‘আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক ছিল, সিবিআই ‘অসত্য’ বলছে’, নারদ- মামলায় আদালতে জানাল রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর। নারদ-মামলায় গত ১৭ মে সিবিআই চার নেতা-মন্ত্রীকে গ্রেফতার করার পরই কলকাতার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়, এবং সেকারনেই সিবিআই গ্রেফতার হওয়া চার নেতা-মন্ত্রীকে আদালতে নিয়ে যেতে পারেনি৷ বাধ্য হয় ভারচুয়াল শুনানিতে৷
আদালতে হলফনামার মাধ্যমে সিবিআইয়ের আনা এই অভিযোগ সরাসরি উড়িয়ে দিলো রাজ্য সরকার৷ সিবিআইয়ের আনা এ সংক্রান্ত প্রতিটি অভিযোগকে ‘অসত্য’ এবং ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ চিহ্নিত করে হাইকোর্টে হলফনামা পেশ করেছে রাজ্য সরকার৷ রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের অতিরিক্ত সচিব নির্মাল্য ঘোষালের পেশ করা ৪২ পাতার হলফনামায় সিবিআইয়ের আনা প্রতিটি অভিযোগ যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা হয়েছে৷ হলফনামার সঙ্গেই সংযুক্ত করা হয়েছে একাধিক তথ্য প্রমাণ, যাতে স্পষ্ট হয়েছে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা গত ১৭ মে শহরে আইনশৃঙ্খলা না থাকা, সিবিআইকে কলকাতা পুলিশের সাহায্য না করার প্রতিটি অভিযোগ অসত্য৷
সোমবার রাজ্যের এই হলফনামা হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে দাখিল করেছেন অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত৷ ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, এই হলফনামা নিয়ে রাজ্যের বক্তব্য পরে শোনা হবে৷
রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের অতিরিক্ত সচিবের এই হলফনামায় গত ১৭ মে চার নেতা-মন্ত্রীকে সিবিআই গ্রেফতার করার পর নিজাম প্যালেস এবং বিচার ভবনের পরিস্থিতি ঠিক কেমন ছিলো, তা তুলে ধরা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই সিবিআই অসত্য কথা বলেছে আদালতে৷
কী বলা হয়েছে হলফনামায় ?
নিজাম প্যালেস, (এখানেই সিবিআইয়ের দফতর এবং চার নেতা-মন্ত্রীকে গ্রেফতার করে এখানেই আনা হয়েছিলো)
১) সিবিআই হলফনামায় অভিযোগ করলেও নিজাম প্যালেসের সামনের রাস্তায় কোনও অবরোধ ছিল না৷ এজেসি বসু রোডের গেটের কাছে কিছু লোক নেতা-মন্ত্রীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদ করছিলেন শুধুই স্লোগান দিয়ে৷
২) নিজাম প্যালেসের আর একটি গেট আছে ওসি গাঙ্গুলি সরনিতে৷ সেই গেট একদমই ফাঁকা ছিল৷
৩) এজেসি বসু রোডের গেটের কাছেই ছিলেন কলকাতা পুলিশের একাধিক শীর্ষ অফিসার৷ ছিলেন ভবানীপুর, শেকসপিয়ার সরণি এবং কালীঘাট থানার ওসি-রা৷ তাঁরাই ভিড় নিয়ন্ত্রণ করছিলেন৷
৪) নিজাম প্যালেস কম্পাউণ্ডের ভিতরে ছিলেন আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা৷
৫) কলকাতা পুলিশের পদস্থ কর্তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন সিবিআই অফিসারদের সঙ্গে৷
৬) সিবিআইয়ের তরফে গ্রেফতার হওয়া চারজনকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে নিয়ে যেতে একবারও কলকাতা পুলিশকে বলা হয়নি, সাহায্যও চাওয়া হয়নি৷
৭) নিজাম প্যালেসের বাইরের রাস্তায় যারা স্লোগান দিচ্ছিলেন, তাদের দিকে লাঠি হাতে এক সময় তেড়ে যায় কেন্দ্রীয় বাহিনী৷ এর পরেই সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়৷ কলকাতা পুলিস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে দ্রুত৷
