নকশাল আন্দোলন এবং এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা চারু মজুমদারকে নিয়ে ওয়েব সিরিজ তৈরি হওয়ার কথা যেদিন থেকে প্রকাশ্যে এসেছে সেদিন থেকেই বিভিন্ন মহলে তৈরি হয়েছে নানান বিতর্ক। তারপর দেখা দিয়েছে নানান অনিশ্চয়তা।এ প্রসঙ্গে, চারু মজুমদার-পুত্র তথা পশ্চিমবঙ্গ সিপিআইএমএল রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার এর ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছে।
ছয় এবং সাত-এর দশকে নকশালবাড়ির সশস্ত্র আন্দোলন বাঙালির কাছে এসেছিল এক অন্য আবেগ নিয়ে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে। নকশাল আন্দোলনের সেই আবেগ ওয়েব সিরিজ এর মাধ্যমে নাকি পর্দায় আসতে চলেছে বলে ইতিমধ্যে খবরে প্রকাশ।। আগামী বছরের প্রথম দিকেই শুটিং শুরু হওয়ার কথা এই ওয়েব সিরিজের। যা নিয়ে বেশকিছু অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে । তৎকালীন পুলিশ কর্তা রুনু গুহ নিয়োগীর লেখা ‘সাদা আমি কালো আমি’ অবলম্বনে এই হিন্দি ওয়েব সিরিজটি পরিচালনা করার কথা সায়ন্তন মুখোপাধ্যাযয়ের। এই বইয়ের পটভূমি অনুযায়ী অন্যতম প্রধান চরিত্র বামপন্থী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নকশাল নেতা চারু মজুমদার,যিনি সশস্ত্র আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তরুন প্রজন্মকে এবং অন্যদিকে পুলিশকর্তা রুনু গুহ নিয়োগী। প্রথমে শোনা গিয়েছিলো চারু মজুমদারের চরিত্রে নাকি দেখা যাবে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীকে এবং তার স্ত্রী লীলা মজুমদারের ভূমিকায় অভিনয় করবেন জয়া এহেসান। প্রসঙ্গত, পরিচালক সায়ন্তন ও জয়া জুটির ‘ঝরা পালক’ শিগগিরই মুক্তি পাবে। ছবিটি কবি জীবনানন্দ দাশের জীবন নিয়ে তৈরি। এই ছবিতে কবির স্ত্রী লাবণ্য দাশের চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া এহেসান।
চারু মজুমদার
এই ওয়েব সিরিজে নকশাল আন্দোলনের আদিপর্ব যেমন থাকবে তেমনই আন্দোলনের হালফিলের নেতা কিষেণজির প্রসঙ্গও উঠে আসার কথা। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের রাজনীতির এই বিতর্কিত অধ্যায় যখন পর্দায় আসতে চলেছে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক উঠে আসাটাই প্রত্যাশিত। এই ওয়েব সিরিজ তৈরীর খবর প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সিপিআইএমএল-র রাজ্য সম্পাদক তথা চারু-পুত্র অভিজিৎ মজুমদার পুলিশ কর্তা রুনু গুহ নিয়োগীকে এক নারকীয় অত্যাচারের প্রতিভূ বলে অভিহিত করে তার লেখা নিয়ে এই ওয়েব সিরিজ তৈরির ব্যাপারে সরাসরি আপত্তি তুলেছিলেন। তিনি বলেছেন, ছবি বানানোর গণতান্ত্রিক অধিকার সকলেরই আছে। কিন্তু রুনুর মত একজন খুনি পুলিশের লেখার ওপর নকশাল আন্দোলনের ছবি সঠিক তথ্য দিতে পারে না।কারণ এই বইটি তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন করে লেখা। লেখাটি অত্যন্ত একপেশে এবং বিকৃত। অভিজিতবাবুর কথায়, রুনু গুহ নিয়োগী যখন লালবাজারের লকআপে বাবা চারু মজুমদারকে বন্দী করে রাখে, যখন তার সমস্ত জীবনদায়ী ওষুধ বন্ধ করে এবং খেতে না দিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। তা ভারতের রাজনীতিতে এক বিরল ঘটনা। তাঁর কথায় শুধু নকশালবাড়ি নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা বেশ কিছু ভালো বই আছে কিন্তু সেগুলি বাদ দিয়ে সাহিত্য-গুণ বর্জিত একপেশে রুনুর লেখা কখনো নকশালবাড়ি আন্দোলনের সঠিক চিত্রকে তুলে ধরতে পারে না। অভিজিতবাবু বলেন, এই ওয়েব সিরিজ এর পক্ষ থেকে কিংবা পরিচালক নিজে