দিন তিনেক আগের ঘটনা। অযোধ্যায় সরযূ নদীতে স্নান করতে নেমেছেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে এক তরুণ দম্পতিও ছিলেন। সম্ভবত নববিবাহিত ওই তরুণ তরুণী। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের আবেগ একটু বেশি থাকতেই পারে। তরুণটির অপরাধ, তিনি তাঁর স্ত্রীর ঠোঁটে আলতো করে একটু চুমু খেয়েছেন। ব্যাস, আর যায় কোথায়? ওই দম্পতিকে ঘিরে যাঁরা সরযূর পবিত্র জলে অবগাহন করে পুণ্য অর্জনে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁরা সব গেল, সব গেল রব তুলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওই তরুণের উপর। চলল চড়, চাপাটি। এত বড় সাহস? সরযূ নদীতে বউয়ের সঙ্গে যৌন আচার? মার, মার।
তাঁকে মারতে মারতে জল থেকে টেনে তোলা হল। অসহায় স্ত্রী নীরব দর্শক। তাঁর সামনেই স্বামীকে মারধর চলল। পাড়ে উঠেও নিস্তার নেই। সেই ছবিও সমাজ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
সম্ভবত তরুণকে মারধরের মাথারা হিন্দুত্ববাদী ছিলেন। তাই ওই দম্পতির জলকেলি তাঁদের পছন্দ হয়নি। তাতে হিন্দুত্ব লাঞ্ছিত হয়েছে বলে তাঁদের মনে হয়েছে। তাই তাঁরা মনের সুখে তরুণটিকে মেরে হিন্দুত্বের আস্ফালন দেখিয়েছেন।
না, এটা আজকের ভারতে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশের প্রায় প্রতিটি কোণে কখনও না কখনও এই হিন্দুত্বের আস্ফালন প্রায় রোজই ঘটে চলেছে। কয়েকদিন আগেই আর একটি ছবি এবং খবর ভাইরাল হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। এক শহরের প্রাক্তন বিজেপি কাউন্সিলরের স্বামী কট্টর হিন্দুত্ববাদী। রাস্তার ধারে এক মানসিক ভারসাম্যহীন প্রৌঢ়কে বসে থাকতে দেখে তার হিন্দুয়ানা জেগে উঠল। সে ওই প্রৌঢ়ের কাছে বারবার নাম জানতে চাইছিল। দাবি, তাঁকে স্বীকার করতেই হবে , তিনি মুসলমান। বারবার তাঁর কাছে আধার কার্ড দেখতে চাওয়া হচ্ছিল। আর প্রতি কথার মাঝেই চলছিল চড় থাপ্পড়, হাত মোচড়ানো। পরের দিন ওই প্রৌঢ়ের মৃতদেহ উদ্ধার হয় আগের দিনের ঘটনাস্থলের কাছেই। পরে জানা যায়, তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। ভালোভাবে কথা গুছিয়ে বলতে পারতেন না।
আরও পড়ুন:চতুর্থ স্তম্ভ: অগ্নিপথ আর অগ্নিবীরদের নিয়ে আরও কিছু কথা
না, এটাও কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় আজকের ভারতে। এই রকম নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা রোজ দেশের কোথাও না কোথাও ঘটে চলেছে। সম্প্রতি বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্য ঘিরে দেশে বিদেশে তোলপাড় চলল। মানুষ রাস্তায় নামল প্রতিবাদে। ঘটল অনেক হিংসাত্মক ঘটনা। তার পরেই উত্তরপ্রদেশে চলল বুলডোজার অভিযান। যে সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন আন্দোলন করছিলেন, বেছে বেছে তাঁদের অনেকের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। বিজেপির অনেক নেতা বুক বাজিয়ে ঘোষণা করলেন, এরকমই চলবে।
হ্যাঁ, আজকের ভারতে এরকমটাই চলছে। রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করা যাবে না। বিজেপির বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না, হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে মুখ খোলা যাবে না, মানবাধিকার নিয়ে কথা বলা যাবে না। বললেই নেমে আসবে রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচার। বলতে হবে, সব ঠিক হ্যায়, আল ইজ ওয়েল।
এ এক অদ্ভুত অবস্থা।
আজ ২৫ জুন। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ঠিক এই দিনেই ভারতে নেমে এসেছিল নিকষ কালো অন্ধকার। মাঝরাতে ঘোষণা হয়েছিল দেশ। জুড়ে জরুরি ঘোষণা। কেড়ে নেওয়া হয়েছিল মানুষের সমস্ত অধিকার। কথা বলা বন্ধ, শ্রমিকের আন্দোলন করা বন্ধ, ধর্মঘট বন্ধ। শুধু ইন্দিরা গান্ধীর এবং কংগ্রেসের গুনগান করতে হবে। তার পরের ইতিহাস এখন সকলের মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর তথা কংগ্রেসের কী হাল হয়েছিল, তার চর্বিত চর্বনে যাচ্ছি না। সেই ইতিহাসও সকলেই জানে।
আজকের ভারতেও সেদিনের ছায়া প্রলম্বিত। নিন্দকেরা বলেন, দেশে এখন অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। বিজেপি সরকারের, হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। বললেই জেল। উমর খলিদ, ভারভারা রাওয়ের মতো কত যে বিশিষ্ট ব্যক্তি আজও জেলের গরাদের অপর প্রান্তে, তা অনেকেই ভুলে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন:চতুর্থ স্তম্ভ: লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্র, দরকার হিন্দু বাহিনী
বস্তুত, ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যেন দেশে একটা অঘোষিত জরুরি অবস্থার মতো আবহাওয়া। হিন্দুত্ববাদীদের আস্ফালনে বিপর্যস্ত মানুষের মৌলিক অধিকার। বিরোধীরা বলে, ও এক জরুরি অবস্থাই বটে।
আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ১৯৭৫ এর অতীতকে খুব সহজেই মেলানো যাচ্ছে। শাসকের মনে রাখা দরকার, শেষ কথা কিন্তু বলে মানুষই। ইতিহাস সেই শিক্ষাই দিয়েছে গণতন্ত্রপ্রেমী ভারতবাসীকে। দেশে আজ বহু সমস্যা। তার থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য শুধু হিন্দু হিন্দু করে লাফানো কোনও কাজের কথা নয়। এটা বোধ হয় ভাবার সময় এসেছে। ১৯৭৫ এর সেই দিনগুলিতেও কিন্তু ইন্দিরা তনয় সঞ্জয় গান্ধী বুলডোজার রাজনীতির আমদানি করেছিলেন। সেই স্মৃতি এখনও ফিকে হয়ে যায়নি।