বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র সাংবাদিক রঞ্জন দাশগুপ্তর সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছে। বর্ষীয়ান এই সাংবাদিক দেব আনন্দের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন দীর্ঘ ২৫ বছরের বেশি। দেব আনন্দের চলচ্চিত্র জীবন এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে তাঁর লেখা ভারতের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
বলিউডের চিরসবুজ নায়ক দেব আনন্দের আজ জন্মদিন। তার পুরো নাম ধরম দেবদত্ত পিশোরিমাল আনন্দ। তিনি ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ ভারতে পাঞ্জাবের পাঞ্জাবের গুরুদাসপুরে আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যা এখন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে বলিউডের বর্ণময় এই অভিনেতার অগণিত ভক্ত। ১৯৫০-এর দশক এবং ষাটের দশকে দেব আনন্দ ছিলেন চলচ্চিত্র প্রেমীদের কাছে হার্টথ্রব রোমান্স কিং।
আরও পড়ুন: মুখোমুখি তিন নোবেলজয়ী
তাঁর আইকনিক স্টাইল এবং অভিনয়গুণে বিশেষত তরুণীরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। চলচ্চিত্র এবং সংগীতজগতের তৎকালীন প্রতিভাবান বাঙ্গালীদের সঙ্গে তিনি অসাধারণ কিছু কাজ করেছিলেন। তার স্ত্রী কল্পনা কার্তিক ওরফে মোনা সিংহার মা ছিলেন একজন বাঙালি এবং বাবা ছিলেন পাঞ্জাবি। দেব আনন্দের সঙ্গে ১৯৪৮ সালে ‘জিদ্দি’ ছবির মাধ্যমে প্রথম কিশোর কুমারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়। এই ছবিতে দেব আনন্দের লিপে কিশোর কুমারের বিখ্যাত গান শোনা যায়, ‘মরনে কি দুয়া কিউ মাঙ্গু’।
এরপর দেব সাব স্হির করেন যে পরবর্তী ছবিগুলোতেও কিশোর কুমারই তাঁর লিপে গান গাইবেন। এরপর দেবের দাদা চেতন আনন্দ ‘নবকেতন প্রোডাকশন হাউজ’ তৈরি করেন। যেখানে পার্টনার হন আর এক মহান বাঙালি সংগীতশিল্পী শচীন দেব বর্মন।এরপর থেকে শচীনকর্তা তাঁর সেরা গানগুলি দেব আনন্দের ফিল্মের জন্যই তৈরি করেন। যেমন ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’, ‘পেইং গেস্ট’, ‘তেরে ঘর কে সামনে’, ‘গাইড’,’জুয়েল থিফ” ‘গ্যাম্বলার’, ‘তেরে মেরে স্বপ্নে’ ইত্যাদি ছবির গান অসম্ভব জনপ্রিয় হয়। পরবর্তীকালে শচীন দেব হেমন্ত মুখোপাধ্যায়(হেমন্ত কুমার)কে দেব আনন্দের ছবিতে গান গাইয়েছিলেন। যা কিশোরকুমারের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৫২ সালে হেমন্ত কুমার প্রথম দেব আনন্দের জন্য গাইলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় সেই গান,’এ রাত চাঁদনী ফির কাহা’। গুরু দত্ত পরিচালিত ‘জাল’ ছবির এই গান সুপারহিট হয়েছিল।
এরপর শচীন দেব আরো বহু ছবিতে হেমন্তকে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন। যার মধ্যে বেশ কিছু জনপ্রিয় গান হল ‘তেরি দুনিয়া মে জিনে সে’, ‘চুপ হায় ধরতি’, ‘দিল কি মাঙ্গে হায় যাওয়া’ (হেমন্ত এবং গীতা দত্ত), ‘হায় আপনা দিল তো আওয়ারা’, ‘ইয়াদ আ গেয়ি না তুমি হামে জানো’ । রোমান্স কিং স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে হেমন্তের গাওয়া গানগুলো তার রোমান্টিক ইমেজকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলো। হেমন্তের সুরারোপিত ছবি ‘ফেরি’তে দেব আনন্দ ও গীতা বালি অভিনয় করেছিলেন। এই ছবি পরিচালনা করেছিলেন আর এক বাঙালি পরিচালক হেমেন গুপ্ত। এই ছবির ক্যামেরাম্যান ছিলেন আর এক বাঙালি পরিচালক অজয় কর। হেমন্তবাবুর ছেলে রিতেশ ‘ফেরি’ ছবিতে দেব আনন্দের ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
