‘ওটা দিল্লির ব্যাপার’, মুকুল রায়ের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তনের প্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এভাবেই দায় সেরেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তাঁর এই প্রতিক্রিয়া সঙ্গত। মুকুল রায়ের মতো ওজনদার নেতাকে বিজেপিতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিলীপ বাবুদের ছিল না। দলের তৎকালীন সভাপতি অমিত শাহ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছিলেন এর কারিগর।
মোদী ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার পর থেকেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমীকরণ বদলে যায়। যার জেরে বিজেপিতে ক্রমে মোদী-শাহের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। স্বভাবতই, সারদা ও নারদে একাধিক কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তের মুখোমুখি হওয়া মুকুলকে দলে নেওয়া থেকে তাঁর সাংগঠনিক পদ প্রাপ্তির যাবতীয় সিদ্ধান্ত মোদী-শাহের। দিলীপেরা নিমরাজি ছিলেন। তাই মুকুল প্রসঙ্গে দিলীপের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বস্তুত তারই ইঙ্গিত মিলেছিল। সেই কারণেই দিল্লির কোর্টে বল ঠেলে দিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি। মুকুলকে হজম করার মুরোদ রাজ্য নেতাদের ছিল না। এখন দল ছেড়ে গেলেও তাঁকে উগরে দেওয়ার হিম্মতের অভাব রয়েছে দিলীপ ঘোষদের। আসলে শুধু মাত্র ভিড় বাড়াতে তো মুকুল আসবেন না,দলের কর্তৃত্বে তাঁর ভাগিদারিও থাকবে। সে কথা বিলক্ষণ বিশ্বস করে সেই আশঙ্কায় কিছুটা দ্বিধায় ছিল মুরলীধর সেন লেনের পদ্ম শিবির। শেষমেষ মোদী-শাহদের নির্দেশে মুকুলকে মেনে নিয়েছিলেন দিলীপ বাহিনী কিন্তু মেনে নিতে পারেননি কেশব ভবনের অনুগত প্রাক্তন আরএসএস প্রচারক।
ফলে, দলের আট জন সর্বভারতীয় সহ সভাপতির অন্যতম মুকুল ফিরে যাওয়ার তৃণমূলের যতটা প্রত্যক্ষ লাভ হয়েছে তার চাইতে ঢের গুণ বেশি অপদস্ত হয়েছে মোদী -শাহ জুটি। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে ভোট বাড়িয়ে এক ধাক্কায় দুই থেকে ১৮আসনে উন্নীত হওয়ায় অমিত শাহ প্রকাশ্যে মুকুলকেই কৃতিত্ব দিয়েছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই তা দিলীপ শিবিরের কাছে যথেষ্ট বিড়ম্বনার কারণ হয়েছিল। সেই মুকুল দল ছাড়ায়, মুখে না বললেও দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর পরোক্ষে ঝাল ঝাড়তে চাইছেন দিলীপ ঘোষরা।
দুই বছর আগে এককভাবে তিন শতাধিক আসনে জিতে মোদী দ্বিতীয়বারের জন্য দিল্লির মসনদে বসলেও একের পর এক রাজ্যে ধরাশয়ী হয়েছে বিধানসভা ভোটের নিরিখে। সবচাইতে বড় ধাক্কা খেয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বাংলায়। করোনা সংক্রমণে বিদ্ধস্ত দেশ। সেখানে অতিমারীরর মোকাবিলা হতে পারতো কেন্দ্রের রাজধর্ম পালনের অগ্রাধিকার। দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলা দখলে মরিয়া প্রচার চালালেন। দখল তো দূরস্ত একশো আসনের ধারে কাছে পৌঁছতে পারেনি মোদী -শাহের দল। তাই বিজেপির কেন্দ্রীয় স্তরে এই জুটির আধিপত্য যাঁরা এতদিন মুখ বুজে সহ্য করে এসেছেন,তাঁদের হাতে বাংলার ভোট বিপর্যয় নতুন অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। তাতেই এবার মুকুল কাণ্ড মোঈ-শাহের কাছে বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে উঠেছে। সামনেই উত্তর প্রদেশের নির্বাচন। এরই মধ্যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে বিরোধ বেঁধেছে উত্তরপ্রদেশের রাজ্য বিজেপির। গোষ্ঠী কোন্দল সামাল দিতে স্বয়ং মোদীকেই ময়দানে নামতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন যোগী। আসন্ন বিধানসভা ভোটে তা ছাপ ফেলতে পারে । কর্ণাটক, রাজস্থান,মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাতেও গোষ্ঠী কোন্দল প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। এই পটভূমিতে মুকুলের বিজেপি ত্যাগ জাতীয় স্তরে বিজেপিকে বিপাকে ফেলার সমূহ সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠছে। যা বস্তুত মোদী-শাহ জুটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিতে পারে। এরই মধ্যে বাংলার দায়িত্বে থাকা মোদী-শাহের অনুগত কৈলাস বিজয় বর্গীয়, শিব প্রকাশ সম্পর্কে রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ দলের অন্দরে সরব হওয়ার তাল খুঁজছেন। সব মিলিয়ে বলা চলে ভোটে গো-হারা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে মাস খানেকের ব্যবধানে মোদী-শাহকে মমতা যে ধাক্কা দিলেন,তার কম্পনের তীব্রতা দিল্লির দীনদয়াল উপাধ্যায় ভবনের কর্তাদের বিশেষত মোদী-শাহ জুটিকে বিপণ্ন করে তুলেছে বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা।