ক্রিশ্চিয়ান এরিকসনের মৃত্যুর চৌকাঠের থেকে ফিরে আসার খবর বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়তেই , সোশ্যাল মিডিয়া এই শব্দ গুলোই লিখে চলেছে।
আর ডেনমার্ক দলের ডাক্তার-মর্টেন বসেন? উনি কী বলছেন? সেই সময়ের ১০ মিনিটে লড়াই নিয়ে!
মর্টেন যখন ক্রিশ্চিয়ান এরিকসনের কাছে গিয়ে পৌঁছোন,টের পান ফুটবলার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। হৃদস্পন্দন হারিয়ে যাচ্ছে। তখনই টের পান,একটি সেকেন্ড সময়ও নষ্ট করা যাবেনা।
“আমি ওর শরীর ছুঁয়ে বুঝতে পারি, তখনও শ্বাস নিচ্ছে। তার পালস টের পাচ্ছিলাম। হঠাৎ, ছবিটা নিমেষে বদলে গেলো। আমরা চেস্ট পাম্প শুরু করি সঙ্গে সঙ্গে। সকলে তা দেখতেও পান।” মর্টেন শনিবার অনেক রাতে এরিকসন বিপদ কাটিয়ে ওঠার পর এক সাক্ষাতকারে এই কথা বলেন। জানা যায়, মাঠের তখনকার পরিস্থিতির কথা।
পরের ১০ মিনিটে যা যা ঘটতে থাকে, তা ইউরো কাপ ফুটবল দেখেনি। সবরকম চেষ্টা চলতে থাকে এরিকসনের বুকের ওপর। যাতে হৃৎস্পন্দন চলতে থাকে। ডেনমার্কের ফুটবলাররা ওঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ে। সকলের চোখে আতঙ্কের জল। মাঠের ১৫ হাজার দর্শক যাতে এরিকসনের সঙ্গে কি কি হচ্ছে তা দেখতে না পায়, সকলে এলে ওপরের হাত ধরে মানব শৃঙ্খল বানিয়ে ফেলে। এরিকসনের জিভ যাতে গলায় আটকে না যায়, সকলের আগে ডেনমার্ক অধিনায়ক সিমন কজার তাই করেন। বলতে গেলে, সিমনের তৎপরতায় এই যাত্রায় বেঁচে যান এরিকসন। চলতে থাকে চিকিৎসার সব পন্থা। গোটা স্টেডিয়াম সেই সময় মুহুর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়। দলনেতা সিমন এরপরই সহ ফুটবলারদের বলেন মানব শৃঙ্খল বানাতে। শুধু সকলে শরীর দিয়ে আড়ালই করেনি, দুটো সাদা টাওয়েল দিয়ে মাঠের সকলের দৃষ্টি আড়াল করে রাখে। টিভি সম্প্রচার স্বত আছে ইএসপিএনের হতে। সব ক্যামেরা চলছিল। অধিকাংশ ক্যামেরা ক্লোজ ছবি পেতে সেদিকেই তাক করে ছিল। মাঠের জায়ান্ট স্ক্রীনে ভেসে উঠেছিল সেই ছবি। দর্শকদের মধ্যে নিমেষে ছড়িয়ে পড়েছিল বিপদের আতঙ্ক। ডেনমার্কের সমর্থকরা এক সুরে বলতে থাকেন, ‘এরিকসন.. এরিকসন’ । ফিনল্যান্ডের সকলে বলতে থাকেন, ‘ ক্রিশ্চিয়ান …ক্রিশ্চিয়ান ‘ । কেউ কেউ গ্যালারি ধরে কাঁদতে থাকেন।
মাঠে তখন লড়াই চলছে।
সময় কাটতে থাকে। দূর থেকে দেখা যায় সতীর্থরা ফিরে গেছেন মাটিতে শুয়ে থাকা,এরিকসনের দিকে। কেউ বুকে ক্রস আঁকছেন। স্ট্রেচারে শোয়ানো হলো। তাঁকে আড়াল করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল মাঠের বাইরে। সেই সময় মাঠের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম শোনালো দলের ডাক্তার মার্টিন বসেনের গলা:’আমরা ফিরে পেয়েছি
ক্রিস্টিয়ানকে। আমার সঙ্গে সে কথা বলেছে।’ ততক্ষনে টিভি ক্যামেরা ধরে ফেলেছে এক নারীকে। মাঠে শুয়ে থাকা ফুটবলার এরিকসনের স্ত্রী সারবিনা কভিস্ত জেনসেনকে। খেলা দেখতে ছিলেন গ্যালারিতে। বিপদ বুঝে কাঁদতে কাঁদতে নেমে আসেন মাঠে। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে দেখা যায় অধিনায়ক সিমন আর গোলরক্ষক ক্যাসপার স্মাইকেল। সিমন আর ক্যাসপারই ছুটে ছিলেন সকলের আগে।
তারপর হাসপাতালে পৌঁছে যাওয়া। এরিকসনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী সারবিনা। ডেনমার্ক দলের ডাক্তার মার্টিন।
শুরু হয় চিকিৎসা। চলতে থাকে নানান টেস্ট। আর ততক্ষনে উয়েফা ঘোষণা করে দিয়েছে – ম্যাচ স্থগিত। মাঠের চিকিৎসা চলার সময় ডেনমার্কের ফুটবলাররা ছিলেন এরিকসনকে ঘিরে। আর ফিনল্যান্ডের ফুটবলাররাও ছিলেন মাঠের অন্য অংশে তাদের রিজার্ভ বেঞ্চের কাছে। কিন্তু তাদের মাঠে ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলা হয়। ড্রেসিংরুমে অপেক্ষা করতে থাকেন তারা। এরিকসনের হাসপাতাল যাত্রার পর, ডেনমার্ক ফুটবলাররা মানসিক চাপ নিয়ে ফেরে ড্রেসিংরুমে।
খেলা কিভাবে আবার শুরু হল….