৮) সিবিআই হলফনামায় অভিযোগ করলেও বাস্তব এটাই, ওইদিন নিজাম প্যালেসে ঢোকা বা বেরোনোর রাস্তা একবারের জন্যও বন্ধ হয়নি৷ ওখানে থাকা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে তিন ঘন্টায় মোট ১২৯টি গাড়ি নিজাম প্যালেসে ঢুকেছে এবং বেরিয়েছে৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকলে এটা সম্ভব হতো না৷
৯) সিবিআইয়ের দফতর নিজাম প্যালেসের ১৪ এবং ১৫ তলায়৷ ওখানে একজন বহিরাগতও যেতে পারেনি৷
১০) নিজাম প্যালেসের ভিতরে বা বাইরে কোনও ধরনা-বিক্ষোভ হয়নি৷ সিবিআই আদালতে বার বার ধরনা-বিক্ষোভের কথা বলেছে৷ এ সংক্রান্ত ভিডিও ফুটেজ সিবিআই আদালতে পেশ করুক৷
১১) সিবিআই আধিকারিকরা যাতে সময়ের মধ্যেই বিবাদি বাগ এলাকার আদালতে পৌঁছাতে পারে, সেজন্য ডিসি-সাউথ এবং ডিসি-ট্রাফিকের নির্দেশে যাতায়াতের পথটি ‘গ্রিন করিডোর’ করে দেওয়া হয়৷ ঠিক সময়ে সিবিআই, বাধাহীনভাবে আদালতে পৌঁছে যায়৷ সঙ্গে ছিল কলকাতা পুলিশের এসকর্ট টিম৷
১২) গভীর রাতে সিবিআই অভিযুক্তদের নিজাম প্যালেস থেকে প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে নিয়ে যাওয়ার জন্য কলকাতা পুলিশের সাহায্য চায়৷ পুলিশ দ্রুততার সঙ্গে সেই ব্যবস্থা করে দেয়৷
১৩) সহযোগিতা না পাওয়া বা বাইরের লোকজনের বাধাদান নিয়ে সিবিআই এখনও পর্যন্ত কলকাতা পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ বা এফআইআর দায়ের করেনি, কোনও ভিডিও ফুটেজ দেখাতে পারেনি৷ অভিযোগ তোলা ছাড়া সিবিআই এখনও পর্যন্ত এ অসহযোগিতা বা আইনশৃঙ্খলা না থাকার কোনও প্রমাণ পেশ করতে পারেনি৷
১৪) কলকাতা পুলিস ওইদিন নিজাম প্যালেসের বাইরের রাস্তায় থাকা একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেছে৷
বিচার ভবন (ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বিচার ভবনেই সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত, এখানেই ১৭ মে চার অভিযুক্তের মামলার ভারচুয়াল শুনানি হয়)
১) বিচার ভবন চত্বরে মিডিয়ার লোকজন ছাড়া একজন বাড়তি লোকও ছিল না৷
২) সিবিআই এখনও পর্যন্ত বিচার ভবনের সামনে বা চত্বরে জমায়েতের কোনও ফুটেজ দেখাতে পারেনি৷ থাকলে, তা প্রকাশ করা হোক৷ অথচ সিবিআই আদালতে বলেছে, ওখানে সেই সময় হাজারখানেক দুষ্কৃতীর ভিড় ছিল৷
৩) গত ১৭ মে বিচার ভবনে থাকা সব ক’টি কোর্টে স্বাভাবিক কাজকর্ম. চললেও সিবিআই নিজেদের সিদ্ধান্তে চার নেতা-মন্ত্রীর শুনানি ভারচুয়ালি করে৷
৪) কোনও মন্ত্রী সেদিন এজলাসে প্রবেশ করেননি৷ সিবিআই এ বিষয়ে অসত্য বক্তব্য পেশ করছে৷
৫) নিজাম প্যালেসে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী লোকজন নিয়ে ঢুকেছিলেন বলে যে অভিযোগ সিবিআইয়ের হলফনামায় করা হয়েছে, তা মিথ্যা৷ সিবিআই এ সংক্রান্ত প্রমান দিতে পারছে না৷
৬) বিচার ভবনে মাননীয় আইনমন্ত্রী লোকজন নিয়ে ঢুকেছিলেন বলে যে অভিযোগ সিবিআইয়ের হলফনামায় করা হয়েছে, তা মিথ্যা৷ সিবিআই এ সংক্রান্ত প্রমান দিতে পারছে না৷
৭) আদালতে পাবলিক প্রসিকিউটর ঢুকতে বাধা পেয়েছে বলে যে অভিযোগ সিবিআইয়ের হলফনামায় করা হয়েছে, তা মিথ্যা৷ সিবিআই এ সংক্রান্ত প্রমান দিতে পারছে না৷