কখনো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। কিন্তু সংবাদমাধ্যম মারফত জানতে পারলাম চারু মজুমদারের চরিত্রে অভিনয় করবেন নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকি এবং আমার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করবেন জয়া এহেসান। অথচ এই বইতে আমার মায়ের কোন প্রসঙ্গই নেই। পুরোটাই কল্পনাপ্রসূত। এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রসঙ্গত, বিতর্কিত পুলিশ কর্তা রুনু গুহ নিয়োগির এই বই প্রকাশের পর বহু সমাজকর্মীর উদ্যোগে এই বইয়ের পাল্টা, ‘সাদা রুনু কালো রুন’ নামের একটি বই প্রকাশ করা হয়েছিল। নকশাল আন্দোলনের ওপর এই ওয়েব সিরিজের খবর প্রকাশ্যে আসা মাত্রই অভিজিতবাবু অত্যন্ত জোরের সঙ্গে জানিয়েছিলেন যে তার মনে হয় না নওয়াজ উদ্দিন কিংবা জয়া এহসান এই চরিত্র দুটিতে অভিনয় করবেন।নকশাল নেতা অবশ্য নওয়াজউদ্দিন এবং জয়া এহসানের অভিনয় দক্ষতার যথেষ্ট প্রশংসা করেন। তিনি বলেন,”আমি নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকির লেখক সাদাত হাসান মান্টো-র ওপর তৈরি ‘মান্টো’ ছবিটি দেখেছি। তিনি যথেষ্ট ভাল অভিনেতা। এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই”।
অভিজিতবাবু এবং বাবা চারু মজুমদার
চারু মজুমদারের সশস্ত্র আন্দোলনে সাড়া দিয়ে তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে এসেছিল। অবিসংবাদিত বাম নেতা হিসেবে উঠে এসেছিলেন তিনি। অনেক কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণ গিয়েছিল এই আন্দোলনে সামিল হয়ে। চারু মজুমদার যে নতুন সমাজ গড়ার পথ দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন তা সম্পূর্ণ সফল হয়নি। তার ব্যর্থতার দায়ও তাঁকেই নিতে হয়েছিল।এসব যদি ওয়েব সিরিজের চিত্রনাট্যে প্রতিফলিত হয় সে ব্যাপারে অভিজিতবাবুর মতামত জানতে চাইলে তিনি তা এড়িয়ে যান এবং বলেন আমরা কোন কমার্শিয়াল ভেঞ্চারে নিজেদেরকে জড়াতে পারি না। এর আগে নকশালবাড়ি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অনেক ছবি বলিউডে তৈরি হয়েছে।যেগুলি বিকৃত। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে বিতর্ক সব সময় ছিল এবং থাকবে।
চারু মজুমদার ও তাঁর সতীর্থরা
অভিজিতবাবু দাবি করেন ১৯৭২ সালে রুনু গৃহ নিয়োগী যখন চারু মজুমদারকে গ্রেফতার করে ১২ দিন জেল হেফাজত রাখেন তখন তাঁকে জীবনদায়ী ওষুধ যেমন দেওয়া হয়নি তেমনি খেতে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।পারকিনসন থাকার কারণে তিনি নিজে খেতে পারতেন না। আদালতে পর্যন্ত পেশ করা হয় নি। এরপর তার মৃত্যু হয়। এটি প্রকারান্তরে এক ধরনের খুন। কাজেই হত্যাকারীর জবানবন্দির ওপর লেখা নিয়ে নকশালবাড়ি কিংবা চারু মজুমদার এর ওপর কোন ছায়াছবি বাস্তবচিত্র তুলে ধরতে পারে বলে অভিজিতবাবু মনে করেন না।তাছাড়া সেই সময় বহু মহিলা অ্যাক্টিভিস্ট রুনুর হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি অর্চনা গুহ নিয়োগী মামলার উল্লেখ করেন। তাঁর ধারণা এই ওয়েব সিরিজ নকশালবাড়ির ইতিহাসকে বিকৃত করে উপস্থাপনা করবে। অনেক সাধারণ মানুষও এটাই মনে করেন। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করছি। দরকার হলে পথে নামবো। অনেকেই নওয়াজ উদ্দিন এবং জয়া এহসানকে খোলা চিঠি লিখেছেন যাতে তাঁরা এই ওয়েব সিরিজে কাজ না করেন। অভিজিতবাবু উল্লেখ করেন ইতিমধ্যেই নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকি ওয়েব সিরিজে কাজ করবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। অভিজিৎ-এর ধারণা জয়াও একই পথ অনুসরণ করবেন।
