাই কর, সরকারের উপর থেকে সমর্থনটা প্রত্যাহার করে নিও না। সেদিন জ্যোতিবাবুর কথা মেনে সমর্থন তোলার কথা ঘোষণা না করত সিপিএম, তা হলে এই বিপর্যয় দেখতে হত না তাদের। সেই যে দুর্দিন শুরু হল, আর এখন পর্যন্ত সুদিন ফিরল না সিপিএমের। অদূর ভবিষ্যতে সুদিন ফেরার আশা অতি বড় সিপিএম সমর্থকও এখন আর আশা করেন না।