তাঁর ছবি দেখে একদল দর্শক বলেছিলেন, ”সত্যিকারের মাস্টারপিস”,আবার কেউ কেউ বলেছিলেন,’ ধুর,এটা কিছুই হয়নি।একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি।” মানুষটি বলেছিলেন, সিনেমার প্রেমে পড়েননি,সিনেমাটা তিনি লড়াইয়ের অস্ত্র হিসেবেই দেখছেন।এর চেয়ে ধারালো কোন অস্ত্র হাতে পেলে সিনেমাকে তিনি লাথি মেরে সেই নতুন অস্ত্র হাতে তুলে নেবেন।যিনি বলেছিলেন,ছবিতে গল্প বলার দিন শেষ,এটা নিজের বক্তব্য বলার সময়। আর কেউ নন তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম কিংবদন্তী পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক।আজ তাঁর ৯৬তম জন্মদিন।প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ তিনি তৈরি করেছিলেন ১৯৫২সালে। ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তিরও তিন বছর আগে।অথচ সেই ছবি হলে মুক্তি পেল ১৯৭৭ সালে, পরিচালকের মৃত্যুর একবছর পর।অনেক কষ্ট করে ছবি তৈরি করলেও তখন ‘নাগরিক’ প্রদর্শনের জন্য কোন ডিস্ট্রিবিউটরই পাননি তিনি। অযত্নে প্রায় নষ্টই হয়ে গিয়েছিল ছবির ফিল্ম।সেইসময় মুক্তি পেলে সত্যজিত রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ নয়,ঋত্বিকের ‘নাগরিক’-ই হত প্রথম নিও-রিয়ালিস্টিক বাংলা ছবির নিদর্শন।
পরের ছবি ‘অযান্ত্রিক’-এ একটি নির্বাক গাড়ি এবং তাঁর ড্রাইভার বিমলের ভালোবাসার নিপাট সহজ গল্পকে প্রায় সন্দর্ভের পর্যায়ে নিয়ে গেলেন ঋত্বিক।গাড়িটিকে গোটা ছবি জুড়ে প্রায় একটি চরিত্রের মতোই ব্যবহার করলেন মহামতি ঘটক।ছবির সম্পাদনা নিয়ে এমন কিছু এক্সপেরিমেন্ট করলেন তিনি যা আজও যে কোনও ফিল্ম ইন্সটিউটে চর্চার বিষয়।’মেঘে ঢাকা তারা’,’কোমল গান্ধার’ থেকে ‘সুবর্ণরেখা’।সেই উদ্বাস্তু কলোনী,সেই দেশভাগের করুণ ফলাফল,সেই ক্ষয়িষ্ণু মানুষের রোজনামচা।সমালোচকরা বললেন,ঘটক নিজেকে রিপিট করছেন।আদপে ঋত্বিক প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের পথে এগিয়ে চলা সমাজের আসল গল্পটাই বোধহয় বারবার বলতে চেয়েছেন।
কেরিয়ারে পূর্ণদৈর্ঘের ছবির সংখ্যা মাত্র আট।অথচ,সব ছবিতেই বোধহয় নিজের বক্তব্য প্রতি খেপে বলার এক আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন ঘটক।তাঁর ছবিতে প্রতিনিয়ত উঠে আসে অবক্ষয় এবং ভাঙনের গল্প, অথচ সবসময় সুদিনের আশাতেই থাকতেন পরিচালক।তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ,’তিতাস একটি নদীর নাম’।যেখানে শেষ দৃশ্যে নায়িকা ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে,অথচ তিনি চোখে দেখছেন সবুজ ধানক্ষেত দিয়ে ছুটে আসছে একটি শিশু, নতুন জীবনের বার্তা নিয়ে।যুক্তি তক্কো আর গপ্পোতে স্বয়ং ঋত্বিক কুমার ঘটক ওরফে নীলকন্ঠ বাগচী মৃত্যুর আগে বলে ওঠেন, ”কিছু একটা করতে হবে তো।” গোটা বিশ্বে যতদিন সিনেমা যতদিন থাকবে,যতদিন বাংলা সিনেমা বাঁচবে, ততদিন আলোচনায়-সমালোচনায় বারবার উচ্চারিত হবে মহামতি ঋত্বিক কুমার ঘটকের নাম।