দলে নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখলেও সোনিয়া গান্ধী কি বিজেপি বিরোধী বিকল্প মঞ্চ গঠনে সদর্থক ভূমিকা নিতে পারবেন ? পারবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে এগিয়ে দিয়ে মোদি-শাহকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে?
পারবেন কি পারবেন না,তার জবাব ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু মায়ের আড়ালে বসে শেষ পর্যন্ত রাহুল গান্ধী যদি মাতব্বরি করে চলেন, তাহলে বিকল্প মঞ্চ এর মূল লক্ষ্য অধরা থেকে যাবে সেটা হলফ করেই বলা যায়।
শনিবার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের পরে এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে । গত সাত বছর ধরে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক স্তরে কংগ্রেসের অবক্ষয় অব্যাহত। পাশাপাশি তৃণমূলসহ দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ রাখতেও ব্যর্থ হয়েছে কংগ্রেস। কেন্দ্রে বিকল্প জোটের রাশ তাঁদের হাতে থাকবে কিনা, এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে সোনিয়ার বকলমে রাহুল যে ভূমিকা নিয়ে চলেছেন,তাতে আর যাই হোক বিজেপিকে চিন্তায় ফেলা শুধু কঠিন নয় অসম্ভবও বটে।
সর্বভারতীয় দল হিসেবে কংগ্রেস নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহর পরাক্রমের কাছে পর্যুদস্ত। উপর্যুপরি লোকসভা ভোটে হেরেছে। শুধু তাই নয় , একের পর এক রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। আবার ভোটে জিতেও সরকার ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন রাহুল বাহিনী। এক অর্থে দিশাহারা কংগ্রেস। বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেস যে তার ভূমিকা পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ তা আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
এই যখন শতাব্দী প্রাচীন দলের হাল, তখন গোটা দেশের সামনে মোদি-শাহের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে চলেছে কিছু আঞ্চলিক দল। তাদের মধ্যে মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল অগ্রগণ্য। গত মে মাসে হয়ে যাওয়া বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় বিজেপিকে যে রাম ধাক্কা দিয়েছে তৃণমূল ,যা ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসা ইস্তক কল্পনা করতে পারেনি গেরুয়া শিবির। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বস্তুত রাজধর্ম শিকেয় তুলে বাংলায় পড়ে ছিলেন। যার নজিরও ভূভারতে নেই। কেন্দ্রীয় সরকার তথা রাষ্ট্র পরিচালনার সুবাদে নানা ফন্দি ফিকির করেও তৃণমূল নেত্রীকে দমাতে পারেননি মোদি-শাহ জুটি।
মমতার এই নির্বাচনী সাফল্য দেশের প্রায় সব বিজেপি বিরোধী শক্তিকে বল জুগিয়েছে। জাতীয় স্তরে মমতার গ্রহণযোগ্যতার রেখাচিত্র নির্বাচন উত্তর পর্বে ক্রমশ উর্ধমুখী। মমতার এই উত্থানে কংগ্রেসের একাংশ অশনি সংকেত দেখেছেন। সেক্ষেত্রে সোনিয়াকে সামনে রেখে রাহুলবাহিনীর কপালে ভাজ পরে গিয়েছে। খুঁচিয়ে তোলা হচ্ছে নেতৃত্বের প্রশ্ন। যা আদতে যতটা না বিকল্পের তাগিদ তার চাইতেও রাহুলের ভবিষ্যত সন্ধান।
রাহুলের অবস্থা এখন অনেকটা ‘গাঁয়ে মানে না না আপনি মোড়ল’। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির সাফল্যের প্রধান কারণ এই সর্ব ভারতীয় দলের অবিমৃষ্যকারী ভূমিকা। যার নেপথ্য কারিগর সোনিয়া পুত্র। একটা উদাহরণ দিলে,বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। বাংলায় বর্তমানে কংগ্রেসের অস্তিত্ব প্রায় নেই। কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী অবস্থান নিলেও বাংলায় কংগ্রেস আদাজল খেয়ে তৃণমূলের বিরোধীতা করে চলেছে। অবস্থা এমনই যে নিজের জাত খুইয়ে বামেদের সঙ্গে হাত মেলাতেও দ্বিধা করেনি। অবশ্য বাংলায় তৃণমূল আর বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতিতে বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসও ডুবেছে। ভোট না পেলেও নির্বাচনী প্রচারে তাদের কট্টর তৃণমূল বিরোধিতা পরোক্ষে বিজেপির পালে হওয়া জুগিয়েছে।
