জার্মানি–৪ পর্তুগাল–২
( ডায়াস–নিজ গোল, গুয়েরেইরো–নিজ গোল, কাই হার্ভাৎজ, রবিন গোসেনস) (রোনাল্ডো, দিয়োগো জোটা)
এখন পর্যন্ত এবারের ইউরোর সেরা ম্যাচ তো বটেই। হয়তো বিশ্ব ফুটবলের হল অব ফেমেও চলে যাবে এই ম্যাচটা। আর জার্মানির ফুটবল ইতিহাসের রূপকথায় তো চলেই যাবে ম্যাচটা। যেভাবে ব্রাজিল বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে ৭-১ কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ব কাপে আর্জেন্তিনাকে ৪-০ হারানো জার্মান ফুটবল রূপকথার অঙ্গ। মনে পড়ছে ব্রাজিলেই সেবার পর্তুগালকে ৪-০ গোলে হারিয়েছিল জার্মানি। কিন্তু তাতে বিশেষ কৌলিন্য ছিল না। শুরুতেই পেপে লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। রোনাল্ডোও তখন খুব একটা ফিট ছিলেন না। কিন্তু শনিবার যা হল তা সত্যিই রূপকথা, যার জন্য ফুটবল বিশ্ব প্রস্তুত ছিল না।
জার্মান সমর্থকরা বলতেই পারেন, খোঁচা খাওয়া বাঘ যেমন মারাত্মক জার্মানরা সে রকম। তাদের অহং বোধে আঘাত লাগলে তারা ফুঁসে ওঠে এবং বিপক্ষকে তাড়া করে একদম আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দেয়। গ্রূপ লিগের প্রথম ম্যাচে ফ্রান্সের কাছে আত্মঘাতী গোলে হারের পর টুর্নামেন্টে টিকে থাকতে গেলে এই ম্যাচটাতে জিততেই হত তাদের। তাই নিজেদের দেশকে সমর্থন করার জন্য মিউনিখের অ্যালায়েঞ্জ এরিনায় হাজার হাজার সমর্থক হাজির হয়েছিলেন করোনাকে উপেক্ষা করে। এবং শুরু থেকেই জার্মান স্নিফার ডগের মতো শিকারের জন্য ছুটে বেরিয়েছেন জোয়াকিম লো-র ফুটবলাররা। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পর্তুগাল গোলে বল ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন লেফট ব্যাক রবিন গোসেনস। ইতালির সিরি আ-তে আটলান্টার এই ফুটবলারটি এদিনের ম্যাচের হিরো। প্রতিটি গোলের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা আছে। জসুয়া কিমিচের সেন্টার থেকে গোলে বল রাখলেও সেটা গোল হয়নি। কারণ টমাস মুলার তার আগে হ্যান্ডবল করে ফেলেন।
গোল না হলে কী হবে জার্মানদের প্রেসিং ফুটবলে পর্তুগাল তখন দিশেহারা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাদের। মাঠের মধ্যে শুধু জার্মানি। কিন্তু এরই মধ্যে পর্তুগালই প্রথম গোলটা করে ফেলল। এবং করলেন সেই রোনাল্ডো। নিজের ১০৭ নম্বর আন্তর্জাতিক গোল। কিন্তু এই প্রথম তিনি জার্মানির নেটে বল ঢোকালেন। পনেরো মিনিটের মাথায় জার্মানির টনি ক্রূসের কর্নার থেকে ক্লিয়ারেন্সের বলটা পেয়ে বাঁ প্রান্ত দিয়ে তীর বেগে ছুটতে থাকেন বের্নাডো সিলভা। উঁচু সেন্টার করেন দিয়োগো জোটাকে উদ্দেশ্য করে। বুক দিয়ে বলটা রিসিভ করে জোটা বক্সে ঢুকে পড়েন এবং আগুয়ান ম্যানুয়েল ন্যয়ারকে কাটিয়ে বল সাজিয়ে দেন রোনাল্ডোর জন্য। ফাঁকা গোলে বল রাখতে অসুবিধে হয়নি সি আর সেভেনের।
