মেদিনীপুর :এই গ্রামের পুরুষ-মহিলারা জানেন না জেলার নাম ৷ রাজ্যের নাম ৷ বা দেশের নাম । লিখতে কিংবা সই করা তো দূরের কথা, বর্ণ-পরিচয়ই হয়নি অধিকাংশের । গুণতেও পারে না টাকা-পয়সা ৷ হিসেব করলে হয়তো দেখা যাবে, একশো জনের মধ্যে এক জন চতুর্থ শ্রেণির দরজা টপকেছেন ৷
না ৷ এটা কোনও গল্প কথা নয় ৷ এটাই বাস্তব পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের খোলাগেড়্যা মৌজার বাগালপাড়ায় । সেখানে ঋতুমতী হলেই বিয়ে হয়ে যায় ৷ আবার, পাত্রের বয়স ১২-১৩ বছরের বেশি হয় না বললেই চলে ৷ এই অকাল বিয়ের চরম পরিণতি চোলাইয়ের নেশা-ভুখা পেট-অনাহার-অপুষ্টি ৷
শিক্ষা-উন্নতি-অগ্রগতি থেকে বহু দূরে থাকা এই এলাকায় নতুন আলো আনার লড়াই শুরু করেছেন দুই শিক্ষক ৷ শান্তনু অধিকারী এবং ভাস্করব্রত পতি ৷ খুলেছেন পাঠশালা ৷ নাম দিয়েছেন বর্ণপরিচয় ৷ গত মাস থেকেই এই লড়াই চালাচ্ছেন তাঁরা ৷
ছাত্রছাত্রী ও গ্রামবাসীদের জন্য তৈরি হয়েছে স্বাস্থ্য কেন্দ্র
না না করে দশক পাঁচেক হয়ে যাবে ৷ একটি পুকুরকে ঘিরে প্রায় ৩০০ পরিবারের বাস । কাছের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দূরত্ব মেরে-কেটে ৮০০ মিটার । অথচ, সেই স্কুলের চৌকাঠ মাড়ায়নি এখানকার ছোটরা । যে বয়সে হাতে খাতা-কলম থাকা উচিৎ, সেই বয়সে হাত জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা কাঠ-ডালপালা ভর্তি থাকে । যে বয়সে পিঠে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে চলা উচিৎ, সেই বয়সে মাথায় চাপে মজুর খাটার নির্দেশ । ‘পড়া আর ভরা পেট’ এদের জীবনের অঙ্গ নয় । পাড়া জুড়ে চোলাই মদের রমরমা । স্বাভাবিক পরিণতি শৈশব থেকেই নেশার আসক্তি ।
এই গ্রামেই শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সচেতনতা ফেরাতে লড়াই চালাচ্ছেন সবংয়ের শিক্ষক শান্তনু আর তমলুকের শিক্ষক ভাস্করব্রত । তাই, ‘বর্ণপরিচয়’য়ের পর, আয়োজন করা হয়েছিল বিনামূল্যের স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির । সে দিন ৭৫ জনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়। বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় ওষুধ ।
সহযোগিতার সব রকম আশ্বাস দিয়েছেন গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য মনোরঞ্জন রায় । কথায় কথায় অনেকটা আক্ষেপের সুরে বলতেও শোনা গিয়েছে, “অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছি । কিছুতেই এরা নেশা ছাড়ে না ! সামনেই স্কুল, স্কুলেও যায় না । লুকিয়ে চুরিয়ে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয় । দুই শিক্ষকের সব রকম সাহায্য করব ।”
এই উদ্যোগে খুশি স্থানীয়রাও ৷ খুশি ১২-১৩ বছরে মাতৃত্বের ‘দায়িত্ব’ নেওয়া বুল্টি, চুমকি, সরলা-রা । তারা বলে ওঠে, “আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করুক ৷ একটু ভালভাবে বাঁচুক ।” এখন দেখার বিদ্যাসাগরের জেলায় শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকা গ্রামটিতে কতটা উন্নয়নের আলো ঢুকতে পারে ৷