বুদবুদ : বর্ধমানের সোঁয়াই গ্রাম। গ্রামটিকে আর পাঁচটা গ্রামের থেকে আলাদা করেছে এখানকার বিখ্যাত মুখোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো। পুজোর শুরু আজ থেকে ৩২৭ বছর আগে। তার আগেও এই পরিবারে দুর্গাপুজো হত। তবে তা বর্ধমানের ফরিদপুরে। সে ইতিহাস এখন কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
গত ৩২৮ বছর আগে পুজোর সূচনা করেন বাসুদেব মুখার্জি। শোনা যায় এই গ্রামেই ছিল টোল। আর এই টোলেই শিক্ষা নিতে আসেন মুখার্জি বাড়ির পূর্বপুরুষ বাসুদেব মুখার্জি। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে এই গ্রামেই তাঁর বিয়ে হয়। পরে এই গ্রামেই বসবাস শুরু করেন তিনি। বাসুদেব মুখার্জির আদি বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের বাকলসার গ্রামে। সেখানে তাঁর বাড়িতে দুর্গাপুজো হতো। তিনি যখন সোঁয়াই গ্রামে বসবাস করেন তখন বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে দেবীকে নিয়ে আসেন সোঁয়াই গ্রামে। কিন্তু দেবীকে সোঁয়াই গ্রামে আনার সময় ঘটে বিপত্তি। দেবীকে যখন কাঁধে করে আনা হচ্ছিল সেই সময় তৎকালীন বর্ধমান রাজা তার সৈন্য নিয়ে ভ্রমণে বের হন। রাস্তায় মুখোমুখি হয় রাজার সৈন্য ও দেবী। একদিকে সৈন্যরা বলেন তারা রাস্তা ছাড়বে না অপর দিকে যারা দেবীকে কাঁধে করে নিয়ে আসছিলেন তারাও জেদ ধরে বসেন দেবী কে নিয়ে কোনও ভাবেই তারা রাস্তা ছাড়তে বাধ্য নয়। অগত্যা দেরি দেখে রাজা নিজেই দেরি হবার কারণ খুঁজতে এগিয়ে আসেন।
আরও পড়ুন : বুড়িমার আটচালা পুজোয় সপ্তমীতে কুমারী-আরাধনা
মুখার্জি বাড়ির দুর্গা
সব শুনে রাজা নিজেই দেবীকে প্রণাম করে নিজেই রাস্তা ছেড়ে দেন। পরে তিনি দেবীর জন্য বেশ কিছু জমিও দান করেন। তারপর থেকে সোঁয়াই গ্রামেই মহা ধুমধামে পুজো হয়ে আসছে গত ৩২৮ বছর ধরে দেবী দুর্গার। এখানে শাক্ত মতেই পুজো হয়। ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় পুজো। সপ্তমীর দিন ছাগল বলি থেকে কুমারী পুজো সব নিয়ম, প্রথা মেনে চলে আসছে আজও। সপ্তমীর দিন পাঁঠা বলি হলেও অষ্টমীর দিনে এক রঙের ছাগ বলি হয় এখানে।নবমীর দিনে মোষ বলি প্রথা চালু রয়েছে প্রথম দিন থেকেই। সাথে ভেড়া বলি। এছাড়াও আখ,চালকুমরো, ছাড়াও বিভিন্ন জিনিস বলি হয়। পুজোর দিনে ভোগ নৈবেদ্য দেওয়া হয় রোজ। পুজোর চারটে দিন বাড়িতে মহিলাদের রান্নার কাজ থাকে না। তাই তারাও এই চারটে দিন পুজোতে মেতে ওঠে আনন্দে। পুজোর চারটে দিন নর নারায়ণ সেবার আয়োজন করে থাকেন প্রতি বছরের মতো। পুজোর সবথেকে বড় আকর্ষণ হল এখানকার মোষ বলি। নবমীর দিন আশপাশের গ্রাম থেকে বহু মানুষ বলি দেখতে ভিড় জমান মন্দিরে।
আরও পড়ুন : দশভুজার আটটি হাতই ছোট, স্বমহিমায় উখরার খ্যাপা দুর্গা
শোনা যায়, আগে দুটি করে মোষ বলি হতো। একবার পুজোর সময় নবমীর আগের দিন একটি মোষ গলায় দড়ির ফাঁস লেগে মারা যায় সেই থেকে দুটির বদলে একটি করে মোষ বলি হয়। তবে পরিবার সূত্রে জানা যায় মোষ বলি বন্ধ করতে উদ্যোগী হয় ইংরেজরা। তারা সেই সময় তৎকালীন জেলা শাসককে দিয়ে বলি প্রথা বন্ধ করার চেষ্টা করলে জেলাশাসক এসে বলি প্রথা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে যান। কিন্তু হঠাৎই পুজোর সময় এসে তিনি পুনরায় বলি চালু করতে বলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন রাতে তার ঘুম হতো না। সব সময় নানান দু:স্বপ্ন দেখতেন তিনি। মনে হতো কেউ ত্রিশূল নিয়ে তাকে মারতে আসছে।
এক প্রকার অসুস্থ হয়েই পড়েছিলেন তিনি সেই সময়। মুখার্জি বাড়ির সদস্যরা বলেন পুজোর কয়েকটা দিন যে যেখানেই থাকুক সবাই এসে হাজির হয় পুজোতে।পুজোর সময় বাড়ির মহিলারা কোথাও বের হন না। ঠাকুর দেখতে গোটা পরিবার মিলে আনন্দে কাটান পুজোর চারটে দিন। পুজোকে ঘিরে পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও আশপাশের গ্রামের মানুষরাও ভিড় জমান পুজো মণ্ডপে।