কোপেনহেগেন হাসপাতালে চিকিৎসায় সাড়া দিতে শুরু করেন এরিকসন। এদিকে দুই দলকে নিয়ে জরুরি মিটিং বসে উয়েফা। ডেনমার্কের কোচ ম্যাচ শেষে বলেন, ‘ আমাদের কাছে প্রস্তাব ছিল, শনিবারই ম্যাচের বাকিটা খেলে নিতে। কিংবা পরের দিন আবার খেলা। দলের সকলের সঙ্গে হাসপাতাল থেকে কথা বলে এরিকসন। ও বলে, এখন অনেক ভালো আছে – ম্যাচটা খেলে নিতে। আমাদের সকলে ঘটনায় এতটা মানসিক চেপে ছিলাম, ঠিক করি – হোটেলে ফিরে রাতে ঠিক মতো ঘুম হবেনা। পরের দিন আবার খেলতে হবে। তারচেয়ে ম্যাচটা খেলে ফেরাই ভালো।’
প্রায় দেড় ঘণ্টা ম্যাচটি থেমে থাকার পর আবার শুরু হয়। ম্যাচের রেফারি যখন আবার মাঠে ঢোকেন দুই দলকে নিয়ে, দর্শকরা সকলে উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে সকলের মানসিক শক্তি জোগায়।
ইন্টার মিলান চিন্তায় ….
জাতীয় দলের হয়ে খেলতে আসার আগে অধিকাংশ নামী ফুটবলার বিদেশের বড় ক্লাবে খেলে। তাঁদের মেডিক্যাল ফাইল ক্লাব ডক্টর অনেক ভালো জানেন।
ইন্টার মিলানের ফিজিও পিয়েরো ভলপি সংবাদসংস্থা এ পি কে বলেছেন, ইতালির ক্লাবটি ডেনমার্ক ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করে গেছে ঘটনাটি দেখার পরই। কিন্তু উয়েফার সরকারি ঘোষণা ছাড়া তাঁরা বাড়তি কিছু জানতে পারেননি। ভোলপি জানিয়েছেন, ক্লাবে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এরিকসন টটেনহ্যাম থেকে খেলতে আসেন। যতবার মেডিক্যাল চেক আপ হয়, সব গুলিতে তিনি খুব ফিট বলেই প্রমাণিত হন। এমনকি এখনও পর্যন্ত কভিড -১৯ এর সমস্যায় পড়েননি।
তাহলে হঠাৎ এমন সমস্যা হল ! তাও ম্যাচ খেলতে খেলতে?
** হাসপাতালে ভালো আছেন এরিকসেন। সব ধরনের টেস্ট হচ্ছে। চিকিৎসায় সাড়া মিলেছে। নিজে ইন্টার মিলানের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে রবিবার সকালে ম্যাসেজ পাঠিয়ে নিজের সুস্থতার খবর দিয়েছেন।
সরাসরি সম্প্রচার নিয়ে বিতর্ক ….
ইউরো কাপ বিশ্বজুড়ে দেখানো হচ্ছে। ইএসপিএন
স্পোর্টস চ্যানেলে গোটা আমেরিকাতে এই টুর্নামেন্ট দেখানো হচ্ছে। মাঠের ঘটনাটি ঘটার অনেক্ষণ পরে টেলিকাস্ট বন্ধ করা হয়। ততক্ষণে অনলাইনে অনেকেই কড়া সমালোচনা শুরু করে দিয়েছিল। ইএসপিএনের দাবি ছিল, তাদের ক্যামেরা এসব দেখায়নি। যা দেখা গেছে , তা নাকি উয়েফোর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফিড থেকে দেখা গেছে। অর্থাৎ প্রোডাকশন যারা দেখছিলেন তাদের দায়িত্ব ছিল। এই স্পোর্টস চ্যানেলের দাবি , তাদের হাতে দায়িত্ব থাকলে তারা দূর থেকে গোটা স্টেডিয়াম দেখতো কিংবা স্টুডিওতে ফিরে যেত।
ছবি:সৌ-টুইটার।