দাঙ্গাকারীর কোনও ধর্ম হয় না। না, এটা কোনো তত্ব নিষ্কাশিত আপ্তবাক্য নয়। বিজয়া দশমীর দিন ওপার বাংলায় একদল মানুষ সেটা প্রমাণ করে ছাড়লেন। ইসলাম রক্ষার নামে দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে সিলেট,কুমিল্লা,নোয়াখালীতে রুখে দাঁড়ালো সাধারণ মানুষ। ঘটনাচক্রে যাদের সিংহভাগ মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। সদর্থক ভূমিকা রয়েছে প্রশাসনেরও।
দুর্গাপুজোর শুরুতেই বাংলাদেশের সিলেট,কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে একাধিক মন্ডপে হামলা হয়। হামলার সময় বাছাই ও কৌশল লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট একটা পরিকল্পিত নকশা রয়েছে। দুর্গা মূর্তি ভাঙচুর থেকে আয়োজকদের উপর সশস্ত্র হামলার ভিডিও ক্লিপ মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। পুজো উদ্যোক্তা চার জন নিহত হয়েছেন। জোর করে সপ্তমীতেই পুকুরে দুর্গা প্রতিমা ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। উল্লেখ্য, রাজধানী ঢাকার ২৩৮ সহ গোটা দেশে ৩২ হাজার ১১৮ টি দুর্গাপুজো হয়। পারিবারিক বা প্রতিষ্ঠিত মন্দির ছাড়াও এর অধিকাংশ বারোয়ারি পুজো। সাম্প্রদায়িক উস্কানির মোকাবিলা করে গোটা বাংলাদেশে অন্যান্য বারের মতো এবারও দশমীর সিঁদুর খেলা থেকে প্রতিমা বিসর্জন পর্ব কেটেছে নির্বিঘ্নেই। হিন্দুদের উৎসব হলেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত এমন হাজার হাজার পুজোর সুষ্ঠু আয়োজন সম্ভব হতো না।
এই উৎসবের মধ্যে কুমিল্লা,সিলেট,নোয়াখালী ইত্যাদি জায়গায় একদল ধর্মের দোহাই দিয়ে সশস্ত্র হামলা চালায় হিন্দু মহল্লায়। হামলার ছবি স্মার্ট ফোনের কল্যাণে ছড়িয়ে পড়ে।
একটি ছবিতে দেখা যায় হনুমান মূর্তির কোলে কোরান শরীফ। সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ উস্কে দেওয়ার এমন ইন্ধন প্রশ্নাতীত। একদিকে কাঠ মোল্লার দল জামাতিরা একে ‘ইসলামের অপমান’ বলে হিন্দুদের বিরুদ্ধে মারমূখী। মুসলমান সমাজের ভাবাবেগ উস্কে দিতে মোক্ষম অস্ত্র তাদের হাতে। ফলে, সাম্প্রদায়িকতার বিষঢালা হিংসা ছড়ানোর পথ তাতে প্রশস্ত হয়েছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী ভারতে হিন্দু ধর্মের ঠিকাদাররা সাম্প্রদায়িক জনমত গঠনে তৎপর হয়ে উঠেছে। এদেশে সংখ্যালঘু নিধনের স্বপক্ষে জমি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা। হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় অর্ধসত্য, অতিরঞ্জন মিশেল দিয়ে শুরু হয়েছিল বিদ্বেষ চর্চা।
অবস্থা এতটাই গুরুতর যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপের বার্তা দিতে বাধ্য হয়েছেন। ইতিমধ্যে ভারত সরকারও এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ওই মন্ডপের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে যে ব্যক্তি কোরান রেখেছিল তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। হিন্দুদের উপর হামলাকারীরা ধরা পড়েছে পুলিশের জালে। তবে কুমিল্লার আম জনতা প্রশাসনের পদক্ষেপের অপেক্ষা করেনি। হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানরাও একযোগে রুখে দাঁড়িয়েছে দাঙ্গাকারী দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। স্থানীয় সংবাদ সূত্রে জানা যাচ্ছে, পুরুষদের পাশাপাশি দুই ধর্মের মহিলারাও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ধর্মীয় বিভাজন মুছে জনতার ব্যারিকেড,অনন্য নজির গড়েছে ওপার বাংলা।
আরও পড়ুন : বিসর্জন ঘিরে বোমাবাজি-ভাঙচুর দুর্গাপুরে