চারু মজুমদারের তিন সন্তান অনিতা (বসে আছেন), মধুমিতা এবং অভিজিৎ
চারু-পুত্র বলেছেন, ‘পরিচালক সায়ন্তনবাবু অবশ্য সাফাই দিয়েছেন যে একমাত্র এই বইটির কপিরাইট পাওয়া গেছে। তার মানে এই নয় এই বইটির সমস্ত কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করে ওয়েবসিরিজটি তৈরি হবে। বরঞ্চ নকশাল আন্দোলনের গৌরবময় দিকটি এই ওয়েবসিরিজে তুলে ধরা হবে’। অভিজিতবাবু অবশ্য মনেপ্রাণে একেবারেই তা বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেন, আমরা কোনো বাণিজ্যিক প্রজেক্ট এর সঙ্গে থাকতে পারি না। কিন্তু এই বই নিয়ে নকশাল আন্দোলনের ওপর ছবি কখনো সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারেনা; তা বিকৃত হতে বাধ্য। তিনি উল্লেখ করেন বলিউডে নকশালবাড়ি নিয়ে এর আগে বহু ছবি তৈরি হয়েছে। কারণ সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো নকশাল আন্দোলন এবং চারু মজুমদার সম্পর্কে যথেষ্ট কৌতুহল রয়েছে। অভিজিতবাবু জোরের সঙ্গে বলেন, বলিউডের সেই সমস্ত ছবির দু-একটি বাদ দিলে বেশিরভাগই অত্যন্ত খারাপ মানের এবং বিকৃত। কেউ যদি সত্যিকারের অথেন্টিক কাজ করতে চায় আমরা সব সময় তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসি। বেশকিছু ভালো তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে নকশাল আন্দোলনের উপর। যেগুলোতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। অবশ্য তিনি বলিউডে এবং বাংলায় বেশকিছু ভালো রাজনৈতিক ছবি তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আনন্দ পটবর্ধন ,মৃণাল সেন প্রমুখের নাম উল্লেখ করেন। একদম সাম্প্রতিক কালে ওয়েব প্লাটফর্মে মুক্তিপ্রাপ্ত উধম সিং অভিজিত বাবুর যথেষ্ট ভাল লেগেছে বলে জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে চারু মজুমদার তথা নকশাল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই ওয়েব সিরিজ নিয়ে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। একদিকে এই ওয়েব সিরিজের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নওয়াজুদ্দিন ইতিমধ্যেই সরে গেছেন। জয়া এহসানও অনেকটাই অনিশ্চিত। অন্যদিকে আরেক টলিউড অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী যিনি এই ওয়েবসাইটে একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করবেন বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,’আমি কিছুই জানিনা, আমাকে কেউ এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেনি। আমিও সংবাদমাধ্যম মারফতই পুরোটা জেনেছি।’
নকশাল নেতা চারু মজুমদারের একসময়ের বাসস্থান
এ যাবৎ বলিউডে নকশাল আন্দোলন নিয়ে যত ছবি তৈরি হয়েছে তার বেশিরভাগ ছবি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রকারান্তরে বর্তমান নকশাল নেতা তথা চারু-পুত্র অভিজিৎ মজুমদার কি এটাই বলতে চাইছেন যে ভারতের বাম রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নকশাল আন্দোলন ও অবিসংবাদিত নেতা চারু মজুমদারকে পর্দায় আনার আগে কাহিনী নির্বাচন এবং চিত্রনাট্য তৈরির ক্ষেত্রে আরো বেশি গবেষণা করার প্রয়োজন ছিল। বিশেষত তা যখন আন্তর্জাতিক ওয়েব প্লাটফর্মে দেখানো হবে। এছাড়াও অনেকেরই প্রশ্ন বলিস্টার নওয়াজ উদ্দিনকে বাদ দিয়ে নির্মাতারা কিংবা আন্তর্জাতিক স্তরের ওয়েব প্ল্যাটফর্ম কি আদৌ সম্মতি দেবে এই ওয়েব সিরিজ তৈরি করতে?এত বিতর্কের মধ্যেও নতুন করে পরিচালক সায়ন্তন মুখোপাধ্যায় এখনো মুখ খোলেননি। এখন প্রশ্ন উঠেছে,অনিশ্চয়তার মেঘ কাটিয়ে এই ওয়েব সিরিজ কি আদৌ হচ্ছে!
চারু মজুমদার