এত জানা কথা। এর সঙ্গে রাহুলের সম্পর্ক কী ,এমন জিজ্ঞাসা জাগতেই পারে। তার জবাবে বলা যায়,বাংলায় তৃণমূল বিরোধী নেতারা সবাই রাহুল অনুগত। খোলসা করে বলা যাক। ২০১১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে রাজ্যে প্রায় সাড়ে তিন দশকের বাম জমানার অবসান ঘটিয়েছিলেন মমতা। কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারে অবশ্য ২০০৯ সালেই যোগ দিয়েছিল তৃণমূল। কংগ্রেস ও তৃণমূলের সেই সখ্যের ইতি ঘটেছিল কেন্দ্রের একটি অর্থনৈতিক তথা প্রশাসনিক পদক্ষেপের কারনে। কিন্তু সেই থেকেই কংগ্রেস দল বাংলায় ভাঙতে শুরু করে। কংগ্রেসের বিধায়কদের তৃণমূলে যোগ দেওয়ার হিড়িক পরে যায়। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফায় তৃণমূল ক্ষমতায় এলে কংগ্রেস পরিষদীয় দলে ভাঙন আরও তীব্র আকার নেয়। একদিকে বামেদের সঙ্গে গাঁটছড়া অন্যদিকে তৃণমূল বিরোধিতার সুর চড়াতে গিয়ে বাংলার বিরোধী পরিসর ক্রমশ হিন্দুত্ববাদীদের গ্রাসে চলে যায়। প্রদেশ কংগ্রেসের ওই রাজনৈতিক দোদুল্যমান অবস্থায় দলের বিধায়করা নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখতে পারেননি। কংগ্রেস নেতারা দল ধরে রাখার ব্যর্থতার দায় নিয়ে কোনো আত্মসমীক্ষায় আগ্রহ দেখায়নি। উল্টে তৃণমূল বিরোধিতায় সিপিএমসহ বামেদের নিয়ে মেতে থাকতেন। এই পর্বে, কংগ্রেস হাইকমান্ডকে পাশে পেতে রাজ্য নেতারা বরাবর রাহুলকে তোয়াজ করে চলতেন। প্রদেশের যেসব নেতা তৃণমূলকে ঠেকাতে এবং বামেদের সঙ্গে জোট করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁরা সোনিয়ার সঙ্গে খুব সহজ হতে পারতেন না। কেননা, মমতা-সোনিয়ার সম্পর্কের রসায়ন যা,তাতে বাংলায় বিজেপিকে গৌণ করে তৃণমূলকে আক্রমণে বিদ্ধ করা কঠিন ছিল। তাই নানা ছলে বাংলার গুটিকয় নেতা মাঝে মধ্যেই দিল্লি গিয়ে রাহুলের দরবারে হত্যে দিতেন। রাহুলের মদতেই বামেদের হাত ধরার মতো যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রদেশ কংগ্রেস। তার ফল যে কী হয়েছে,তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
রাহুল গান্ধীর এই রাজনৈতিক অপরিপক্কতা আজ জাতীয় স্তরেও প্রকট। তাই অর্থনীতি থেকে বিভিন্ন সামাজিক কারনে যখন নরেন্দ্র মোদি জেরবার । রাজ্যে রাজ্যে পদ্ম শিবিরে ভাটার টান। শাসকের সেই দুর্বল অবস্থাকে কাজে লাগানোই বিরোধীদের লক্ষ্য। সম্প্রতি, মমতা দলের মুখপাত্র জাগো বাংলার উৎসব সংখ্যায় তাঁর লেখা (দিল্লির ডাক)নিবন্ধে বিকল্প জোট সম্পর্কে ধোঁয়াশা কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন,’ বিকল্প মঞ্চ শক্তিশালী করতে হবে। নিজেদের অঙ্কে নয়, দেশের স্বার্থে একজোট হতে হবে। বিকল্প মঞ্চ হবে নীতির ভিত্তিতে,কর্মসূচির ভিত্তিতে।আমরা কখনোই কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে মঞ্চের কথা ভাবছি না। বলছিও না। ‘
‘নিজেদের অঙ্কে নয়’ জোটের পূর্বশর্ত জানিয়ে দিয়েছেন মমতা। কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে জোটের কথা না বললেও নেতৃত্বর চাইতে রাজনৈতিক কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। রাহুলবাহিনী কী তার গূঢ় অর্থ উপলব্ধি করতে পারছেন ? সোনিয়া তনয়ের এযাবৎকালের কর্মকান্ডে তার লক্ষণ দেখা যায়নি। তাই বিজেপির বিকল্প মঞ্চ বা মোর্চা গঠনের কাজে রাহুলের ছায়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখাটাই সোনিয়ার কাছে কঠিন পরীক্ষা।