ভূতের মুখে রাম নাম, এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে, গোরু হারালে এমনিই হয় মা, ঢিল মারলে পাটকেলটি খেতে হয়, যেমন কর্ম তেমন ফল, অকালে খেয়েছ কচু, মনে রেখো কিছু কিছু, অতি দর্পে হতা লঙ্কা, কত ধানে কত চাল, এরকম বেশ কিছু প্রচলিত প্রবাদবাক্যের যে কোনও একটা দিয়ে আজকের বিষয় শুরু করা যায়, সবকটাই যাকে বলে একদম খাপে খাপ। সাতসকালে উঠে শুনি আমাদের খোকাবাবু, শুভেন্দু মাইতি, যাকে দেখলে ওনার কনস্টিচুয়েন্সির ভোটাররাও ছড়া কাটেন, তিনি বলেছেন দলবদলের বিরুদ্ধে যে আইন, তাকে কড়াভাবে লাগু করতে হবে, তা কাকে বললেন?
যিনি গণতান্ত্রিক কংগ্রেস থেকে জনতা দল হয়ে বিজেপি হওয়ার সুবাদে, এ বাংলার সবথেকে বিলাস বহুল প্যালেসে ফ্রিতে থাকেন, সেই ধনকড় সাহেবকে বললেন। আবার বলার আগে জবরদস্ত প্রস্তুতি ছিল, ডাক দিয়েছিলেন সাতাত্তর মাইনাস দুই, পঁচাত্তর জন বিধায়ককে। কিন্তু হাজির সাকুল্যে ৫০ জন। কি কান্ড? ২৫ জন এলই না, বাকি ৫০ জনের মধ্যে কতজন, যারা এলেন বটে কিন্তু টুক করে খসে যেতে পারেন? কারণ দলবদল আইন বলছে একের তিন ভাগ সদস্য যদি বের হয়, তাহলে সেটা দল বদল আইনের আওতাতেই পড়বে না, এবং সেরকম হলে বিরোধী দলের স্বীকৃতিও নির্ভর করবে সরকার পক্ষের মর্জির ওপর, ঠিক এখন আর একটা প্রবাদ বাক্যের কথা মনে পড়ে গেলো, আমও গেলো, ছালাও গেলো। আর এই হল মন, বুঝলেন? ধাঁ করে রত্নরাজি বার করে আনে স্মৃতি থেকে, কারণ আবারও একটা প্রবাদ মাথায় এল, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল এঁড়ে গোরু কিনে। সব মিলিয়ে গোটা সাতেক ঘ্যামা ঘ্যামা পোস্ট ছিল, শুনেছি ওনার ঘরের গৃহ সহায়করাও বাজারে গেলেও দোকানদারেরা স্যালুট ঠুকতেন, এখন শুনলাম ধারবাকিও রাখতে রাজি নয়, রাতে ঘুমিয়ে আম, ছালা, তাঁত আর এঁড়ে গোরুর স্বপ্ন দেখেন নিশ্চই৷
কারণ শোনা গেলো বিরোধী দলনেতা হিসেবে নির্বাচনের দিন মাত্র ৩৪ জনের সমর্থন ছিল, আদিরা মানতে রাজি নয়, নবরা উল্টোমুখো, ক’জন অনুগামী আছে বলে তবুও ফেসবুকে ছবি উঠছে, সত্যি সত্যিই তেমন হলে, আহারে মানুষটা বড্ড একলা, এমনও শুনতে হতেই পারে, কারণ বিজেপি – আরএসএস কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরোলে বড্ড পাজি। ওনারা, মানে মোদী–শাহ যা চাইছেন, তা যদি ডেলিভার করতে না পারেন, তাহলে এক ঝটকায় পূনমূর্ষিক ভব বলে হাঁটা দেবে, বহু উদাহরণ আছে, চিরাগ পাসোয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখুন না, নীতীশ কুমারকে সাইজ করার জন্য, পেছন থেকে দম দিয়ে বিহার নির্বাচনের আগে ছেড়ে দিল, আজ দলের সাকুল্যে ৬ সাংসদ এর মধ্যে, ৫ জন চলে গেছেন বিজেপিতে, বিজেপির সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রীর খোয়াব দেখা চিরাগ পাসোয়ান বিলকুল একা, চারিদিকে সন্নাটা। এরকম হয়, বিজেপির হাতে নাড়ু খেলে, ফেরত দিতে হয়, আর ফেরত না দিতে পারলে, পূনমুর্ষিক ভব, আবার ইঁদুর হয়ে যা। তো তেনার বাড়িতে দুই দলবদলু বসে আছে, কাঁথির অধিকারী পরিবারের এই রত্ন কি আজকাল বাড়িতে রাত কাটায় না? তেনারা বিজেপি হয়েছেন, বিজেপির হয়ে নির্বাচনে প্রচার করছেন, আর সুপুত্র দলবদল আইন নিয়ে রাজ্যপালের কাছে দরবার করছে, এই সিচুয়েশন মাথায় রেখেই কি বলা হয়েছিল, চোরের মায়ের বড় গলা?