এটা কিন্তু নিছক কোনো ধর্মীয় সংঘর্ষের ঘটনা নয়। কেননা, হিন্দু বাঙালিরা তাদের এই উৎসবের আবহে কোনো সংঘাতের মধ্যে নিজেদের জড়াতে চাইবে না-এটাই স্বাভাবিক। সিলেট,কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ওই পুজোর আয়োজন বহু বছরের। সূত্রের খবর, হিন্দুরা যথেষ্ট ধুমধাম করেই ফি-বছর পুজোর আয়োজন করে আসছে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক ব্যক্তি যারা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান ,তাদের দাবি, হিন্দুদের উৎসবে তাঁরাও শামিল হন। মন্ডপে ঠাকুর দর্শনে যান। অর্থাৎ ধর্মীয় বিভাজন তাদের উৎসব পার্বন উদযাপনে পথের কাঁটা হয়নি এতকাল। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া প্রতি বছর হিন্দুরা সুষ্ঠুভাবে পুজোর আয়োজন করতে পারতেন না।
আপাতভাবে এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব প্রশাসনের। ইতিমধ্যে তারা যথেষ্ট কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রধান মন্ত্রী হাসিনার সুরও বেশ চড়া। বাংলাদেশের ঘটনায় এপার বাংলা মায় গোটা দেশেই একদল বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ প্রশাসন যে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পরিস্হিতি র মোকাবিলা করেছে,তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভারত সরকারের বিদেশ দফতরের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী। কিন্তু তাতে কী, বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দলের পৃষ্ঠপোষকরা ওই কুমিল্লার ঘটনাকে হাতিয়ার করে আসরে নেমে পড়েছে। এদেশে মুসলমান নিগ্রহ ও হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে কুমিল্লা এখন ভারতীয় গেরুয়া বাহিনীর তুরুপের তাস। কিন্তু সেই উস্কানির তাওয়া গরমের আগেই তাতে জল পরে গিয়েছে। এদেশের হিন্দুত্ববাদীদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে সিলেট,কুমিল্লার ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ নাগরিক। ‘ইসলাম বিপণ্ন’ আওয়াজ তুলে যারা দুর্গা প্রতিমা ধ্বংস করেছিলো, তাদের বিরুদ্ধে কুমিল্লার মুসলমান সমাজ রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ঢাকাসহ কিছু শহরে জামাতিরা বিক্ষোভ দেখিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। পুলিশ যেমন কড়া, তেমনই বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন মোল্লাদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সর্ব হয়েছে।
আরও পড়ুন : শোভাযাত্রাহীন বিদায়, কাঁধে করে প্রতিমা নিরঞ্জন দুর্গাপুরে!
দাঙ্গা হয় না করানো হয়। রাজনীতির স্বার্থে দাঙ্গা করানোর নজির ভারতে দুর্লভ নয়। এই প্রশ্নে আপাতত হাসিনা সরকারের ভূমিকা সদর্থক। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ন ধর্মীয় পরিচয় সরিয়ে রেখে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার ঐক্য। ধর্মীয় বিভাজন কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে সীমিত থাকে না। দলীয় রাজনৈতিক পরিসরের বাইরে, তার বীজ থাকে সমাজ গভীরে। তাই রাষ্ট্র পরিচালক তাকে রুখতে চাইলেও তার ক্ষমতা সীমিত। বাংলাদেশ প্রশাসনের কাছে এটা আইন শৃঙ্খলার সমস্যা। তারা সে ভাবেই দুষ্কৃতী দমনে পদক্ষেপ করছে। কিন্তু ধর্ম কারবারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক স্তরে জেগে ওঠা প্রতিরোধ স্পৃহা বিরল ঘটনা। কুমিল্লা,সিলেটের জনতা সেটাই করে দেখল। এই দৃষ্টান্ত ভারতের সংখ্যাগরিষ্ট মৌলবাদী প্রকল্পকে ধাক্কা দিতে পারে।