মহাকাব্যিকই বটে। না হলে প্রথম দু সেট হেরে গিয়েও চৌত্রিশ বছরের একটা ছেলে হারিয়ে দিলেন তাঁর চেয়ে বারো বছরের ছোট একটা ছেলেকে। রোলাঁ গারো কোনও দিনই সদয় ছিল না তাঁর উপর। এটা তো রাফায়েল নাদালের খাস তালুক। সেই নাদালকেই তিনি আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে হারিয়ে এভারেস্ট জয় করেছিলেন। কিন্তু ফাইনালে উঠৈ কি তাঁর রথের চাকা বসে গেল? না হলে বাইশ বছরের গ্রিক যুবক, যিনি এই প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল খেলছেন তিনিই প্রথম দু সেট জিতে যাবেন। আর তিনি যাঁর ট্রফি ক্যাবিনেটে ১৮টা গ্র্যান্ড স্লাম ট্রফি রয়েছে, যিনি জীবনের ২৯তম গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল খেলছেন, তিনি মাথা নীচু করে কোর্ট ছাড়বেন?
না শেষ পর্যন্ত এ সব কিছুই হল না। বিশ্বের এক নম্বর এবং শীর্ষ বাছাই নোভাক জকোভিচকেই চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বরণ করে নিল রোলাঁ গারো। এবার নিয়ে দ্বিতীয় বার। প্রথম বার নোভাক ফরাসি ওপেন জিতেছিলেন ২০১৬ সালে। আর রবিবাসরীয় বিকেলে আবার জিতলেন গ্রিসের স্টেফানো সিসিপাসকে ৬-৭ (৬-৮), ২-৬, ৬-৩, ৬-২, ৬-৪ গেমে হারিয়ে। চার ঘণ্টা এগারো মিনিটের ম্যারাথন লড়াইয়ের শেষে জকোভিচ তুলে নিলেন তাঁর উনিশ নম্বর গ্র্যান্ড স্লাম খেতাব। রজার ফেদেরার এবং রাফায়েল নাদালের চেয়ে একটা কম রয়ে গেল তাঁর গ্র্যান্ড স্লাম ট্রফি। কিন্তু ফেদেরার বা নাদাল যা কখনও করতে পারেননি সেই বিরল রেকর্ড করলেন সার্বিয়ার বরপুত্র। রয় এমার্সন এবং রড লেভারের পর তিনিই এক মাত্র খেলোয়াড় যিনি চারটে গ্র্যান্ড স্লামই দু বার করে পেলেন। ৫২ বছর আগে ১৯৬৯ সালে এই রেকর্ড করেছিলেন লেভার। এত দিন পর তাঁকে স্পর্শ করলেন জকোভিচ। এখন তাঁর গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের রেকর্ড হল নয় বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, পাঁচ বার উইম্বলডন, তিন বার আমেরিকা ওপেন এবং দুবার ফরাসি ওপেন।
সুরকির কোর্টে খেলা হয় বলে চারটি গ্র্যান্ড স্লামের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন বলা হয় ফরাসি ওপেনকে। র্যালির পর র্যালি হয়। তাই জিততে হলে দরকার স্ট্রেন্থ, স্ট্যামিনা এবং টেমপারামেন্ট। প্রথম দুটি তো বরাবরই জকোভিচের সঙ্গী ছিল। কিন্তু টেমপারামেন্ট-ও যে কতটা থাকলে দু সেট পিছিয়ে পড়ে ম্যাচ জেতা যায় তা আবার দেখালেন জকোভিচ। এবারেই প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে লোরেঞ্জো মুসেতির কাছে প্রথম দু সেট পিছিয়ে পড়ে জিতেছেন। আবার সেমিফাইনালে রাফায়েল নাদালের কাছে প্রথম সেট হেরে জিতেছেন। সেটাই আবার করে দেখালেন ফাইনালে। প্রথম দু সেট হেরে টানা তিনটি সেট জিতে জয়।
গ্রিসের সিসিপাস এবার ছিলেন পঞ্চম বাছাই। এই প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল খেললেন তিনি। তাও আবার আঠেরো বারের জয়ীর সঙ্গে। শনিবারই মেয়েদের টেনিসে নতুন চ্যাম্পিয়ন পেয়েছে রোলাঁ গারো। সিসিপাস যখন প্রথম সেট টাই ব্রেকারে ৮-৬ পয়েন্টে জিতলেন তখন সে রকম সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল হাজার পাঁচেক দর্শকের মনে। সেটাই আবার বেড়ে গেল যখন দ্বিতীয় সেটে জকোভিচকে দাঁড়াতে না দিয়ে সিসিপাস জিতে গেলেন ৬-২ গেমে। কিন্তু তিনি তো জকোভিচ, বরাবরের লেট স্টার্টার। খেতাব হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে যেন ফুঁসে উঠলেন। সব্যসাচীর মতো তাঁর দু হাত চলতে শুরু করল। ডান হাতে ব্যাক ফোর হ্যান্ড ক্রস কোর্ট ভলির পাশাপাশি জোড়া হাতে ক্রস কোর্ট ব্যাক হ্যান্ডের ফুলঝুড়ি বেরোতে শুরু করল জোকারের র্যাকেট থেকে। তৃতীয় সেট ৬-৩ জিতে গেলেন জোকার। আর চতুর্থ সেটে দাঁড়াতেই দিলেন না সিসিপাসকে। জিতলেন ৬-২ গেমে।
তবে এবার না পারলেও ভবিষ্যতে যে তিনি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দাবিদার হবেন তার ইঙ্গিত দিয়ে সিসিপাস পঞ্চম সেটে তাঁর লড়াইটা ফিরিয়ে আনলেন। সেট নিয়ে গেলেন ৪-৪ গেমে। তার পর আর পারেননি। জকোভিচের অভিজ্ঞতার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন। দৃশ্যত তখন তাঁকে একটু ক্লান্তও লাগছিল। তবে সিসিপাস পরাজিত হলেও পুরস্কার বিতরণের সময় তাঁকে প্রচণ্ড হাততালিতে অভিনন্দন জানাল রোলাঁ গারো। বীরের মর্যাদা পেলেন তিনি। আর জকোভিচ? সোমবার সকাল থেকেই যিনি উইম্বলডন জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করবেন।
রাফা আর রজারকে ছুঁতে দরকার তো মাত্র একটা গ্র্যান্ড স্লাম। সেটা কি এবারের উইম্বলডনেই হয়ে যাবে? রোলাঁ গারো যেমন নাদালের রাজপাট, উইম্বলডনও তেমনি ফেদেরারের জমিদারি। একটা দখল করলেন, বাকিটা আর বাকি থাকবে কেন?