ওদিকে ক্রনিক ডিজিজের মত রাজ্যে আছেন এক রাজ্যপাল, বহু আগে পদ্মজা নাইডু যাকে বলেছিলেন শ্বেতহস্তি, সাদা হাতি। তার গল্প বলার আগে মামলা জ্যেঠুর গল্পটা বলে নিই। ইনি আমার মামার বাড়ির এলাকার মানুষ, এলাকার হদিশ দিতে পারবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধায়, তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্রের মধ্যেই পড়ে কি না। আজ বেঁচে নেই, মার নিজের স্মৃতিতেও খুব আবছা, কারণ মামলা জ্যেঠু মারা গেছেন বহু আগে, কিন্তু তিনি ফেমাস, এখনও মামাবাড়ির আশেপাশের ৩০/৩৫ টা গ্রামে তো বটেই, মামলা জ্যেঠুকে সব্বাই চেনে। জীবদ্দশায় তাঁকে সমীহ করত না এমন লোক ছিল না, এলাকার শাসক দলের নেতা থেকে শুরু করে বিরোধী দলের নেতা, রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়ক থেকে কীর্তনীয়া, মুদি থেকে পরামাণিক, প্রত্যেকে সমঝে চলত ওই মামলা জ্যেঠুকে। কী ভাবছেন, তিনি বড় উকিল ছিলেন? আজ্ঞে না, তিনি মামলা করতেন, সাত সকালে উঠে ঘোষণা দিতেন, এই যে ঘোষের পো চললাম, তোর বাপের নামে একটা মামলা ঠুকতে।
তারপর বাস ধরে ডায়মন, অমনটাই ওখানকার মানুষ বলে। ডায়মনে গিয়ে বাস ধরে আলিপুর কোর্টের ভেতরেই পাইস হোটেলে খাওয়া দাওয়া সেরে নিতাই ঘোষের নামে মামলা ঠুকে ফিরতেন, রাতে চণ্ডীমন্ডপে বসে বলতেন, ঠুকে দিলাম একখানা, এবার বুঝবে নিতাই। মামলার জন্য বাপকেলে সম্পত্তিও বিক্রি করতেন, কিন্তু মামলা না করলে তেনার ঘুম হত না, পুজোর সময়, সকলে ছুটির আনন্দে আছে, ওনার মন খারাপ, আদালত বন্ধ। তো আমাদের রাজ্যেও এই মামলা জ্যেঠুর কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া এক ভাই আছেন, সাকিন রাজভবন, নাম জগদীপ ধনকড়। আপাতত তিনি দিল্লিতে, ওনার অভ্যেস মামলা নয়, ট্যুইট করা। সেনসেসনাল ট্যুইট করে লাইক গুনতি করাটা ওনার হবি। উনিই এ রাজ্যের রাজ্যপাল কাম বিজেপি প্রধান, উনিই একা সেই কুম্ভ যিনি বিজেপির নকল বুঁদিগড় রক্ষা করে চলেছেন, ট্যুইট করেই চলেছেন। বিজেপি হেরেছে রাজ্যে, নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী শপথ নেবেন, নতুন সরকার তৈরি হবে, নির্বাচন কমিশনের প্রশাসনিক দায়িত্ব চলে আসবে সরকারের ওপর, তার আগে পর্যন্ত রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা, পুলিশ প্রশাসন চলছে নির্বাচন কমিশনের দেখরেখে। শপথ গ্রহণ করালেন মিঃ ধনকড়। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের ফুল তখনও টাটকা, কিছু অতিথি অভ্যাগত তখনও রাজভবন প্রাঙ্গণও ছাড়েন নি, ট্যুইটবাবু ট্যুইট করলেন, রাজ্য প্রশাসন কাজ করছে না, দিকে দিকে অত্যাচার চলছে, পুলিশ নীরব, আমি নিজেই যাব সে সব জায়গায়। মানে? রাজ্য প্রশাসনকে হাল ধরতে দিন, যে বিষ ছড়িয়েছিল বিজেপি আরএসএস তার তুলনায় তো কিছুই হয়নি, বিজেপি আসলে এক এক কো দেখ লেঙ্গে, সেই চুন চুন কর মারেঙ্গে গোছের ডায়ালগ দিয়েছিল বিজেপি নেতারা, স্যোশ্যাল মিডিয়াতে হুমকি, তার সামান্য অভিঘাত, যা হওয়া কাম্য নয়, কিন্তু হচ্ছে কখন? যখন রাজ্য প্রশাসনের দায়িত্বে নির্বাচন কমিশন। রাজ্য সরকার কাজ শুরু করলেন, তিন দিনের মাথায় আর একটিও মৃত্যুর ঘটনা নেই।