আচমকা এই গোলটা খেয়ে থমকানো তো দূরের কথা জার্মানদের আক্রমণের তোড় আরও বাড়ল। কিন্তু গোল শোধ হল ৩৫ মিনিটের মাথায়।ডান দিক থেকে জসুয়া কিমিচের সেন্টার গোসেনস ধরে পাসটা করেছিলেন হার্ভাৎজকে। কিন্তু তাঁর কাছে বল যাওয়ার আগে পর্তুগিজ সেন্টার ব্যাক রুবেন ডায়াস ক্লিয়ার করতে গিয়ে গোলে ঢুকিয়ে দেন। চার মিনিট যেতে না যেতেই আবার আত্মঘাতী গোল খেয়ে যায় পর্তুগাল। সেই গোসেনসের কাছ থেকে বল যায় হার্ভাৎজের কাছে। তাঁর শট পর্তুগিজ গোলকিপার প্যাট্রিসিয়া চাপড়ে বের করে দিলে কিমিচ শট নেন। সেই শট বাঁচাতে গিয়ে রাফায়েল গুয়েরিয়রো গোলে ঢুকিয়ে দেন। এই গোলটার পর জার্মানি একটা অনন্য রেকর্ডের অধিকারী হয়ে গেল। একই টুর্নামেন্টে তিনটি আত্মঘাতী গোলের সঙ্গে জড়িয়ে গেল তারা।
বিরতিতে ২-১ গোলে এগিয়ে থাকা জার্মানি যেন কিছুই হয়নি এভাবে শুরু করে। এটাই টিপিক্যাল জার্মানি। বিপক্ষকে শুধু ফেলে দিলেই হবে না, তাদের দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দাও। এই হল তাদের মানসিকতা। ৫১ মিনিটে গোসেন চমৎকার বল সাজিয়ে দেন কাই হার্ভাৎজের জন্য। গোল করতে ভুল করেননি চেলসি স্ট্রাইকার। কিন্তু তখনও তো গোসেনসের নিজের গোলটাই হয়নি। ৬১ মিনিটে কিমিচের সেন্টার থেকে হেড করে গোল করলেন গোসেনস। ৩৫ থেকে ৬১ মিনিট–এই ছাব্বিশ মিনিটের একটা টর্নেডো যেন বয়ে গেল মিউনিখের স্টেডিয়ামের উপর দিয়ে। এবং ঝড়ের পর শান্ত হল জার্মানরা। তারই ফলে ৬৭ মিনিটে আরও একটা গোল শোধ করল পর্তুগাল। মৌতিনহোর ইনডাইরেক্ট ফ্রি কিক ধরে রোনাল্ডো বলটা বাড়ান দিয়োগো জোটার জন্য। গোল করতে ভুল করেননি পর্তুগিজ মিডফিল্ডার।
অতএব এফ গ্রূপে দুটি করে ম্যাচের শেষে জার্মানি, পর্তুগাল এবং ফ্রান্স–তিনটে টিমেরই নক আউটে যাওয়ার সম্ভাবনা জিইয়ে রইল। জার্মানি এবং পর্তুগালের পয়েন্ট তিন। ফ্রান্সের চার। শেষ ম্যাচে জার্মানি পাবে হাঙ্গারিকে। তারা আজকে ফ্রান্সকে রুখে দিলেও এই জার্মানির সঙ্গে এঁটে ওঠা মুশকিল। নজর থাকবে গত ইউরোর চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্সদের ম্যাচে। ফ্রান্স কি পারবে পর্তুগালকে হারিয়ে পাঁচ বছর আগের হারের বদলা নিতে। ২৩ জুন সেই ম্যাচ। তার আগে চার দিন সময় পাচ্ছেন রোনাল্ডোরা জার্মান জাগারনটদের হাতে তাদের হেনস্থার ট্রমা কাটিয়ে ওঠার জন্য।