বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আমরা নায়ক, নায়িকা এমনকি খল নায়ক- নায়িকাকেও যে ভাবে মনে রাখি পার্শ্ব অভিনেতাদের ঠিক তেমন করে মোটেই মনে রাখি না। তবে তারই মধ্যে কেউ কেউ থাকেন একেবারে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো। শক্তিশালী অভিনয় দিয়েই আজীবন দর্শকের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নেন এরা। বাংলা চলচ্চিত্রে তেমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র রবি ঘোষ। সূর্যের মতোই তিনি বিরাজ করছেন বাংলা কমেডি অভিনয়ের আকাশে। অবশ্য অভিনয়ের অন্যান্য নানা স্তরেও পৌঁছেছিল তাঁর আলো। আজ রবি ঘোষের ৯০ তম জন্মদিন।
কমেডি অভিনেতা হিসেবেই মূলত রবি ঘোষকে চেনেন দর্শক। বাংলা চলচ্চিত্র যতদিন থাকবে, তত দিন থাকবেন সত্যজিৎ রায় এবং তাঁর গুপী – বাঘা। রবি ঘোষই সত্যজিতের বাঘা । গুপী গায়েনের সঙ্গে তাঁর জুটি ভোলার নয়। বাঘার চরিত্র সৃজনে, রবি ঘোষ নিজেই যেন নিজের তুলনা।
তবে শুধুই হাসির অভিনয় নয়, রবি ঘোষ ছিলেন টলিপাড়ার এক বলিষ্ঠ অভিনেতা। কমেডি বাদ দিলেও একাধিক বাংলা ছবিতে খল নায়কের চরিত্রে দেখা গেছে রবি ঘোষকে। ঠগিনীর মতো ছবিতে অমন ছোট্টোখাট্টো মানুষটার বলিষ্ঠ অভিনয় ভোলার নয়, তেমনই বাঘিনীতে ভিলেন রবি ঘোষ অবাক করেছিলেন দর্শককে। হাসিয়েই বাজিমাত করেন যিনি, তিনিই কী অবলীলায় এতো নিষ্ঠুর হতে পারেন! দেখিয়ে ছিলেন রবি ঘোষ।
এমন সাবলীল অভিনয় যার তাঁকে কী আর বাংলার চৌহদ্দিতে আটকে রাখা যায়? সুদূর আরব সাগরের তীরেও পৌঁছেছিল রবি ঘোষের অভিনয় নৈপুণ্যের খবর। স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন ছিলেন রবি ঘোষের ফ্যান। বাংলার কাল্ট ছবির তালিকায় অন্যতম নাম গল্প হলেও সত্যি। সেই ছবিতে ধনঞ্জয় রূপে রবি ঘোষের অভিনয় মুগ্ধ করেছিল দর্শককে। ছবির ঘূণধরা একান্নবর্তী পরিবারটিকে ধনঞ্জয় যেভাবে জাদুবলে পাল্টে দিয়েছিল, ঠিক তেমন করেই যেন পাল্টে গিয়েছিল বাংলা কমেডির স্টাইল, রবি ঘোষে ভর করে।
গল্প হলেও সত্যি অনুপ্রেরণায় বলিউডে বাবুর্চি তৈরি করেছিলেন পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়। হিন্দি ছবিতে রবি ঘোষের জায়গায় অভিনয় করেছিলেন রাজেশ খান্না। বাঙালি দর্শকরা বলেন, বাবুর্চি রাজেশকে বলে বলে দশ গোল দেবেন গল্প হলেও সত্যি-র ধনঞ্জয়।
একবার ইডেনে ক্রিকেট খেলতে এসেছিলেন বলিউড তারকারার। ছিলেন দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন, অনিল ধাওয়ানের মতো তারকারা। সেখানে রবি ঘোষের সঙ্গে বলিউডের তাবড় অভিনেতাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চন। কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে রবি ঘোষকে ভারতের ফাইনেস্ট অভিনেতা বলে পরিচয় করিয়েছিলেন বিগ বি।
রবি ঘোষ সত্যিই ভারতের অন্যতম ফাইনেস্ট অ্যাক্টর ছিলেন। কমিক টাইমিং থেকে শুরু করে সিরিয়াস অভিনয় সবেতেই এগিয়ে ছিলেন তিনি।
অরণ্যের দিনরাত্রি-র শেখরকে বাঙালি ভুলবে না কোনও দিন। সিরিয়াস অভিনয়ের মধ্যেও টুক করে হাসির পাঞ্চ ঢুকিয়ে দেওয়া ছিল তাঁর বাঁয়ে হাত কি খেল!
বাংলা সাহিত্য এবং পর্দার আইকোনিক চরিত্র জটায়ুই হোন বা গোপাল ভাঁড়, সবেতেই রবি ঘোষের ছোঁয়া লেগেছিল। কালোতীর্ণ হয়ে উঠেছিল চরিত্রগুলি।
বাংলার চলচ্চিত্রের রবি অস্তাচলে গেছেন সেই ১৯৯৭ সালে। তবে আজও সমান শক্তিশালী তাঁর হাসিচ্ছটা! পর্দায় রবি ঘোষের উপস্থিতিতে এখনও দমকা হাসি আর চোখের কোণে চিকচিকে জলটুকুই বাঙালির সম্বল।