আলি আকবর খাঁ তার ফিল্মি কেরিয়ারে সংগীত পরিচালনা শুরু করেন দেব আনন্দ প্রযোজিত ‘আঁধিয়া’ ছবি দিয়ে। এই ছবির পরিচালক ছিলেন দেবের দাদা চেতন আনন্দ। ছবির নেপথ্য সঙ্গীতে আলি আকবরের সরোদ, রবিশংকরের সেতার ও পান্নালাল ঘোষের আঁর-বাঁশি ছিল অন্যতম আকর্ষণ।শোনা যায় এই তিনজন সংগীতের মহারথীর ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন দেব আনান্দ। ‘আঁধিয়া’ ছবিটি ভেনিস,মস্কো ও পিপিং চলচ্চিত্র উৎসবে ভারতের প্রতিনিধি ছবি হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছিল। ছবিটি প্রতিটি উৎসবে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। সলিল চৌধুরী যখন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে ‘মায়া’ ছবিতে ১৯৬১ সালে গান গাওয়াবেন বলে ঠিক করেন তখন দেবসাব এক কথায় রাজি হয়ে যান।
আরও পড়ুন:‘পথের পাঁচালি’র ৬৬ বছর,সত্যজিতের জন্মশতবার্ষিকীতে প্স্পেশাল কভার
দ্বিজেনের কন্ঠে ‘অ্যায় দিল কাহা তেরি মঞ্জিল’ এবং ওই একই ছবিতে লতার সঙ্গে ডুয়েট ‘ফির একবার কহো’ সুপারহিট হয়েছিল। দ্বিজেনের একা গাওয়া গানটি শোনার পর দেব আনন্দ বলেছিলেন, এই গানে আমার জীবনের কথাই প্রতিফলিত হয়েছে। সন্ধ্যা রায় যখন ‘আসলি নকলি'(১৯৬২) ছবিতে ঋষিকেশ মুখার্জির পরিচালনায় দেব আনন্দের বোনের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান, সেই সময় দেব তাঁকে ‘সিস্টার’ বলে সম্বোধন করতেন। এই ছবিতে দেব যখন চাটাইয়ের উপর ঘুমোচ্ছেন সন্ধ্যা রায় দেবের পিঠে দাঁড়িয়ে লাঠি হাতে ঢেঁকি ভাঙার পায়ের কাজ করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। এই দৃশ্যটি করার আগে সন্ধ্যা রায়ের যথেষ্ট সংশয় ছিল যে এত বড় মাপের একজন বলিউডের স্টার এইরকম একটা দৃশ্য করতে কি রাজি হবেন! চিত্রনাট্য-এর খাতিরে এককথায় দেব রাজি হয়েছিলেন।
দেব বলেছিলেন,’তাতে কি হয়েছে তুমি তো আমার বোন। তুমি প্রমথেশ বড়ুয়া,ছবি বিশ্বাস,উত্তমকুমারের মতন মহান অভিনেতাদের দেশের অভিনেত্রী। তোমার সঙ্গে কাজ করা আমার কাছে সৌভাগ্য’। এরপর সুপ্রিয়া চৌধুরীকে ‘তিন দেবিয়া’ ছবির জন্য মনোনীত করেছিলেন দেব। কিন্তু বাংলা ছবি ‘জীবন জিজ্ঞাসা’র কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সে কাজ সুপ্রিয়া দেবীর করা হয়নি। রাহুল দেব বর্মন এর সঙ্গে ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ ছবির সময় থেকে অন্তরঙ্গতা শুরু হয় দেব আনন্দের। কলকাতায় তখনকার দিনে বহু ছবির প্রিমিয়ারে দেবকে দেখা গিয়েছিল। ‘জনি মেরা নাম’,’ জব পেয়ার কিসিসে হোতা হায়’, ‘গাইড’ ইত্যাদি ছবির জন্য আগের দিন রাত থেকে টিকিট কাউন্টারে ভিড় লেগে গিয়েছিল।পর্দায় তাঁর সঙ্গে ওয়াহিদা রহমান এর জুটি কেউ কখনো ভুলতে পারবে না। ‘গাইড’এর প্রিমিয়ারে ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলে যখন এসেছিলেন তখন এক নবীন ভক্ত অটোগ্রাফের খাতা ছুঁড়ে দেন তাঁর দিকে। চিরসবুজ অভিনেতা সেই খাতা একহাতে লুফে নেন এবং স্নেহভরে সই করে ফেরত দেন ভক্তকে। ভক্তের চোখে ততক্ষনে আনন্দাশ্রু। বিখ্যাত জুয়েল থিফ ছবির টুপি বিক্রি করে কলকাতার প্যারাডাইস সিনেমা হলের সামনে এক বিক্রেতা রুজি-রোজগার অর্জনে সফল হয়েছিলেন। এমনকি তিনি নতুন ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তাকে আর্থিক সাহায্য দান করেছিলেন দেব। ছবি প্রিমিয়ারে এসে তিনি দেখেন তার কাছ থেকে হু হু করে সেই টুপি বিক্রি হচ্ছে। পরে দেবের পরিচিত একজন মারফত ওই টুপি বিক্রেতাকে সেই সময় ৫০০০ টাকা পাঠিয়ে ছিলেন দেব আনান্দ। এ ঘটনা ১৯৬৭ সালে পুজোর সময়।