রাজ্যপাল ট্যুইট বাবু তখন গ্যালারি গরম করতে শিতলকুচি আর নন্দীগ্রাম ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কী চান? কাম স্ট্রেট, খোলাখুলি বলুন, ৩৫৬ ধারা? রাষ্ট্রপতির শাসন? সামলাতে পারবেন? মানুষের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে এই কাজ করার হিম্মত আপনার তো ছেড়েই দিন, মোদী – শাহের আছে? ওনারাও জানেন সম্ভব নয়, ট্যুইটবাবুও জানেন সম্ভব নয়। তাহলে? নির্বাচিত সরকারকে পদে পদে অপদস্থ করো, এইটা হচ্ছে বটমলাইন, এইটাই উদ্দেশ্য। একটা নির্বাচিত সরকারকে কাজ করতে দেবো না। ভাবুন একবার কোন গুষ্টির পিন্ডি উদ্ধার করতে দিল্লি যাচ্ছেন, তা জানা নেই, কিন্তু যাচ্ছেন। যাবার আগে একটা চিঠি লিখলেন মুখ্যমন্ত্রীকে? তা মুখ্যমন্ত্রীর ঠিকানা উনি বা ওনার অফিস জানেন না তা তো নয়, নিয়ম অনুযায়ী, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান, রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের প্রধানকে চিঠি লিখতেই পারেন, কিন্তু তা তো দিলু, ঘনা, মানাদাদের জন্য নয়, এটা ওই দু’জনের মধ্যে কমিউনিকেশন। কিন্তু ট্যুইটবাবু যেদিন চিঠি লিখলেন, সেদিন, সেই মূহূর্তে চিঠিটা ট্যুইট করে দিলেন, সে চিঠি যেন পশ্চিমবঙ্গবাসী, ভারতবাসী বা দুনিয়ার জন্য লেখা। দেশ জানে বিজেপি কী চায়, দেশ জানে ট্যুইটবাবু কী চায়? কিন্তু তার বাইরে, জার্মানি থেকে আমার এক বন্ধু ফোন করে বলল, হ্যাঁরে তোদের রাজ্যে নাকি জঙ্গলের শাসন চলছে, স্টেট গভর্নর ট্যুইট করেছেন? ভাবুন। বিদেশে গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল এই সাদা হাতির আসল গুরুত্ব কতটুকু তা তো জানে না, তারা তো জানে না যে উনি সাত সকালে উঠে দেশের প্রধানমন্ত্রীর মতই অনর্গল মিথ্যে বলেন, ট্যুইট করেন। কানাডা থেকে অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি থেকে ইংল্যান্ড, আমেরিকার মানুষ দেখছে ওয়েস্ট বেঙ্গলের গভর্নর লিখছে রাজ্যে আইনের শাসন নেই, কোন গভর্নর, যাঁর রাজ্যে এখনও সতীপুজো হয়, যার বিরুদ্ধে ওনার একটা কথা বলার ধক নেই, কোন গভর্নর? যিনি মধ্যপ্রদেশে একটার পর একটা নারী নির্যাতন নিয়ে একটা কথাও বলেননি। কোন গভর্নর? যিনি রকেটের মত বাড়তে থাকা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মৌনিবাবা। কোন গভর্নর? যিনি লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে হাঁটতে দেখেছেন হাজার মাইল, কিন্তু চুপ করেছিলেন। কোন গভর্নর? যিনি করোনা তাড়ানোর জন্য থালা পিটিয়েছিলেন।
এসব দিন চলে যাবে, আমার মামাবাড়ির মামলা জ্যেঠুর মত এক হাস্যকর ইতিহাস সবার মনে থেকে যাবে, আজকের ছেলেপুলেরা তাদের নাতি নাতনিদের বলবে, আজ থেকে অনেক আগে আমাদের রাজ্যে ছিলেন এক ট্যুইট বাবু, তিনি কেবল ট্যুইট করতেন, কেবল ট্যুইটই করতেন।