নয়ের দশকের শুরু, তখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের অধুনা লুপ্ত সেলস ট্যাক্স কমিশনার। তাঁরই হাত ধরে তৎকালীন ইন্সপেক্টর রাজের অবসান ঘটে। রাজ্যের বিক্রয় কর বিভাগ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে। বেশ জাঁদরেল আমলা বলে বেলেঘাটার দফতরে পা ফেললেই কানাঘুষো শোনা যেত। এহেন আমলার দফতরেই একদিন হঠাৎই মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ মিলে যায়। প্রথম দর্শনেই রাশভারী কথাবার্তা শুনে কিছুটা হলেও গুটিয়ে গেছিলাম। চশমার আড়াল থেকে আমার পরিস্থিতি অনুধাবন করে তাঁর পরবর্তী ব্যবহার সত্যি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তারপর থেকে দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। এরপর তিনি চলে যান ভারত সরকারের সচিব পদে। যার ফলে আবার দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না। এর পরেই তাঁকে পেয়েছিলাম প্রসার ভারতীর সিইও হিসাবে। তখন তিনি আমার বস। কিন্তু একটা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম আমাদের পূর্ব পরিচয়ের সেই স্মৃতি তাঁর কাছে তখনও জীবন্ত। রাজ্যের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলে কেন্দ্রের মনমোহন সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি সচিব থেকে প্রসার ভারতীর সিইও। না কোনও পরিবর্তন নেই। নেই কোনও ভনিতা। স্পষ্ট কথাকে জোরের সঙ্গে বলতে কখনই ভয় পেতেন না। সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতে সর্বদাই তাঁকে দেখেছি সরব থাকতে। যার ফলে বারেবারেই শাসক দলের বিরাগভাজন যে হননি তা নয়। কিন্তু তাঁর প্রখর পান্ডিত্য ও যুক্তির কাছে হার মানতে হয় সকলকেই।
আরও পড়ুন: রাজ্যসভা ভোটে তৃণমূলের প্রার্থী জহর সরকার
কিন্তু আমলার পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর কেন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে জহরবাবু জানান, তিনি মানুষের জন্য কাজ করতে চান, সেই কারণেই তাঁর রাজনীতিতে আসা। তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ নই। সরকারি আমলা ছিলাম। কিন্তু, এখন মানুষের জন্য কাজ করার জন্য রাজনীতিতে আসছি। সাধারণ মানুষের কথা সংসদে তুলে ধরার জন্য আমাকে নতুন ভূমিকায় দেখা যাবে।’ তবে, অবসরপ্রাপ্ত এই IAS অফিসার জহর সরকারের সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্বের সম্পর্ক প্রথম থেকেই ভালো। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে। সম্প্রতি রাজ্যের নির্বাচনে কেন্দ্রের ও প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকার কড়া সমালোচনা করে কলম ধরেন তিনি। তার পরে প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কেন্দ্রের সংঘাত ইস্যুতে আলাপনের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। সেই সময় তিনি সোশ্যাল মিডিয়া ও বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে এর বিরুদ্ধে কলম ধরেন। একটি পত্রিকায় তিনি লেখেন, “যদি অটল বিহারী বাজপেয়ী কিংবা মনমোহন সিংহের মতো একটু ‘ভিন্ন ভাবে শিক্ষিত’ প্রধানমন্ত্রীর সময়ে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো, সে ক্ষেত্রে হয়তো তিনি নিজেই মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করতেন। ডেকে নিতেন নিজের বিমানে। যাতে এক সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখা যায়। কিন্তু যাঁরা ‘অজ্ঞাত রেলস্টেশনে চা বিক্রি করে আসা’ শৈশবের গর্ব করেন কিংবা পরিচয় দেন ‘ফকির’ হিসেবে, তাঁদের কাজের ধরন সম্ভবত অনেকটাই আলাদা। ”
অবসর নেওয়ার পরে ক্রমাগত কেন্দ্রের মোদি সরকারের পাশাপাশি স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে তাঁকে বারে বারেই এভাবে সোচ্চার হতে দেখা গিয়েছে।
আরও পড়ুন: মঙ্গলবার মুখোমুখি হচ্ছেন মোদি-মমতা
এই প্রাক্তন জেভিরিয়ান জহর সরকারকেই এবার রাজ্যসভায় পাঠাতে চাইছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। একসময় বাম রাজনীতির আদর্শে বেড়ে ওঠা প্রাক্তন এই আমলা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ফোন পেয়ে আর না করতে পারেননি। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে এবার তাই রাজ্যসভার সদস্য হয়ে তাঁর নয়া ইনিংস শুরু হওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
তবে একই সঙ্গে এই বিষয়েও চোখ রাখার বিষয় সচিব হয়ে তাঁর কাজের যে বাধ্যবাধকতা ছিল সরকারের কাছে এখন কিন্তু তা আর থাকছে না। তিনি রাজ্যসভার সাংসদ। মানে দেশের সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য তাঁর ক্ষুরধার বক্তব্যে এবার কিন্তু খানিকটা হলেও বেকায়দায় পড়তে হতে পারে কেন্দ্রের মোদি সরকারকে। অপরদিকে, রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে এসে গেল একটি শক্তিশালী অস্ত্র। যে অস্ত্রের ঘায়ে ধর্ম রাজনীতি, সমাজনীতি, দর্শন, থেকে, শিক্ষা সংস্কৃতি প্রতিটি বিষয়েই সংসদের ভেতরে তাঁর ক্ষুরধার বক্তব্যকে সামলাতে হবে মোদি সরকারকে।
জহর সরকার এমনই একজন প্রশাসক যিনি নাগরিকদের অধিকার এবং বহুসংস্কৃতির এই দেশে জনসাধারণের উন্নয়নের কাজেই প্রশাসন পরিচালনায় নিজেকে প্রায় ৪১ বছরের বেশি সময় নিয়োজিত রেখেছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছে রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসক দল। একটা সময় চেয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব হতে। তাঁর জন্য প্রশাসনের কাজকর্মের পাশে সময় বের করে উচ্চশিক্ষার জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যান জোর কদমে। কিন্তু তৎকালীন বাম সরকারের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরেই হয়তো তিনি রাজ্যের দায়িত্ব ছেড়ে কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হয়েই পাড়ি দিয়েছিলেন দিল্লির উদ্দেশ্যে।
সেখানে তিনি নভেম্বর ২০০৮ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১২ পর্যন্ত ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রকের নেতৃত্ব দেন। সিরিয়ার উন্নয়নেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ইউনেস্কো সহ শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিতেও ভারতের হবে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর সুচিন্তিত মতামত ও দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা ও প্রবন্ধগুলি আজকের প্রেক্ষাপটে যথেষ্টই প্রাসঙ্গিক। এহেন চির উন্নত শির এই প্রশাসক প্রসার ভারতীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তারও কারণ বর্তমান কেন্দ্রের মোদি সরকারের নীতি সহ একাধিক জনস্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপ। তিনি মিডিয়ার স্বাধীন মত প্রকাশের পক্ষে চিরকাল মত দিয়ে এসেছেন। এর ফলে বিতর্কে জড়িয়েছেন বারবার। কিন্তু তাঁর ক্ষুরধার যুক্তির কাছে হার মানতে হয়েছে সকলকেই। সরকারি আমলার পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েও তাঁর লেখনি কিন্তু থামেনি। এবার প্রত্যক্ষ রাজনীতির ময়দানে মোদির বিপরীতে প্রতিপক্ষ হিসাবে সংসদে চললেন তাঁরই প্রাক্তন আমলা।